স্লো অ্যাজ মোলাসেস! আবু এন এম ওয়াহিদ
সম্প্রতি খবরের কাগজে দেখলাম কোরবানির ঈদের সময় বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান তরুণ নাট্যাভিনেতা তাঁর ঈদের বাল্যস্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বলেছেন, আজকাল তিনি গ্রাম বাংলার পথের ধারের চায়ের দোকান এবং গুড়ের চা খুব মিস করেন। তাঁর কথা থেকে বোঝা গেল ঢাকা শহরে এখন গুড়ের চা পাওয়া যায় না। আমি যতদূর অনুমান করি, নামীদামী রেস্তোরাঁয় তো নয়ই, এমন কি রাস্তার পাশের ইটালিয়ান হোটেলেও কেউ গুড়ের চা খুঁজেন না, আর তাই সে সব জায়গাতেও ওই দুর্লভ গরম পানীয়টি আর মিলে না। তাহলে রাজধানীতে বসে গুড়ের চা খাবেন কী করে? অবশ্যই উপায় আছে - কঠিন নয়, বরং এক্ষণই আমি একটি সহজ ব্যবস্থা বাতলে দিতে পারি। ঘরে তো চা পাতা আছেই, বাজার থেকে চিনির বদলে গুড় কিনে আনুন, নিজের ঘরে নিজ হাতে যত্ন করে চা বানান - সুগন্ধি গুড়ের চা! সাধ মিটিয়ে স্বাদের গুড়ের চা আপনি খান, সবাইকে খাওয়ান। ব্যাস লেটা চুকে গেল।
আপনাদের তো একটা তড়িৎ সমাধান দিয়ে দিলাম। এখন আমার উপায়টা কী হবে? আমিও তো গুড়ের চা খেতে চাই। আপনারা বলবেন, সুদূর মার্কিন মুল্লুকে টেনেসি রাজ্যের রাজধানী-শহর ন্যাশভিলে বসে গুড়ের চা খাবেন, এমন আশায় গুড়ে বালি হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি? কেউ নরম-গরম সুরে আরেকটু আগ বেড়ে গিয়ে বলতে পারেন, এত বড় নগরে অন্যরাও যদি গুড়ের চা খায়, তাহলে অবশ্যই কোথাও না কোথাও গুড় পাওয়া যাবে, আর কেউ যদি তা না-ই খায়, তাহলে আপনাকে এমন বস্তুটি খেতে হবে কেন? আর খেতেই যদি চান, তাহলে বাংলাদেশে আসুন, গ্রামে যান, আসুদা হয়ে গুড়ের চা খান। আপনাদের কথাগুলো সবই মানলাম, প্রশ্নটাও যৌক্তিক, কিন্তু এর উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে সামান্য সময় দেবেন? আমি একটু পেছন দিকে ফিরে তাকাতে চাই, মনের দুটো কথা খুলে বলতে চাই, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা, অনুভূতির কথা, আত্মোপলব্ধরি কথা; এখানে বোধ করি খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
উনিশ শ পঞ্চাশ দশকের শেষ এবং ষাট দশকের গোড়ার কথা। ওই সময়ে বাংলাদেশের একটি ছায়াময় মায়াময় পল্লীগ্রামের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। কাজের লোক, অতিথি-মুসাফির, মাস্টার-মৌলবি মিলে আমাদের একান্নবর্তী সংসারটি ছিল অনেক বড়। বাবা স্কুল-শিক্ষক এবং চাচা ইউনিয়ন-চেয়ারম্যান হলেও পরিবারের অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি কৃষিনির্ভর। মাঠেঘাটে কাজের নিমিত্তে বাড়ি ভর্তি ছিল কাজের লোক। এক দল কাজ করত ক্ষেতখামারে, অন্যদের মাঝে কেউ নাও বাইত, কেউ লাকড়ি কাটত, কেউ মাছ ধরত, কেউ আবার একাধিক কাজও করতে পারত। ছেলেছোকরাও ছিল কয়েকজন, তারা গরু, মহিষ, ছাগল চরাত, ফুট-ফরমায়েশ খাটত, ঘর ঝাড়ু দিত, সকাল বিকাল আব্বার হুঁকোটা সাজিয়ে দিত।
রান্নাঘরে একাধিক বাঁধা কাজের মেয়ে-লোক ছিল, তারপরও ফকির-মিসকিন এলে দাদী দরকার বুঝে তাদেরকেও কাজে লাগিয়ে দিতেন। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কাউকে দিতেন মশলা বাটা, কাউকে বাসন মাজা, কাউকে পুকুর থেকে কলসি কাঁখে পানি তোলা আর কাউকে বা ঘর লেপার কাজ। এভাবে তিনি বিনয়ের মা বোন ডেকে সুন্দর করে সময়মত সংসারের কাজগুলো সব তাদেরকে দিয়ে আদায় করিয়ে নিতেন। লেখাপড়া তো দূরের কথা, আমার দাদী নাম-দস্তখতও জানতেন না, তথাপি এত বড় পরিবারের যাবতীয় ব্যবস্থাপনার কাজ তিনি সফলতা, দক্ষতা ও দাপটের সাথে সামলে নিতেন। কাকে দিয়ে কী কাজ কীভাবে করানো যায় সেটা তাঁর চেয়ে ভালো বোঝার মত বাড়িতে আর কেউই ছিল না। বাদলা দিনে ভেজা লাকড়িতে চুলোর আগুনে তেজ হচ্ছে না, রান্নাঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে। কারো কোনো ভাবনা নেই, যত চিন্তা সব দাদীর। তাঁর মাথাটা শুধু সমস্যা-চিন্তার আধার নয়, সকল সমাধানেরও একটি বুদ্ধিদীপ্ত ও কর্মময় কারখানা ছিল। ওই মগজ নিয়ে আজকের দিনে জন্মালে এবং একটি মামুলি কলেজ থেকে এমবিএ করতে পারলে আমার দাদী সহজেই একটি ছোটখাটো কোম্পানি চালাতে পারতেন। আর পিএইডি করতে পারলে তো কথাই নেই, নির্ঘাত তিনি একটি কলেজের ডিন হতে পারতেন। ইদানীং খুব কাছ থেকে দেখছি আমাদের মহিলা ডিন কিভাবে কলেজ চালান।
আমাদের বাড়িতে নারীকর্মীদের নগদ পারিশ্রমিকের কোনো কারবারই ছিল না, তবে কাজের বিনিময়ে দুবেলা পেট ভরে খাওয়া এবং যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের জন্য পোটলা বেঁধে নিয়ে যাওয়াটা ব্যতিক্রমের চেয়ে নিয়মেই পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বেটা-মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বেতনভুক; বংশানুক্রমিক-ভাবে কয়েক জন পেটে-ভাতেও ছিল। বেতন-ছাড়াদের মর্যাদা বেতনওয়ালাদের উপরে ছিল, কারণ তাদেরকে অনেকটা পরিবারের সদস্য হিসেবেই গণ্য করা হত। এই তফাৎটা তারাও বুঝত এবং এর সুবিধাও নিত ষোল আনা। কিভাবে সে কথা এখানে আর নাই বা বললাম। এমনি মর্যাদাবান একজনের নাম ছিল চটর। বয়স বিবেচনায় তাঁকে আমরা চটর চাচা বলে ডাকতাম। কোনো এক অজানা কারণে এক সময় তিনি তাঁর বউ নিয়ে বড় দাদীর পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ টিনের ঘরে আলাদা থাকতেন। সারাক্ষণ হৈহৈ রৈরৈ করা কর্মচঞ্চল বড় পরিবারের ভেতর চটর চাচার নিরিবিলি দুজন মানুষের সংসার ছিল এক অনাবিল শান্তির নীড়! তখনও তাঁরা ছেলেমেয়ের মুখ দেখেননি। ওই সময় মাঝেমধ্যে তিনি আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে আদর করে এ-টা ও-টা খাওয়াতেন।
তাঁদের রান্নাঘরের তৈজসপত্র, খাওয়াদাওয়া ও গরিবি হালতের যে সব বর্ণনা বিদেশ-বিভুয়ে আজ আমার মনে পড়ছে সে সবের তাৎপর্য ও গভীরতার কথা ভেবে ভেবে আমি অবাক না হয়ে পারি না! প্রথমত, চটর চাচার ক্ষুদ্র বাবুর্চিখানার ছোট্ট মাটির চুলোয় যাবতীয় রান্না হত সস্তা দামের মাটির পাতিলে। তাঁর ঘরে অ্যালুমিনিয়ামের বাসন বলতে কিছুই ছিল না। ওই চুলোয় কোনো দিন সফেদ চাল ফুটে ঝরঝরে ধবধবে সাদা ভাত রান্না হত না। আমাকে ডেকে নিয়ে তাঁরা যা খেতে দিতেন তা ছিল বোরো ধানের লাল আতপ চালের আটাল ভাত। ভাতের সাথে শুঁটকি-মাখা লাউয়ের ডগা, নয়তো পাটশাক, অথবা কচুর-লতি আর ভাগ্য ভালো হলে কেচকি মাছের চচ্চড়ি কিংবা কুচো চিংড়ির ঝোল! আহা কী মজা! ভাবতেই জিবে জল আসে! এমন সুস্বাদু খাবার কত দিন পাতে পড়ে না! ঈদ-পর্বে, উৎসবে, বিয়ে-শাদীতে, বাড়িতে মেহমান এলে অথবা গরু-ছাগল জবাই হলে চটর চাচার চুলোয় আর আগুন জ্বলত না। সবার ডাক পড়ত বড় ঘরের বড় রান্নাঘরে - রান্নাঘর তো নয়, এ যেন খাবার তৈরির ফ্যাক্টরি। সেখানে দিনে তিন বেলা বড় বড় চুলোয় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলত। ওই সব জ্বলন্ত উনুনের ফুটন্ত পাত্রের ভাত-ছালুন দিয়ে এতগুলো মানুষের আহারের ব্যবস্থা হত। কে বলে, আগুন দিয়ে আগুন নেভানো যায় না? এক বার ভেবে দেখেছেন, চুলোয় আগুন না জ্বললে পেটের আগুন নিভবে কিসে?
এবার বড় ঘর থেকে ফিরে আসি ছোট ঘরে, চটর চাচার সংসারে। গরীব হলেও চটর চাচার একটি ঘোড়ারোগ ছিল। রোজ সকালে তাঁর চা চাই-ই চাই। ও-ঘরে চায়ের জন্য অ্যালুমিনিয়ামের কোনো কেতলি ছিল না। পানিতে বলক আসত মাটির পাতিলেই। গুঁড়া চা-মিশ্রিত গরম লিকার ছাঁকা হত সফেদ পুরনো কাপড়ের তেনায়। চা খাবার পাত্র ছিল দুখানা মাত্র - একটি গোলাকার মাটির লাল বাটি আরেকটি হাতল-ভাঙ্গা চীনা মাটির কাপ। শুনবেন, সে চা কেমন ছিল? লবণ মেশানো চা! আমার মোটেও ভালো লাগত না। ওই চায়ে চুমুক দিলে রীতিমত বমি আসত। যে দিন ভাগ্য নিতান্তই খুব সুপ্রসন্ন, সে দিন তৈরি হত গুড়ের চা, চটর চাচার ভাঙা ঘরে রাঙা গুড়ের চা আমার কপালে কোনো দিন জুটেছিল কি না পরিষ্কার মনেও নেই - এক আধ দিন খেলে খেয়েও থাকতে পারি। জীবনে প্রথম কোথায় গুড়ের চা খেয়েছি তারই বা নির্দিষ্ট দিনক্ষণ বলি কি করে?
গুড়ের চা, মৃৎপাত্রে রান্নাবাড়া, লাল চালের ভাত, শাকসবজি ও ছোট মাছ ছিল সে যুগের গ্রামীণ সমাজে অভাব অনটনের প্রতীক, দারিদ্রের প্রতিচ্ছবি, আর এ সবই ছিল চটর চাচার অবহেলিত সংসারের অনাকাঙ্ক্ষিত আভিজাত্য! অনাকাঙ্ক্ষিত বলছি এ জন্য যে, এ ছাড়া তো তাঁদের কোনো বিকল্পই ছিল না। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, এ-ই তো তাঁদের নিয়তি! বেচারা কোথায় পাবেন ধাতব-বস্তুর হাঁড়িপাতিল, কে দেবে তাঁকে সফেদ চাল, কোর্মা-পোলাওয়ের উপকরণ, আর কেমন করেই বা তিনি বাজার থেকে কিনে আনবেন দামী ঝরঝরে সাদা চিনি। আভিজাত্য বলার কারণ হলো, যে সব অনুষঙ্গ আমাদের বাড়ির কাজের লোকের নিত্য দিনের উপভোগ্য ছিল সে সব আজ আমি শত ইচ্ছায় শত চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারছি না। আমার কাছে সকলই যেন মহা-দুর্লভ বিলাস-বস্তু, অথচ অতি সহজলভ্য ওই সব কিছুর দিকে সে দিন একবার ফিরেও তাকাইনি, কারণ মাটির বাসন, লাল চাল, গুড়ের চা, ছোট মাছ আর শাকসবজির মর্ম সেদিন আমি জানতাম না। আমি তো না-ই, আমার বাপ-চাচারাও এ সবে কোনো গুরুত্ব দেননি, কতেক অজ্ঞতার কারণে, কতেক তথাকথিত ইজ্জত যাবে বলে!
আর দেননি বলে চটর চাচার পরিবারের বিপরীতে একই সময়ে আমাদের ঘরে শীত গ্রীষ্ম বারো মাস দিনে কমসে কম দুবার তৈরি হত ধবধবে সাদা দুধ-চিনির মিশ্রণে সোনালী রঙের ঘন মিষ্টি চা, দিনে তিন বেলা ইন্দ্রশাইল ধানের সফেদ চিকন সুগন্ধি চাল টগবগ করে ফুটত বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে (কাজের লোকদের জন্য আলাদা এক ডেকচি লাল চালের ভাত থাকত), খাওয়াদাওয়া হত চীনামাটির প্লেটে (কাজের লোক এবং আমাদের মত ছোট ছেলেমেয়েদের খেতে হত টিনের প্লেটে)। সে যুগে এগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত সচ্ছলতার নমুনা ও নিদর্শন। আফসোস, না জেনে নিছক ভাগ্যগুণে চটর চাচা যে সব স্বাস্থ্যসম্মত খাবারদাবার এস্তেমাল করে গেছেন আমার বাবা লেখাপড়া করেও তা করতে পারেননি! তখন না জানলেও আজ আমরা জানি, সাদা দুধ-চিনির চায়ের চেয়ে গুড়ের চা অনেক অনেক গুণে শ্রেয়, অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচির চেয়ে মাটির হাঁড়িতে রান্নাও অধিক স্বাস্থ্যপ্রদ, আর সাদা ভাতের চেয়ে লাল ভাতের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণের কথা কে না জানে? সব শেষে, শাকসবজি ও ছোট মাছ, ভাজা-পোড়া ও তৈলাক্ত খাবারের চেয়ে যে বহু বহু গুণে উৎকৃষ্ট এটাও কি আজ কাউকে বলে বোঝাতে হয়?
এবার আশা করি বিষয়টি খোলাসা হলো, কেন আমি এখানে বসে গুড়ের চা খেতে চাই এবং কেন গুড় খুঁজি, ভালো গুড়, খাঁটি গুড়। এবার চা, চিনি ও গুড় নিয়ে আমার সাম্প্রতিক পরীক্ষা নিরীক্ষার একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিয়ে আজকের এই লেখাটির ইতি টানব। বেশ কিছু দিন আগে থেকেই আমি কফি ছেড়ে চা ধরেছি। তারও কারণ আছে, এ নিয়ে আলাদা একটি লেখার অবতারণা করা যেতে পারে। চায়ের মাঝে লাল চা, সবুজ চা, কালো চা, (সাদা চা বলেও একটি জিনিস আছে যা শরীরের জন্য সর্বোত্তম, কিন্তু অতি দুর্লভ) যখন যা পাই তাই খাই, তবে দুধ-চিনি ছাড়া। স্বাস্থ্যের জন্য এটাই সবচেয়ে উপযোগী ও উপকারী। হলে কী হবে? জিহ্বা বা রসনা বলেও তো একটা কথা আছে। পুরনো অভ্যাসবশত, মাঝে মধ্যে বিশেষ করে ছুটির দিনে দুধ দিয়ে মিষ্টি চা খেতে বড্ড ইচ্ছে করে! এতদসত্ত্বেও বেশ কিছুদিন ধরে সাদা চিনি বিষসম ভেবে আমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি। ধরেছি লাল চিনি, তারপর শুরু করলাম অর্গানিক ব্রাউন সুগার, তারপর খাওয়া শুরু করলাম অর্গানিক ব্রাউন কোকোনাট সুগার। অবশেষে চিনি ছেড়ে খুঁজতে লাগলাম গুড়। আখেরে ভারতীয় এক দোকান থেকে যোগাড় করলাম সাধের গুড়, আখের গুড়।
আমি চেয়েছিলাম ঘন কালো ইক্ষুর গুড় যা আমরা ছোটবেলা খুব মজা করে খেতাম, কিন্তু দোকানে যেটা পেলাম সেটা দেখতে পরিষ্কার সফেদ রঙের, অনেকটা খেজুরের গুড়ের মতন, খুশবুও তেমনই। আমার কেনা তথাকথিত আখের গুড়ের আকার ছিল শক্ত সাবানের গোল্লার মতন। ছুরি দিয়ে কেটে কেটে ঝুরঝুরে করে বৈয়মে ভরলাম। এক দিন গুড় চিবিয়ে খেতে গিয়ে মুখে শক্ত কী যেন অনুভূত হলো। মুখ থেকে বের করে এনে দেখি আমি গুড় খেতে গিয়ে লাকড়ির টুকরো চিবচ্ছি। এর ঠিক পরদিন গুড়ের চায়ের তলানি খেতে গিয়ে টের পেলাম - গুড়ে বালু মেশানো। ব্যাস, সাথে সাথে বৈয়মের সব গুড় বাইরে নিয়ে মেহমানদের খাইয়ে দিলাম। বলাই বাহুল্য, আমার পরিত্যক্ত চিনি ও গুড় খাওয়ার মেহমান হচ্ছে সুলাইমান (আঃ) এর সেনাবাহিনীর ভয়ে যারা পথ ছেড়ে পালিয়েছিল তারা - অর্থাৎ খুদে পিঁপড়ারা।
খাঁটি গুড় পাওয়া না পাওয়ার সমস্যা নিয়ে এক দিন কথা হলো বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে। সে পরামর্শ দিলো, যে কোনো হেলথ ফুড স্টোরে যা, গিয়ে ক্রুড ব্ল্যাক স্ট্র্যাপ মোলাসেস চাইলে পেলে পেতেও পারিস। বন্ধুর কথামত তাই করলাম। Whole Foods - এ গিয়ে যা চাইলাম ঠিক তাই পেলাম। সেলস গার্ল আমাকে শেল্ফ এরিয়াতে নিয়ে দেখিয়ে দিলো মোলাসেসের বোতল কোনটি। আমি কালো কাচের ভরা বোতল হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে উল্টেপাল্টে বুঝতে পারলাম না বোতলের গুড় কঠিন না তরল। তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, It is liquid । মুহূর্তের মধ্যে একটু বুদ্ধি খরচ করে নিজেই বুঝলাম - অবশ্যই তরল, না হলে তো কাচের বোতল ভেঙ্গে গুড় বের করতে হবে, যেটা কোনোক্রমেই হওয়ার কথা নয়। মেয়েটির সাথে কথা শেষ করে ঘাড় ঘুরিয়েই দেখি পেছনে এক জন কৌতূহলী শ্বেতাঙ্গ তরুণ ক্রেতা মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথোপকথন শুনছে। এবার সে মুখ খুলল, বলল, মোলাসেস তরল হলেও ঘন হবে, খুব ঘন - এত ঘন যে, ঢালতে গেলে সহজে বোতল থেকে বের হতে চাইবে না। তারপর মৃদু হেসে দিয়ে আমাকে বলল, Haven't you heard the saying, Slow as molasses! শুনেছি, লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়, কিন্তু আমার সে দিনের গুড় পিঁপড়ায় খেল না, বরং লাভই ধরল। গুড়ের সাথে বিনে পয়সায় একটা কথা শিখে এলাম, Slow as molasses!
(ন্যাশভিল, সেপ্টেম্বর ২০১৭) The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|