যান্ত্রিক জীবনে প্রাণের ছোঁয়া বুয়েট এলামনাই অস্ট্রেলিয়া পুনর্মিলনি ২০১৬ মোঃ ইয়াকুব আলী
প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন – “মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা এই তিনটি জিনিস সবার কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়”
জনশ্রুতি আছে প্রকৌশলীরা স্বভাবতই পড়াশুনার কঠোর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে দিনে দিনে যন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে যান। কিন্তু প্রকৌশলীরাও একজন সাধারণ মানুষের মত নিজের দেশ ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন এবং অন্তরে ধারণ করেন অকৃত্রিম দেশপ্রেম। বিশেষকরে যারা দেশ থেকে দুরে থাকেন তাদের অন্তরে দেশের সংস্কৃতিকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা থাকে। তাই দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রকৌশলীগণ নিজেদের অন্তরের ক্ষুধা মেটাতেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের একটা আবহ তৈরি করে পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখান। বাংলাদেশের বাইরে বুয়েটে প্রকৌশলীদের অন্যতম আড্ডাখানা হচ্ছে সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়া। সংগঠনটির নাম বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া।
বেশ কবছর ধরেই অস্ট্রেলিয়ার বুকে এই সংগঠনটাকে মায়ের আদরে আগলে রেখেছেন বুয়েটেরই কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ আপু এবং ভাইয়ারা। উনারা যেন এক একজন বটবৃক্ষ আর তার সাথে শত শত ঝুরির মত যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ব্যাচের আরো কিছু উৎসাহী বুয়েটিয়ান। এ বছর যখন বুয়েট এলামনাই এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়া তাদের পুনর্মিলনি আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিল, তখন আর সেটা সফল করা জন্য লোকের অভাব হল না। সবাই যার যার অবস্থান থেকে নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতে লাগলো আর বটবৃক্ষরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে তাদেরকে সহযোগিতা করতে থাকলো। বিভিন্ন বাসায় রাতদিন চলতে থাকলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি যেখানে বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থিরাতো বটেই তাদের পরবর্তী প্রজন্মরা পর্যন্ত সেখানে মনপ্রাণ উজাড় করে চর্চা চালিয়ে যেতে থাকলো। চলতে থাকলো অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লেখা, তাঁর সংশোধন, পরিমার্জন এবং ফটোকপি। এটা যেন সেই বুয়েট জীবনের বড় ভাইয়া আপুদের কাছ থেকে চোথা সংগ্রহ করে পলাশীতে যেয়ে ফটোকপি করারই অস্ট্রেলিয়ান রূপ।
অনুষ্ঠান শুরু হল ২২শে মে বেলা ১২ টা থেকে। সহপাঠী, বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়োকনিষ্ঠ সবার যে মিলন-মেলা হল সেটা আসলেই অনেক বেশি আবেগ-ঘন এবং আনন্দময়। অনেক দিন পর সবাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিচিত অপরিচিতদের কাছে পেয়ে কি যে করবে সেটাই ঠিক করে উঠতে পারে না। কখনও সেলফি, কখনও এক পরিবার অন্য পরিবারের সাথে পরিচিত হয় আর সাথে সাথে চলে স্মৃতিচারণ। অপরদিকে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়োকনিষ্ঠের মধ্যে চলে যুগের বিবর্তনে বুয়েটের পরিবর্তনের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। সেই ১৯৬২ সালের ব্যাচ থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রায় সবাই একে অপরের সাথে এমনভাবে গল্প করতে থাকে যেন উনারা যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চিনেন। কিন্তু বয়সের হিসেব করলে একজন যখন তাঁর পড়াশুনা বুয়েট থেকে শেষ করেছেন তখন অন্যজনের এই ধরাধামে আগমনই ঘটে নাই। এই মিলন-মেলার স্মৃতি ধরে রাখতে আরো ছিল “Capture your moments with YASIR”-এর ফটো-সেশন। অনুষ্ঠানের খাওয়া দাওয়াও যেন হলের সেই ফিস্টের পেট পূজা।
মধ্যাহ্ন ভোজনের পরই সোনিয়া এবং শাকিল ভাইয়ের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় শুরু হল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেখানে একের পর এক চলতে থাকে আবৃত্তি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, লালনগীতি, আধুনিক গান, র্যা ফেল ড্র ইত্যাদি। এত আয়োজনের ফলাফলও পাওয়া গেল হাতেনাতে। সবাই খুব সুন্দরভাবে অনেক গুছিয়ে নাচ-গান উপহার দিল উপস্থিত দর্শকদের। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই পরবর্তী প্রজন্মের মুখে “আমরা করব জয় একদিন” যেটা শুনে মনে হচ্ছিল বুয়েটের পরবর্তী প্রজন্ম ভাষার বাঁধা ডিঙিয়ে নিজেদের অন্তরে বাংলা ভাষা এবং তাঁর সংস্কৃতিকে যুগ যুগ ধরে ধারণ করে চলবে এবং একদিন তাদের মাধ্যমেই অর্জিত হবে বাংলাদেশের বিশ্বজয়। এরপর যখন তাদের কোমল কণ্ঠে ধ্বনিত হল “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি, জন্ম দিয়েছো তুমি মাগো তাই তোমায় ভালোবাসি” যেন মা এবং মাটির প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। এরপর যখন এলামনাইয়ের সদস্যদের কণ্ঠে লালনগীতি এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত বেজে উঠলো তখন মনে হচ্ছিল যেন তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কখনই বাংলাদেশের চিরায়ত রূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দিবেন না। শুধু বুয়েট পরিবার থেকেই না, এই সাংস্কৃতিক আয়োজনকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল অতিথিদের পরিবেশনাও তন্মধ্যে স্পর্শ ব্যান্ড, নাচের শিল্পী ফ্রান্সিলিয়া এবং অর্কিতা, গানের শিল্পী সীমা আপা, আবৃত্তিকার শির্ষেন্দু এবং তাইফ রহমান ছিলেন তবলায়। এছাড়াও বাচ্চারা যাতে বিরক্তবোধ না করে তাই তাদের জন্য ছিল চিপস, চকোলেট আর ফ্রি হ্যান্ড আকাআকির ব্যবস্থা। এ যেন প্রথম বিশ্বের এই ঘড়ির কাটা ধরে চলা যান্ত্রিক জীবনে প্রাণের পরশ। সামাজিকতা আর সংস্কৃতি চর্চা ছাড়াও, পরবর্তীতে এলামনাইয়ের কর্মকাণ্ডকে আরো কি কি ভাবে বর্ধিত করা যায় সেই বিষয়েও আলোচনা করা হয়। নিজ দেশ ছেড়ে এই দুর দেশে এসে বুয়েটিয়ানরা যেন পেশাগত সহায়তা পায় সিনিয়রদের থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে এবং তাদেরকে আর কি কি ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করা যায় সেটার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।
কিন্তু সময় খুবই নির্মম, সে বয়ে চলে তাঁর আপন গতিতে। এভাবে চলতে চলতে কখন যে ছয়টা ঘণ্টা পেরিয়ে যায় কারোই সেদিকে খেয়াল থাকে না। আসলে সুন্দর সময় কখনই দীর্ঘ হয় না কিন্তু তাঁর স্মৃতি গেঁথে থাকে অন্তরের গহীনে আমরণ। তাই শেষ মুহূর্তে এসে সবার মন ভারী হয়ে যায়, চোখ ঝাপসা হতে থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার এই ভেবে সবাই উৎফুল্ল হয় যে আবারও বুয়েট এলামনাই অস্ট্রেলিয়ার আয়োজনে বসবে এরকমই কোন মিলন-মেলা, দেখা হবে এদেরই সাথে, হয়তো যোগ হবে আরো নতুন মুখ এই অস্ট্রেলিয়ায়। আবার হবে স্মৃতিচারণ, আবার হবে খুনসুটি, আবার হবে শেকড়ে ফেরা যার শেকড় গেঁথে আছে বাংলাদেশের বুকে স্ব-মহিমায় মাথা উঁচু করে থাকা একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুয়েটে।
এই সফল আয়োজনের পিছনের যাদের যাদের নাম না বললেই নই –তারা হলেন আমাদের প্রিয় মাহমুদা রুনু আপু (CE, 82,), কেয়া আলী আপু (ARCH, 93), কবিতা চাকমা আপু (ARCH, 85), নিশাত সিদ্দিকি আপু (CE 91), শাকিল চৌধুরী ভাই (ChE, 95), তানভীর আহমেদ তমাল ভাই (EEE, 94), তানভীর আহমেদ পিয়াস (CE 98), নুরে আলম পাটোয়ারী (CE, 98), তানজিনা নুর(CE, 98,), ফারহানা রিফাত (CE,98), সোনিয়া আনসারি (ChE, 01), রাশিদা ভূইয়া সহ (CE, 04,) আয়োজক কমিটির আরো অনেকে, তোমাদের সবাইকে এবং বুয়েট এলামনাই অস্ট্রেলিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
মোঃ ইয়াকুব আলী, পুরকৌশল-১৯৯৮ ব্যাচ
|