ছিন্নমূল মানুষের কথা আবু এন এম ওয়াহিদ
বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছি, অথচ ছিন্নমূল মানুষ দেখিনি কিংবা তাদের কথা শুনিনি, এটা তো হতেই পারে না। এত উন্নয়নের পর, দেশের যে কোনো অঞ্চলে এখনো ঘর থেকে বের হলে গৃহহীন মানুষের দেখা পাওয়া যায়। রেল স্টেশনের প্ল্যাটফরমে, ওভারব্রিজের তলে, শহরের আনাচে কানাচে খাস জমির ওপর গড়ে ওঠা বস্তিতেই প্রধানত তাদের বাস। এদের কেউ কেউ নিছক দারিদ্র-পীড়িত, তবে বেশিরভাগই নদী-ভাঙ্গনের শিকার। বাড়িছাড়া হওয়ার পর তারা চারদিকে এলোপাথাড়ি ছড়িয়ে পড়ে, ভাসমান জীবন যাপন করে, ছেঁড়া কাপড় পরে, জরাজীর্ণ ঝুপড়িতে থাকে, তাদের শরীরে মেদস্ফীতি দেখা যায় না, বদন মলিন হলেও অধিকাংশেরই জীবন তথাকথিত ভদ্রলোকদের চেয়ে কালিমা-মুক্ত।
জীবনসংগ্রামে তারা আর দশ-পাঁচ জনের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী, তেজস্বী ও সাহসী সৈনিক। তাদের মাঝে সব ধরনের মানুষ আছে - কেউ ভিক্ষে করে, কেউ জুতো পালিশ করে, কেউ রিকশা চালায়, কেউ রাজমিস্ত্রির যোগালে হয়, কেউ হাটবাজারে মানুষ জড় করে দাঁতের মাজন বেচে, কেউ পথের ধারে বসে এ-টা ও-টা করে, কেউ টোকাই হয়, কেউ বা আবার পকেট মারে। নারীরা মানুষের বাড়িতে বাড়িতে ছোটা কাজ করে, আয়া-বুয়া হয়, পোশাক কারখানায় মেশিন চালায়, সেলাই করে, তবু বাঁচার লড়াইয়ে হারে না, হার মানতে চায় না। তাদের মাঝে একটি অংশ অবশ্য নগরে-বন্দরে গিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে, কেউ কেউ বেআইনি মাদক-ব্যবসা ও চোরাচালানীর সাথে যুক্ত হয়ে যায়, অনেকে ছোট অপরাধ করে, আবার কেউ কেউ বড় অপরাধগ্যাং-এর সাথেও গা ভাসিয়ে দেয়। সব কিসিমের ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে বাংলাদেশে ইদানীং অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জরিপ হচ্ছে, গবেষণা চলছে, দেশী-বিদেশী টাকায় বাস্তুহারা নারী-পুরুষদের নিয়ে এনজিও-রা ভালো-মন্দ অনেক কাজও করছে। আমি দেশের বাইরে তিন যুগেরও বেশি, তাই এ সবের খবর রাখতে পারি না, এ জন্য এ সমস্যার গভীরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার আজকের বিষয়বস্তুও বাংলাদেশের ছিন্নমূল মানুষ নয়। আমি দু’কথা বলতে চাই উত্তর আমেরিকার নীচুতলার মানুষ নিয়ে, যারা ধনী সমাজে জন্ম নিয়েও কচুরিপানার মত ভেসে বেড়ায়। এদের কথা বলতে গেলে সবার আগে মনে পড়ে কানাডার উইনিপেগের অভিজ্ঞতা। বিদেশের মাটিতে সেখানেই আমি প্রথম ভিক্ষুক দেখেছি। সে অনেক আগে, উনিশ শ’ আশির দশকের একেবারে গোরার দিকে। যাদের কথা বলছি তারা প্রায় সবাই ছিল ন্যাটিভ ইন্ডিয়ান, গায়ে-গতরে লম্বাচওড়া, মোটাতাজা মানুষ। তাদেরকে ডাউনটাউনে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে হাঁটতে দেখতাম, যেন মদ খেয়ে বুঁদ হয়ে আছে, আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় মানুষের ভিড়ে ঢুলু ঢুলু নেত্রে ধীরে ধীরে পা ফেলছে। মনে হত আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিলেই পড়ে যাবে, তবু তাদের দেখলেই ‘ভয়’ পেতাম! কদাচিৎ সামনে পড়ে গেলে হাত বাড়িয়ে বলত, ‘Can you give me a quarter?’ মনে মনে দেওয়ার ইচেছ জাগলেও কোনোদিন পকেটে হাত দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। হঠাৎ আতঙ্কে লাফ দিয়ে তিন হাত দূরে সরে দাঁড়াতাম! তারা ভয়ঙ্কর ছিল না, অপরাধও করত না, তবু কেন তাদেরকে এ-ভাবে ভয় পাওয়া? এ প্রশ্নের উত্তর আজো পাইনি।
এদের নিয়ে আমার আরো কিছু জিজ্ঞাসা সেদিনও ছিল, আজো আছে। সাদা-কালো-বাদামি-তামাটে কত রঙের কত মানুষই তো মিলেমিশে কানাডায় শান্তিতে আছে, কাজ করছে, স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে, জাতিগত-ভাবে কেউ তো এ রকম নেশাগ্রস্ত নয়! শুধু এরা কেন? এর পেছনে রহস্যটা কি? আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ইউরোপ থেকে শ্বেতাঙ্গরা কানাডায় বসবাস শুরুর আগে থেকেই তো এই ন্যাটিভ ইন্ডিয়ানরা এ ভূখণ্ডেই ছিল, তারাই তো বলতে গেলে এ দেশের মূল মালিক, আজ তারা তাদেরই মাতৃভূমিতে অন্যদের মত শহরে-বন্দরে থাকতে পারে না কেন? তারা সংখ্যায় বাড়ে না কেন? তাদেরকে কেন উত্তরের বরফাচ্ছন্ন রিজার্ভে থাকতে হয়? এ সব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর যে নেই নয় তা নয়, আছে বটে, তবে সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে অনেক নোংরা কথা বেরিয়ে আসবে, গোরা সাহেবদের পছন্দ হবে না। ন্যাটিভ ইন্ডিয়ানদের নিয়ে কানাডার বেলা সে সব কথা সত্য, সে সব কথা আমেরিকার বেলা আরো করুণভাবে সত্য! প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সময় পরিকল্পিতভাবে ন্যাটিভ ইন্ডিয়ানদের দফায় দফায় নির্মূল করার চেষ্টা হয়েছে। আমি আজ সে দিকেও যাব না। এ কথা বলতে বলতে মানুষ দেখে ‘ভয় পাওয়া’ নিয়ে একটি মজার গল্প মনে পড়ে গেল। প্রসঙ্গক্রমে আজকের লেখায় টেনে আনতে না পারলে আগামীতে অন্য কোনো সুযোগে আপনাদের গল্পটি শোনাব।
কানাডা থেকে দুনিয়ার সব চেয়ে শক্তিধর ও সম্পদশালী দেশ আমেরিকায় যখন পাড়ি দিলাম তখন গরিব মানুষদের দেখতে পেলাম অন্য রূপে। ধনী দেশের ফকির, তারা কেবলই একটি ‘কোয়ার্টার’ চায় না, তাদের প্রত্যাশা আরো বেশি। তারা টাকা চায়, তাগড়া টাকা। তাদেরকে ডাউনটাউনের খোলা জায়গায়, পার্কে গাছের ছায়ায় শুয়ে-বসে থাকতে দেখি। কেউ ভিক্ষে চায় কেউ চায়ও না, কি চায়? আমরা কেমন করে জানব, হয়তো বা তারা নিজেরাও জানে না! আবার কেউ চৌরাস্তার মোড়ে স্টপ-লাইটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষের কাছে হাত পাতে। আরেকটি জায়গা তাদের খুব প্রিয়। মহাসড়ক থেকে একজিট নেওয়ার পর স্থানীয় রাস্তায় মোড় নেওয়ার আগেই তারা গাড়ির চালকদের নিশানা করে। এ রকম জায়গা ভিক্ষাবৃত্তির জন্য কেন এত উপযোগী? এটা আমার মাথায় আসে না। প্রতিটি গাড়ি থামলেই তারা আশা করে জানালার কাচ নামিয়ে গাড়ির চালক কিংবা যাত্রী কেউ তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবে। আমি প্রথম প্রথম দিতাম, আজকাল আর দেই না, তাদের দিকে ফিরেও তাকাই না, কারণ সবাই বলে, এদের অধিকাংশই নাকি মাদকাসক্ত। কিছু খবর নিয়েও দেখেছি, ঘটনা সত্য। তার মানে এই নয় যে, তাদের মাঝে সাহায্যের ন্যায্য দাবিদার খাঁটি মিসকিন কেউ নেই, অবশ্যই আছে, কিন্তু তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য, তাই বড় সমস্যা হলো, এত নকলের মাঝে আসল বাছাই করি কি করে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এত সরকারি বেসরকারি সামাজিক নিরাপত্তা-বলয় থাকার পর এভাবে কাউকেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করার কথা নয়। যারা করে ‘অভাব’ তাদের আসল কারণ নয়, বরং ‘স্বভাব’ তাদের মূল সমস্যা। তাদের ‘স্বভাব’-ই বা এমন কেন? সে-ও তো এক মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর যাই হোক, এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের কারোরই তেমন কিছু করার নেই। তাই তাদের নিয়ে আজকাল আর ভাবি না, এ রকম একটি লেখার কথা চিন্তাও করি না। তারপরও কেন আজ লিখতে বসেছি? এ কথাটি বলার জন্যই এত আয়োজন, এত বড় ভূমিকা - এ যেন খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি!
সম্প্রতি একদিন বিকেল বেলা আপিস থেকে বাড়ি ফিরছি। বাড়ির কাছে এসে মহাসড়ক থেকে একজিট নিয়ে ছোট রাস্তায় মোড় নেওয়ার জন্য স্টপ-লাইটে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় বাঁ দিকে চোখ ঘোরাতেই দেখা পেয়ে গেলাম এক ছিন্নমূল পরিবারের। মাঝবয়সী এক জন পুরুষ - দেখতে মেক্সিকান মনে হলো, হাতে একটি হার্ডবোর্ডের কাগজে একটি সুন্দর স্লোগান লিখে থমকে যাওয়া ট্র্যাফিকের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত ছিন্নমূল মানুষরা যে সব আবদার নিয়ে পথের ধারে মানুষের কাছে সাহায্য চায় সেগুলো একটু অন্য রকম, যেমন: ‘Homeless - need help’; ‘Hungry , please help’, ‘Homeless, hungry’, ‘No place to live, anything will help’, ‘House burned, please give something’, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমার আজকের শেষ-বেলার গল্পের নায়ক গতানুগতিক কোনো স্লোগান নিয়ে ভিক্ষে চাইতে আসেনি। তার বক্তব্য আরো সুন্দর, আরো ভাবনা-প্রসূত, আরো গভীর অর্থপূর্ণ! সে লিখেছে, ‘Living on grace!’ ব্যাস, আর কিছু না। সাথে তার পরিবারের আরো তিন জন সদস্য। এক জন নারী - সে তার স্ত্রী হতে পারে, হতে পারে মেয়েবন্ধু; আর দু’টো কুকুর- একটি ঘন সবুজ ঘাসের গালিচায় গা এলিয়ে দিয়ে আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে, আরেকটি মাটিতে কোমর গেড়ে সামনের দু’পায়ের ওপর ভর করে বসে আছে; নড়াচড়া নেই, অস্থিরতা নেই, মুখে ঘেউ ঘেউ আওয়াজও নেই; করুণ নেত্রে পলকহীন দৃষ্টিতে দিনের শেষে ঘরফেরা মানুষদের দিকে চেয়ে আছে; কেউ কি তার প্রভুর হাতে একটি টাকা তুলে দেবে? বোধ করি মুখে ভাষা থাকলে সে বলেই ফেলত, দাও না ভাই, একটি টাকা, তোমার কাছে যা কিছুই না, আমাদের কাছে তা-ই তো বাঁচার একমাত্র অবলম্বন!
তাদের ভাসমান সংসারের মালপত্তর বলতে যা আছে তার পুরোটাই একটি ব্যাক প্যাকের মধ্যে সযত্নে ভরে রাখা। লোকটি যখন ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যস্ত, মহিলাটি তখন ঘাসের ওপর বসে সাংসারিক কাজ করছে। সুই-সুতো দিয়ে ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাকপ্যাকটি সেলাই করছে, সাবধানে, কিন্তু অতি দ্রুততার সাথে, কারণ শেষ বিকেলের হেলে পড়া সূর্য যে কোনো মুহূর্তে দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যাবে, আস্তে আস্তে চারদিকে অন্ধকার মেনে আসবে, তার আগে সেলাইয়ের কাজ সেরে তাকে উঠতে হবে। তারপর কি? বোধ করি সেও জানে না, তার সঙ্গীরাও জানে না। জানেন শুধু এক জনই, সেই ‘মহাজন’ যিনি ‘অগতির গতি, অনাথের নাথ’, ‘খাইরুর রা’জেকিন’! যে নারী ঘাসে বসে সেলাই করছে তার চোখেমুখে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছায়া স্পষ্ট ধরা পড়ছে, কিন্তু এটা কি কারণে, তা বলা মুশকিল! হতে পারে এ জন্য যে, রাতে যাবে কোথায়? খাবে কি? থাকবে কোথায়? তার পরেও বা ভাগ্যে কি লেখা আছে? সবই তো অনিশ্চিতের অন্ধকারে নিমজ্জিত! আবার এ-ও হতে পারে যে, দিবসের আলো মিলিয়ে গেলে ব্যাকপ্যাক মেরামত হবে না, ছেঁড়া ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে গেলে সংসারের শেষ সম্বলটুকু ফুটো দিয়ে একে একে গড়িয়ে পড়বে রাস্তায়, এ-দিক ও-দিক। চিন্তাচ্ছন্ন এই ছিন্নমূল মানুষের মুখ এবং কুকুরটির করুণ চাহনি দেখলে শিল্পী জয়নুল কিংবা কামরুল আঁকতে পারতেন চমৎকার মাস্টারপিস!
আমি এই হতভাগা পরিবারের মুখোমুখি ছিলাম বড় জোর চল্লিশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট। ইতিমধ্যে ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলো সবুজ হয়ে গেল, সবার সাথে আমারও গাড়ির চাকা সামনে ঘুরতে লাগলো, ক্লান্ত দেহে গোধূলীবেলায় বাড়ির দিকে এগোচ্ছি আর ভাবছি, নিজের খাবার ব্যবস্থা নেই, থাকার জায়গা নেই, ডুবে আছে অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকারে, অথচ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে কুকুর - তাও আবার একটি নয়, দু’টি! মাত্র ক’দিন আগেই এক জন বৃদ্ধ ট্যাক্সি চালক বলেছিলেন, তাঁর ছেলেরা তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন। এখন দু’টো কুকুরই তাঁর সঙ্গী, যেন এরাই তাঁর সন্তান! এ সব কথা গভীর দীর্ঘশ্বাসের সাথে ঘন আবেগ-মাখা কণ্ঠে বেরিয়ে এলো ভদ্রলোকের মুখ থেকে! কি অদ্ভুত দেশ! কি আজব সমাজ! মূল্যবোধের কি অবক্ষয়! মানবের পরিণতি তো এমন হওয়ার কথা ছিল না! আরো ভাবছি, ‘Living on grace!’ বলে ভিক্ষুকটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, সে হয়তো বা মানুষের করুণায় দু’মুঠো খাবার পায়, কিন্তু আমরা যারা চাকরি করে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছি, আমরাও তো ‘আরেক জনের’ করুণাতেই বেঁচে আছি! তাই নয় কি? এমনি করে ভাবতে ভাবতে অবচেতন মনে হঠাৎ মাথার ওপরে ‘ডোর ওপেনার’-এ হাত পড়ল, কড়কড় শব্দে খুলে গেল গ্যারাজ ডোর।
The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
পুনশ্চ: লেখাটির শিরোনামের নীচে দেওয়ার জন্য ইন্টারনেটে একটি যুতসই ছবি খুঁজতে গিয়ে হাজারো গৃহহীন মানুষের ভিড়ে এ ছবিটিও চোখে পড়ল, তাই আপনাদের খেদমতে পেশ করলাম। ছবির কথা ছবিই বলছে, মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন! দেখুন, পড়ুন এবং ভাবুন!
|