নারীর ‘ক্ষমতায়ন’ ও আমার ভাবনা / আবু এন এম ওয়াহিদ
আগের অংশ
আমার মা যেভাবে স্বামীর সংসার শুরু করেছিলেন, তাতে সহসাই ছন্দ পতন ঘটে। তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ বাঁক বদল হয়। যতদূর মনে পড়ে, তিন অথবা চার সন্তান ঘরে আসার পর মা আর স্কুল চালাতে পারেননি। হয়ে গেলেন ফুল-টাইম গৃহিনী। তাঁর কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া ও বড় করা। বাবা বাইরে কাজ করতেন। হাইস্কুলে পড়াতেন। এখন প্রশ্ন হলো, বাবাকে বাইরে ঠেলে দিয়ে অবশেষে মা কেন ঘরে থেকে বার বার ‘মা’ হওয়াটাকেই বেছে নিলেন। এর উত্তর একেবারে সহজ। ১. মায়েরতো অন্য কোনো পছন্দ ছিল না, কোনো বিকল্প ছিল না, যা করেছেন বাধ্য হয়েই করেছেন। আমি যদি বলি, কেন করবেন না? এটিতো খুবই স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক শ্রমবিভাজন (‘ডিভিশন অফ ল্যাবার’)। এ কথা তো আড়াই শ’ বছর আগেই অর্থশাস্ত্রের গুরু অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘ওয়েল্থ অফ ন্যাশন্স’-এ বলে গেছেন। অর্থনীতিবিদরা ’পিতার’ তত্ত্ব সব জায়গায় প্রয়োগ করবেন, অথচ নিজের ঘরে মানবেন না, এ কেমন কথা? আর না মেনে কি কোনো উপায় আছে? মা-কেইতো ‘মা’ হতে হবে, মা-কেইতো সন্তান দেখাশোনা করতে হবে, কারণ বাবাতো ইচ্ছে করলেও তাঁর পেটে বাচ্চা নিতে পারবেন না, নবজাত শিশুকে বুকের দুধও খাওয়াতে পারবেন না। এখানে কথা উঠতেই পারে, ১০-এর বদলে ২/৩-ই-তো তিনি ক্ষান্ত দিতে পারতেন। তখন পারতেন না, তবে হ্যাঁ, এখন এটা সহজ ও সম্ভব, কিন্তু এ সম্ভাবনা সব সময় সব জাতির জন্য সমানভাবে রৌদ্রোজ্জ্বল কি না, এ নিয়ে আমার কথা আছে, আর সে-কথাই বলছি এখন।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কে ঘরে থেকে ঘরের কাজ করবে আর কে বাইরে গিয়ে হাওয়া খাবে, এই কাইজ্যা-ফ্যাসাদ করতে করতে নারী যদি মাতৃত্বকে পরিহার করে, মাতৃত্বকে অবহেলা করে তা হলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কী হবে! একবার ভেবে দেখুন - জাপান, রাশিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও অন্যান্য পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর কী হাল। সব সময় কাগজে বের হয়, সে-সব দেশে মানুষের অভাবে স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দোকানপাটে লালবাতি জ্বলছে, পোস্ট আপিসে পর্যাপ্ত লোক আসে না, রেলস্টেশনে যাত্রী নেই, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আরো ভেবে দেখুন, আজ যদি ভারতের জনসংখ্যা সোয়া শ’ কোটি না হয়ে মাত্র তিরিশ কোটি হতো তাহলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার কি এই মনোমদ থাকত? অন্য দিকে ব্রিটেনের লোকসংখ্যা যদি সাত কোটির বদলে সাতাশ হতো, তাহলে ব্রিটেনকে কি আমেরিকার কাছে গিয়ে কাঁচুমাচু করতে হতো? কক্ষনো না। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে তৈলাক্ত ডলার মাথা থেকে পা পর্যন্ত গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে, অথচ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কেবল ‘সৌদি’ বাদে তাদের তো কেউ পুছেও না। মূল কারণ, ওই সব মরুভূমির দেশে মানুষ নেই। তাহলে দেখা যায়, যেখানে মানুষ আছে সেখানেই কর্মতৎপরতা, সেখানেই সমৃদ্ধি, সেখানেই প্রাচুর্য, সেখানেই ‘ক্ষমতা’। আর বলাই বাহুল্য, মানুষের উৎস নারীর জঠর। এবার ভেবে দেখুন, নারীর ‘ক্ষমতায়ন’ - চাকরিতে, না কি মাতৃত্বে।
রাজপ্রাসাদ হোক আর কুঁড়েঘর হোক, মায়ের অন্ধকার গর্ভ থেকে বেরিয়েই সন্তান ঘরকে আলোকিত করে। কারণ, সে শুধু একটি মুখ ও পেট নিয়ে জন্মায় না, সঙ্গে করে একটি মাথা ও দু’টি হাতও নিয়ে আসে। অধিকন্তু, কুঁড়েঘর কেবলই গরিবের থাকার জায়গা নয়। এটি একটি আধুনিক কারখানাও বটে। এই কারখানায় যারা থাকেন তাঁরা একদিকে ভোক্তা আরেক দিকে উদ্যোক্তাও বটে। ভোক্তা হিসেবে তাঁরা বাজার থেকে চাল-ডাল-তেল-নুন কিনে খান। আর উদ্যোক্তা হিসেবে একই পরিবার উৎপাদন করে আদম-সন্তান - যারা আগামী দিনের নাগরিক, আগামী দিনের শ্রমিক, আগামী দিনের সাংবাদিক, আগামী দিনের বিচারক, আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী।
মাতৃত্বের মর্যাদাকে আমি অনেক বড় করে দেখি। তথাপি, আমি নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বিরোধিতা করি যখন তিনি বলেন, ‘নারী কেবলই সন্তান উৎপাদনের একটি যন্ত্র’। আমার মতে কথাটি এভাবে বলা নারীর জন্য অসম্মানের। নারী যন্ত্র তো নয়-ই, সে কেবল ‘নারী’ও নয়, সে তার চেয়ে বড়, তার চেয়ে মহৎ। সে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মা, মহীয়সী মা। আমি এ-ও মনে করি না যে, আমার মায়ের মতন প্রতিটি নারীকে ১০ বা তার অধিক সন্তান জন্ম দিতে হবে। আপনাদের সবার মতন আমিও চাই, নারী তার সম্ভ্রম ও আব্রু বাঁচিয়ে আপন মর্যাদায় ও মহিমায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিরাপদে সফলতার সঙ্গে বিচরণ করুক, তবে মাতৃত্বকে বাদ দিয়ে কিংবা পাশ কাটিয়ে নয়। যে জাতি এটি করবে, সে অদূরে না হলেও সুদূর ভবিষ্যতে যে দুনিয়া থেকে অবলুপ্ত হবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়।
আগের অংশ
ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭ The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|