স্ট্যাচিন এর গল্প-গাথা আবু এন এম ওয়াহিদ
আগের অংশ
ক্রিস্টোসের মতে, আরো দু’টি মজার খাবার ‘কোফতা’ এবং ‘গাইরোস’ এর সূতিকাগার হলো গ্রিস। তবে বন্ধু মাহবুবের গবেষণা মতে ‘কোফতা’র উৎপত্তি পারস্য অর্থাৎ বর্তমান ইরান দেশ, অবশ্য ‘গাইরোস’-এর উদ্ভব গ্রিসে হলে হতেও পারে। গ্রিক ইয়োগার্টের কথা যখন আলোচনার টেবিলে আসলো তখন দেখলাম ক্রিস্টোস এর বুক গর্বে ফুলে উঠলো। যখন বিখ্যাত ‘ইজমির কোফতা’ (ইজমির, তুরস্কের জনপ্রিয় পর্যটন নগরী) নিয়ে আলোচনা শুরু হলো, তখনও দেখলাম ক্রিস্টোসের চেহারায় আলোর ঝিলিক, ‘আমার বাবা গ্রিক হলেও আমার নানার বাড়ি ইজমির’। কথাটা বলতে সে একটুও দেরি করলো না। চা খেতে গিয়ে দেখলাম, টি ব্যাগের গায়ে লেখা, ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’। আমি প্রসঙ্গ তুললে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হলো, ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ কি এবং চায়ের প্যাকেটে ‘ইংলিশ ব্রেকফাস্ট’ শব্দ দু’টো লেখারই বা মানে কি। এ বিষয়ে আগামীতে আরেকটি পৃথক রচনা লেখার ইচ্ছা আছে।
আমাদের নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে ইয়ারোশ্ত তাদের নিজেদের কিছু ইতিহাস ও আবেগের কথা পাড়লো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্ট্যাচিন ছিলো জার্মানির অঙ্গীভূত, জার্মান মানুষ অধ্যুষিত একটি জার্মান শহর। আগেই বলেছি, যুদ্ধে জিতে রাশিয়া পোল্যান্ডের একটি বড় অঞ্চল দখল করে নিলো এবং ওই সব দখলকৃত এলাকা থেকে পোলিশদের স্থানান্তরিত করে স্ট্যাচিন অঞ্চলে নিয়ে এলো। তার আগে রাশিয়ানরা তাদের ইচ্ছামতো যুদ্ধে পরাজিত জার্মানির উত্তর-পূর্ব সীমান্তকে প্রায় ২ শ’ কি.মি. পশ্চিম দিকে ঠেলে দেয়। এ ভাবে স্ট্যাচিন পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং আজকের স্ট্যাচিনবাসিরা, ‘স্ট্যাচিনবাসি’-তে পরিণত হয়। ইয়ারোশ্ত বললো, তারা স্ট্যাচিনের বাসিন্দা হলেও আদতে বহিরাগত। এ শহরে তারা থাকে বটে, কিন্তু তাদের পরিবারের কিংবা বংশের শেকড়ের কোনো সন্ধান এখানে কিংবা এর আশে পাশে কোথাও নেই। এ নিয়ে তাদের মাঝে লক্ষ করেছি গভীর দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার!
ষাট ও সত্তর-এর দশকে আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন অহরহ স্লোগান শুনতাম, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, ধ্বংস হোক’। তখন জানতাম না, কিন্তু এখন দেখছি, সাম্রাজ্যবাদী আচার আচরণ শুধু আমেরিকানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এই প্রবণতা রাশিয়ানদের মধ্যেও ছিলো, এবং এখনো আছে।
এ বার আসি আজকের শেষ প্রসঙ্গে। শহর ঘুরতে বেরুনোর আগে ওই দিন ইয়ারোশ্ত আমাদেরকে সবার আগে নিয়ে গিয়েছিলো স্ট্যাচিন সেন্ট্রাল সেমেটারিতে। এটা ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম গোরস্থান। এর আয়তন ১ হাজার ৬ শ’ ৬৭ হেক্টর এবং এখানে ৩ লাখ মানুষের কবর আছে। এই বিশাল কবরস্থানে শুয়ে আছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকরা, এখানে কবর আছে রাশিয়ানদের, জার্মানদের, ইহুদীদের। এ ছাড়াও এখানে আছে ইউরোপের অনেক দেশের মানুষের কবর। যখন কবরস্থানে গিয়ে আমরা পৌঁছাই তখন মাত্র সন্ধ্যা নেমে আসছে। মূল প্রবেশপথের বড় বড় বিদ্যুতের বাতি চোখ ঝলসে দিচ্ছিলো। ভেতরে ঢুকে দেখতে পাচ্ছিলাম, বড় বড় গাছের নিচে কবরে কবরে জ্বলছে নিভু নিভু মোমবাতির কাঁপা কাঁপা মৃদু আলো।
গোরস্থানের মূল রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডে এক অদ্ভুত ধরনের বড় বড় গাছ দেখলাম। এ জাতীয় গাছ আমি আগে আর কোথাও দেখিনি। কবর স্থানের যে অংশ ধরে ইয়ারোশ্ত আমাদের নিয়ে হাঁটলো, সেখানে কোনো ঘাস নেই, একটা গাছের পাতাও নেই। একেবারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝক তকতক করছে। হাঁটতে হাঁটতে ইয়ারোশ্ত কতো কথা বলেছে, আমার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু আমি ভেবেছি অন্য কথা। বিশাল গোরস্থানে অসংখ্য মানুষের কবরের মাঝে আমার মনে হয়েছে, এই লোকগুলোই তো এক সময় আমাদের মতো দু’পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতো, হাঁটতো, চলতো, কথা বলতো, জীবন জীবিকা চালাতো। শুধু তাই নয়, তাদের অনেকে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, যুদ্ধ করেছে, প্রকৃতি ও সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে, মানুষ মেরেছে, নিজে মরেছে। কিন্তু আজ তাদের মাঝে কোনো বিবাদ বিসংবাদ নেই, মারামারি নেই, ঝগড়াঝাঁটি নেই। একই জায়গায় সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে একসাথে সবাই শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। সে দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তাদের কাতারে একে একে আমরাও গিয়ে শামিল হবো!
আগের অংশ
(ডিসেম্বর, ২০১৬) The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|