পথে যেতে যেতে আবু এন. এম. ওয়াহিদ
এবার তাইপে যাওয়ার আগে নানা কারণে মনটা পেন্ডুলামের মতন দোটানায় দুলছিলো। যাব কি যাব না, যাব কি যাব না করতে করতে যাওয়ার দিনক্ষণ যখন চলেই এলো তখন ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। এয়ারপোর্ট পৌঁছে শুনি, বৃষ্টি-ভেজা বাতাসে এলান ভেসে আসছে - আবহাওয়া-জনিত কারণে ফ্লাইটে বিলম্ব হবে। সফরের সময় এমন অভিজ্ঞতা কারও জীবনে নতুন কিছু নয় - আমার তো নয়-ই, তবে বলতেই হয়, যাত্রাপথের শুরুতে এবারের ওই অঘটনটি ছিল ভিন্ন মাত্রার। হিসেব করে দেখি, ওয়াশিংটন ডিসি গিয়ে ইস্তাম্বুলের সংযোগ-ফ্লাইট না পাওয়ার আশঙ্কা আমার অতি উজ্জ্বল! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ! বুঝলাম, ঘর ছাড়লেও মনের দোদুল্যমানতা সহসা আমার পিছু ছাড়ছে না। এ বার করি কী! আগুপাছু না ভেবেই মনস্থির করে ফেললাম, সুদূর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা যখন বাড়িয়েছি, তো সামনেই যাব। আল্লাহ ভরসা - দেখি কপালে কী লেখা আছে। এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ একাধিক অজুহাতে আরও দেরি করল, অবশেষে বিমান আকাশে উড়ল, আমার আশঙ্কা রীতিমতো আতঙ্কে রূপ নিল! তথাপি, মনের অস্থিরতা ও হতাশা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মেনে নিলাম, ওয়াশিংটনে হোটেলেই রাত কাটাব, পরে ফ্লাইটের নয়া সময়সূচীর কথা চিন্তা করা যাবে। শুভ বলব না অশুভ বলব - জানি না, তবে এমন যাত্রা এর আগে আমি কখনও করিনি।
উড়োজাহাজে উঠে দেখি, আমার ডান পাশে বসে আছেন সুপুরুষ এক কৃষ্ণকায় ভদ্রলোক। তাঁর সাথে পরিচয় হলো, কথা হলো। তিনি এক জন কঙ্গোলিজ-আমেরিকান - হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগে চাকরি করেন। আমার মতন দীর্ঘ পথের পথিক। আদ্দিস আবাবা হয়ে কিনসাশা-র দিকে রওয়ানা দিয়েছেন। আমার পথের সাথী বেশ সদালাপী, এ-কথা সে-কথা অনেক কথাই বললেন। এক পর্যায়ে এই বলে আফসোস করলেন, কঙ্গোর রাজনীতিবিদরা ভীষণ দুর্নীতিবাজ, পানির দরে ওদের কাছে আমাদের ভূগর্ভস্থ সব হীরে বিক্রি করে দিচ্ছে। ওরা কারা, তা আমি জানি, তাই পাল্টা প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করতে চাইনি। আমি ইস্তাম্বুল হয়ে তাইপে যাচ্ছি শুনে আমার কাছে তিনি এক অভিনব আবদার করে বসলেন, বললেন, আজ হোক কিংবা কাল হোক, যাবার পথে এরদোয়ান-কে আমার শুভেচ্ছা দিয়ে যাবেন, যা মনে হচ্ছে, তিনিই আমাদের শেষ ভরসা। মুহূর্তের জন্য হলেও নিজের কথা ভুলে গিয়ে সুদূর কঙ্গো থেকে আসা ওই ক্ষণকালের বন্ধুর কথা ভাবতে লাগলাম, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান - নিজের দেশের নাগরিকরা তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মূল্যায়ন করে। কারও কাছে তিনি মৌলবাদী, কেউ তাঁকে স্বৈরশাসক বলে মনে করে, তাঁর দলের বিবেচনায় তিনি তুরস্কের রোল মডেল - দ্বিতীয় আতা-তুর্ক, অথচ কী আশ্চর্য, এক জন দূর পরদেশির কাছে তিনি আশাভরসার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন! একটি কথা চালু আছে, রাজা রাজ্যে পূজনীয়, জ্ঞানী সর্বত্র। কথাটা বোধ করি, সর্বৈব সঠিক নয়। যে কোনও দেশের জাতীয় নেতা/নেত্রীর যখন রাষ্ট্রনায়ক-এ উত্তরণ ঘটে তখন তাঁকে নিয়ে জনমানুষের স্বপ্ন বোনা নিজ দেশের চৌহদ্দিতে আর সীমাবদ্ধ থাকে না। তিনি মনের অজান্তে বিদেশিদেরও আশার আলো দেখান, হয়ে ওঠেন তাদেরও প্রাণপুরুষ! একই ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমেরিকার ৪৪ নং প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেইন ওবামা-র বেলায়ও। তিনিও নিঃসন্দেহে এক বিরল ও বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী! আমার মনে আছে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় বার আমি তাইওয়ান গিয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক তাইওয়ানী ছাত্র। আমাকে পেয়ে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাগর যেন উথলে উঠলো! ওবামাকে নিয়ে তার উত্তেজনা, কৌতূহল ও স্বপ্ন-বিলাস দেখে আমি বিস্মিত ও অভিভূত না হয়ে পারিনি! মনে হলো, ওবামা যেন তারই প্রেসিডেন্ট, সেই যেন ভোট দিয়ে বানিয়েছে!
এ সব ভাবতে ভাবতে ওয়াশিংটন - আইএডি এয়ারপোর্টে বিমান অবতরণ করল, আমি বেরিয়েই দৌড়তে শুরু করলাম ইস্তাম্বুল-ফ্লাইট ধরব বলে। সময় দেখলাম, আমার হিসেবে এতক্ষণে বোর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, যে কোনও সময় বিমানের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি জানি, এক বার ওই দুয়ার বন্ধ হলে দেওয়ালে মাথা মারলেও - কপাল খুলবে না, কপাটও খুলবে না। হাফাতে হাফাতে এয়ারলাইন্স অফিসে ফোন করলাম, বাড়িতে আমার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে কথা বললাম - কোনও ভাবে কিছু করা যায় কি না। কেউ আমাকে আশার বাণী শোনাতে পারল না, তবু আমি দৌড়চ্ছি, দেওয়ানা হয়ে দৌড়চ্ছি, নিরাশার মাঝে যেন আশার আলো দেখছি। এমন সময় ক্ষীণ কণ্ঠে দূর থেকে আওয়াজ ভেসে এলো - ΤIstanbul - final call - Gate B-43. আমি আর দৌড়তে পারছিলাম না, হাত তুলে চিৎকার করলাম, B-43, B-43. ঘোষণাকারী কর্মচারী আমায় দেখতে পেলেন, আমি স্বস্তির সাথে চলার গতি কমিয়ে দিলাম। ভাবলাম, বাহ, কাজ হয়ে গেছে! চেক-ইন ক্লার্ক আমাকে নতুন বোর্ডিং পাস দিলেন। আমি বললাম, আমি তো এলাম, আমার লাগেজের কী হবে? উত্তর এলো, ওটা এসে গেছে, তোমার বদন মোবারক না দেখে তো আমরা তোমার সুটকেস তুলতে পারি না, তাই অপেক্ষা করছি। আমার আগে আমার সামান কী করে এলো, তাৎক্ষণিক সে কথা ভাবার ফুরসৎ পাইনি। তবে সম্বিত ফিরে পেলে অনুধাবন করলাম, আমার বাক্সের গতি যদি আমার থেকে বেশি না হতো, তা হলে ওই ফ্লাইট ধরতে না পারা আমার জন্য অবধারিত ছিল।
এ বার টার্কিশ এয়ারলাইন্সের ড্রিম লাইনার-এর পেটের ভেতর ঢুকে আরেক নতুন অভিজ্ঞতা হাসিল করলাম - যেন দেখতে পেলাম, স্বপ্নের মতন সুন্দর এক পৃথিবী! উড্ডয়নের দুঘণ্টার মাথায় রাতের খাবার সবেমাত্র শেষ হয়েছে, দেদারসে চা-কফির এস্তেমাল হচ্ছে, ঘুমের আগে যাত্রীদের মধ্যে ফিসফাস কথাবার্তা চলছে। কেউ পার্সোনাল স্ক্রিনে মুভি দেখছে, কেউ গেম খেলছে। আমি মাঝখানের সারিতে ডানদিকের প্রান্তিক আসনে বসেছি। আমার ডানে উন্মুক্ত চলার পথ, তার পরের আসনে লাল জ্যাকেট পরে বসে আছে ছ-সাত বছরের ফুটফুটে এক কৃষ্ণকায় বালক। তারই কাতারে আরও দু জন সাদা লোক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, ছেলেটির মা-বাবা কেউ কাছে নেই। ভাবছি, অবুঝ বালক একাই বুঝি ছুটছে তার আপন গন্তব্যে। কোন দেশে কোথায় যাচ্ছে, কে জানে! আরও খেয়াল করলাম, যাওয়া-আসার পথে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা ছেলেটিকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, কপালে চুমু খাচ্ছেন, ক্যান্ডি এনে দিচ্ছেন। পাশের সিটের সহযাত্রীরাও দেখলাম তার প্রতি খুব সহানুভূতিশীল, আদর করে কথাবার্তা বলছেন, ছেলেটার সাথে হালকা কৌতুক করছেন, হাসাচ্ছেন, তাকে খোশমেজাজে রাখার কোশেশ করছেন। ততক্ষণে আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে, এয়ারলাইন্স ছেলেটিকে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছে। এবার আমি মুখ বাড়িয়ে বালকটির সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। আমাকে বলল, তার নাম ম্যাকি, সে একা একা ওয়াশিংটন থেকে ইউয়ান্ডে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, ইউয়ান্ডে কোথায়, উত্তর দিল, আফ্রিকায়। কোন দেশে, তা বলতে পারল না। আমিও জানতাম না। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টও বলতে পারলেন না, শহরটি কোন দেশে। পরে জানলাম, ইউয়ান্ডে ক্যামেরুনের রাজধানী। আমার মূল কথাটি তুলে ধরার জন্য এখানে অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে আনতে চাই। পশুর সাথে মানুষের যেমন মিল আছে তেমনি তফাৎও আছে। মানুষ যেমন তার সন্তানকে ভালোবাসে পশুও তো তার বাচ্চাকে মায়ামমতায় লালনপালন করে। এ তো গেল একটা দিক। অন্য দিকে মানুষ তার নিজের সন্তানকে যেমন আদর করে তেমনি অন্যের সন্তানকেও আদর করে। কিন্তু পশু-পাখির বেলা প্রথমটা সত্য হলেও দ্বিতীয়টা তারা মানে না। তাই তারা ইতর প্রাণী আর আমরা মানুষ। ম্যাকির সাথে সবার এই আচরণ আমার কাছে স্বপ্নের মতই লাগছিল। মনে হয়েছিল - চারদিকে এত হিংসা-বিদ্বেষ, এত মারামারি, এত হানাহানি সত্বে-থও মানুষের মাঝে মমত্ব-বোধ এখনও আছে, মনুষ্যত্ব-বোধ পুরোপুরি মরে যায়নি। এ যে এক তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক অভিজ্ঞতা!
দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা এক নাগাড়ে ওড়ার পর ড্রিম লাইনার যখন স্বপ্ন-জগৎ ছেড়ে মাটির ধরায় নেমে এলো। তখন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সহযাত্রীদের কাফেলায় লম্বা হলওয়ে ধরে হাঁটছি তো হাঁটছি। ডানে-বাঁয়ে বাইরের পরিবেশ দেখে এক আচানক অনুভূতি হলো! রীতিমতো এক ধন্দে পড়ে গেলাম! আমার দৃষ্টি ও আমার মন বলছে - এটা ভোরবেলা, যেন অন্ধকার গোলাকার পথ পেরিয়ে পূব আকাশে মাত্র সূর্য উঠেছে! কিন্তু ঘড়ি বলে সন্ধ্যাবেলা! সন্ধ্যাবেলা কেন আমার চোখে ভোর হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে! পূব আকাশে উদীয়মান সূর্যের আলোকচ্ছটা ও পশ্চিম গগনে অস্তগামী রবির কিরণ কি একই রকম দৃশ্য তৈরি করে? না, কক্ষনও না। তবে আমার মাঝে কেন এই দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে? এমন তো কখনও কোথাও হয়নি। আজ ইস্তাম্বুল কেন আমাকে এ ভাবে বোকা বানাচ্ছে, কেন ধোঁকা দিচ্ছে! ভাবতে ভাবতে সূর্য ডুবেই গেল, অন্ধকার নেমে এলো। আমার মনের গোলমেলে ভাবও দূর হয়ে গেল। কিন্তু ভাবনার তো শেষ নেই, আমি খুঁজতে খুঁজতে ভোরবেলা ও সন্ধ্যাবেলার অন্তত একটি দৃশ্যমান পার্থক্য বের করলাম। বলব সেটা - কী? শুনুন তা হলে - সকালের পাখি দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনা, চঞ্চলতা ও উচ্ছলতা-সহ কিচিরমিচির আওয়াজ করে নীড় থেকে বেরিয়ে যায় খাবারের অন্বেষণে। সন্ধ্যাবেলার পাখি ভরা পেটে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিষণ্ণ মনে নিঃশব্দে নীড়ে ফিরে! কেন এমন হয়, জানি না, তবে আপনারা নিশ্চয়ই সকাল-সন্ধ্যার ছবি এ ভাবে অবলোকন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে এখন একটি মজার গল্প বলি - এক ভদ্রলোকের বৈঠকখানার দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা হাতে আঁকা একটি ছবি টানানো ছিল। ছবিটিতে শিল্পী ধারণ করেছেন, দিগ্বলয়ে ডিমের কুসুমের মতন একটি লাল সূর্য ও তার পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। কেউ বলছেন এটা সূর্যোদয়ের ছবি, কেউ বলছেন সূর্যাস্তের। এ বিতর্ক যখন থামছেই না তখন আরেক জন বলে বসলেন, আমি সহজেই এ সমস্যার ফয়সালা করে দিতে পারি। সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, বলুন দেখি - এটা কী? তিনি উত্তর দিলেন - এটা অবশ্যই সূর্যাস্তের ছবি। কী করে আপনি এত নিশ্চিত হলেন? বাকি সবার প্রশ্ন! এ বার দেখুন, তিনি কী বলে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন, যে শিল্পী ছবিটি এঁকেছে তাকে আমি ভালো করে চিনি। সে দুপুর বারোটার আগে কোনও দিন ঘুম থেকে ওঠে না। শোনে সবাই হেসে দিলেন, বিতর্কের অবসান হলো।
কিন্তু আমার দেখারও শেষ নেই কৌতূহলেরও শেষ নেই। এ পর্যন্ত আমি ইস্তাম্বুল নতুন এয়ারপোর্ট দিয়ে চার বার যাওয়া-আসা করেছি। একেক বার একেক ফটক দিয়ে আমাদের উঠানো-নামানো হয়। এখনও আমি এর আগা-মাথা কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারি না, কারণ একবিংশ শতকের ইতিহাসে বিশ্বের বৃহৎ স্থাপনাগুলোর মাঝে এটি অন্যতম। এর নির্মাণ-ব্যয় ১২শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ষাট শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ পূর্ণ হলে, এটা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অন্যতম। টার্কিশ এয়ারলাইন্সও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবহন সংস্থার একটি। এর বিমানবহর দুনিয়ার ৩০০ গন্তব্যে দিন-রাত অনবরত যাত্রী আনা-নেওয়া করে, অন্য কোনও এয়ারলাইন্সের যাত্রী-সেবা বিশ্বব্যাপী এত বিস্তৃত নয়। তুরস্কের এই বিমানবন্দর ও তার এয়ারলাইন্সের পক্ষে এত সব গৌরব অর্জন সম্ভব হয়েছে যে সব কারণে তার অন্যতম হলো, ইস্তাম্বুলের বিশেষ ভৌগলিক অবস্থান। পূর্ব-পশ্চিম এখানে এসেই এক জায়গায় মিলিত হয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তাদের ইতিহাস এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ইস্তাম্বুলের ইতিহাসের পাতায় পাতায় পাওয়া যায় জুডিও-খ্রিস্টান-মুসলিম ঐতিহ্যের নরম-গরম-কোমল পরশ। এখানে সভ্যতার সংঘাত হয়েছে বার বার। ইস্তাম্বুলের ইতিহাস পূর্ব-পশ্চিমের লড়াইয়ের ইতিহাস, তাদের জয়-পরাজয়ের স্পর্শকাতর কাহিনীর ইতিহাস। তাই তো ঐতিহাসিক এ শহরের প্রতি পৃথিবীর সব জাতির সব মানুষের মাঝে বিশেষ করে পর্যটকদের মধ্যে বাড়তি আগ্রহ ও কৌতূহল দেখা যায়। পর্যটক না হলেও আমিও এর ব্যতিক্রম নই।
যেহেতু হাতে অনেক সময় ছিল তাই, ঘুরে ঘুরে এয়ারপোর্টের বিভিন্ন কনকোর্স ও সেখানকার নানা জাতের আকর্ষণীয় কর্মচাঞ্চল্য দেখছিলাম। দেখছিলাম কেন্দ্রীয় এলাকার দোকানপাটের রূপ-মাধুর্য ও চাকচিক্য। একেক প্রতিষ্ঠানের একেক বৈশিষ্ট্য। কোনও দোকানে দেখা যায় কেবলই বর্ণালী আলোর ঝলমলানি। কোনও দোকানে দামী দামী কাপড়চোপড় ও সাজসজ্জার বাহার। কোনও বিপণন কেন্দ্র থেকে বানের মতো বাতাসে ভেসে আসে সুগন্ধি খুশবুর বন্যা। সোনাদানার দোকান নিজেই অলঙ্কার হয়ে গোটা টার্মিন্যাল ভবনের শ্রী বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে। রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে গেলে নানা জাতের মজাদার খাবারের সুবাস পাওয়া যায়, যা কিনা ভরা পেটেও খিদের আগুন ধরিয়ে দেয়। এখানে এলেই দেখতে পাওয়া যায় দুনিয়ার যাবতীয় সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের এক স্বর্গীয় মিলন-মেলা। হাঁটতে হাঁটতে এই সব দেখছি আর ভাবছি, এত কিছুর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মন-জুড়ানো ও চমকপ্রদ আকর্ষণ কী, বা কোনটি? অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে বের করলাম - সব সুন্দর ও সব বৈচিত্র্যের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ-এর অবস্থান, অন্য কোনও কিছু নয়! নানা রঙের, নানা ঢঙের, নানা বয়সের, নানা ধর্মের, নারী-পুরুষের প্রাণচাঞ্চল্যের মিলিত স্রোতধারাই সবচেয়ে সুন্দর! বলা যায়, সবার উপরে মানুষ সুন্দর তাহার উপরে নাই! বৈচিত্র্যে ভরা বুদ্ধিমান মানুষ যদি সবচেয়ে সুন্দর হয় তা হলে যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, আহা! না জানি তিনি কত সুন্দর!
ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্ট দেখতে দেখতে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন বিশ্রামের জন্য এসে আশ্রয় নিলাম টার্কিশ এয়ারলাইন্স-এর মাইল্স অ্যান্ড স্মাইল্স লাউঞ্জে। এই লাউঞ্জ বিশাল বড়। এখানে এক সাথে ৩/৪ শ অতিথির অকৃপণ আপ্যায়ন চলে। তারা খায়দায়, বিশ্রাম নেয়, ঘুমায়, গান শুনে, সিনেমা দেখে, উপাসনা করে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করে, প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলে, আরও কত কিছু! খোলা চত্বরে তিনতলার উপরে এর অবস্থান। আরও অনেক কিছুর সাথে এই লাউঞ্জে বড় বড় দুটো কফি কর্নার আছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে শুরুতেই এক কাপ টার্কিশ কফি দিয়ে শুরু করি। কারুকার্য করা ছোট ছোট কাপ-পিরিচে পরিবেশন করা হয় ঘন কালো ফেনায়িত কফি। আয়েস করে বসে কফি খেতে খেতে বাংলাদেশে আমার শ্যালককে ফেসবুক মেসেঞ্জারে ছবি-সহ একটি ক্ষুদে বার্তা দিলাম। আমার এক মাত্র শালা আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বলল, দুলাভাই, টার্কিশ কফি খেতে কেমন? সংক্ষেপে উত্তর দিলাম, টার্কিশ কফির স্বাদ নির্ভর করে তুমি কীভাবে খাও তার ওপর। যদি দুধ-চিনি মিশাও তাহলে মিষ্টি লাগবে। কিন্তু আমি এতে কিছইু মিশাই না, তাতে জিবে খুব তিতা লাগে, কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে গেলে ওই তিতা স্বাদ আর তিতা থাকে না, হৃদয়ে মিষ্টি-মধুর পরশ বুলিয়ে দেয়। এই সুযোগে শালা সাহেবকে একটি উপদেশও শুনিয়ে দিলাম। If you want to make your life sweet, better be used to bitter taste.
অন্যবারের মতো এবারও লাউঞ্জে খেয়েদেয়ে শুয়ে-বসে আয়েসে সময় কাটিয়ে দিলাম। স্থানীয় সময় রাত দুটায় আবার গিয়ে ঢুকলাম বিমানের পেটের ভেতর। এ বার চূড়ান্ত গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু। ইস্তাম্বুল থেকে তাইপে। আরও ১০ ঘণ্টা উড়তে উড়তে রাত গেল, দিন পার করে সন্ধ্যায় গিয়ে নামলাম তাইপে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। ইমিগ্রেশন সেরে যখন লাগেজ তুলতে গেলাম। তখন ক্যারুজেলে বেল্ট ঘুরছে তো ঘুরছে, একে একে সবার বাক্সপ্যাটরা চলে এলো, কিন্তু আমার সুটকেসের দেখা মিলল না। এলো না তো এলোই না। বেল্ট বন্ধ হয়ে গেল, সবাই চলে গেল। আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত, নির্বাক, হতবাক! আমার অবস্থা দাঁড়ালো: .....শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী!
আমাকে ওয়াশিংটনে বলা হলো, আমার সুটকেস আমার সাথেই আসছে, কিন্তু তা তো এলো না। কেন, কী কারণে, কর্তব্যরত কর্মচারীরা কেউ এর কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারল না। তাহলে কি তারা আমাকে মিথ্যা বলেছিল? তাই বা বিশ্বাস করি কী করে? মন খারাপ করে শুধু এক কাপড়ে ক্যারিঅন কাঁধের ব্যাগ নিয়ে হোটেলে চলে এলাম। আসতে আসতে ভাবলাম, যে সুটকেস আমাকে ওয়াশিংটনে ফ্লাইট ধরিয়ে দিল, তাকে পেছনে ফেলে আমি একা চলে এলাম। ব্যাপারটা কেমন হলো। ২৪ ঘণ্টা পর দেখলাম, আমার সুটকেস পথহারা পথিকের মতো পৃথিবী নামক গ্রহকে পুরো এক চক্কর মেরে অবশেষে অক্ষত অবস্থায় আমার হাতে এসে পৌঁছলো। কিন্তু ভোগান্তি যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল! কেন হলো, আল্লাহ মালুম! এই সফরে, আমার সুটকেস আমার সাথে তিনবার মশকরা করল। প্রথম দুবারের কথা আপনারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। এবার বলি শেষ বারের কথা। তাইপে-তে যে সুটকেস সবার শেষেও এলো না। সেই সুটকেস ফিরতি পথে ন্যাশভিলে সবার আগে এসে হাজির। লাগেজ নিয়ে তাইপে যেমন ছিল আমার জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি ন্যাশভিলের ক্যারুজেলে সবার আগে আমার লাগেজের আগমনও ছিল আমার জীবনের আরেকটি নতুন অভিজ্ঞতা!
ফিরে আসি তাইপে-র কথায়। শীতকাল বলে এবার যাওয়ার সময় একটা ফুল হাতা উলের সুয়েটার সঙ্গে করে নিয়েছিলাম। সুয়েটারটার সামনে বুকের বাঁ দিকটায় পোকায় কেটে একটা ফুটো করে ফেলেছে। ভাবলাম, ধারে কাছে যদি কোনও দর্জির দোকান পাই তাহলে এটা মেরামত করিয়ে নিতে পারি। পর দিন সকাল বেলা দোকানপাট খুললে ওই সুয়েটার গায়ে দিয়ে বেলা ১০টার দিকে বের হলাম। একে একে অনেক দোকানে গেলাম, লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, Is there any tailor shop nearby? আশ্চর্য হলাম, Tailor কী, কেউ জানে না, কেউ বুঝে না! বিভিন্ন ধরনের অঙ্গভঙ্গি ও অভিনয় করেও কাউকে বোঝাতে পারলাম না, Tailor কী, সে কী করে। তারা Tailor চিনে না, আমি জানি না, তাইওয়ানী ভাষায় Tailor মানে কী। অবশেষে এক ব্যাঙ্কে গিয়ে ঢুকলাম। এক জন তরুণ অফিসার কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমার আবদার তাকে জানালাম। তিনি বুঝলেন, কিন্তু আশেপাশে দর্জি-দোকানের এর দোকানের কোনও সন্ধান দিতে পারলেন না। আমি নিরাশ হয়ে হোটেলে ফিরে আসব এমন সময় শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে অন্য এক দোকানির দ্বারস্থ হলাম। অনেক যত্ন করে তাঁকে বোঝালাম, আমি কী চাই। মনে হলো, তিনি আমার কথা বুঝলেন। আমাকে ইশারায় বললেন, তাকে অনুসরণ করতে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, অবশেষে দর্জি পাওয়া গেছে। তিনি আমাকে বিল্ডিঙের বেসমেন্টে নিয়ে গেলেন এবং এক অন্ধকার হলওয়ে ধরে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে Toilet দেখিয়ে দিলেন! আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারলাম না! আমি চাইলাম টেইলার পেলাম টয়লেট। এ বার বুঝুন ভাষা-সমস্যা কাকে বলে। ফেরার পথে একই রকমের আরেকটি সমস্যা হয়েছিল ইস্তাম্বুলের লাউঞ্জে। সাদা মার্বেল পাথরের বাথরুম। টয়লেটে গিয়ে দেখি মশা ভন ভন করছে। কর্তব্যরত জ্যানিটারকে বললাম, তোমার কাছে মশা মারার স্প্রে আছে। তিনিও টার্কিশ ভাষা ছাড়া কিছুই বুঝেন না। মশা কীভাবে উড়ে তা অভিনয় করে দেখালাম, গুন গুন গান গেয়ে শোনালাম। তাতেও কোনও কাজ হলো না। তিনি ইঙ্গিতে আমাকে বললেন, তুমি দাঁড়াও আমি মশার ওষুধ নিয়ে আসছি। আমি দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম, তিনি পারফিউম স্প্রে করে দিয়ে দায়িত্ব সারলেন। এ বার আপনারাই বলুন, পারফিউম স্প্রে-তে যদি মশা মরতো, তাহলে কি ঢাকা-দক্ষিণ-এর মেয়র সাঈদ খোকনকে মনোনয়ন-শঙ্কায় মিডিয়ার সামনে কাঁদতে হতো? ডিসেম্বর ২৫, ২০১৯
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|