নামে কী বা আসে যায় / আবু এন এম ওয়াহিদ
আগের অংশ
দেশ-কাল এবং অঞ্চল ভেদেও নামের তারতম্য হয়। একই নাম একেক জায়গায় একেকভাবে রাখা হয়। যেমন বাংলাদেশে আমরা নাম রাখি খালেদ। এই নাম পাকিস্তান কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে গেলে হয়ে যাবে - খালিদ। ইংরেজিতে প্রধানত আমরা এভাবে - Chowdhury লিখি, কিন্তু সীমান্ত পাড়ি দিলেই এটা ভিন্ন রূপ নিয়ে নেয় যেমন - Chaudhary, Chaudhury বা Choudhury। পাঁচ-ছয় দশক আগে সিলেট অঞ্চলের গ্রামদেশে বেশিরভাগ নামের সাথে আলী যুক্ত করা হত। আজকাল আর হয় না। বোধ করি, নামেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আবার একই বাংলাদেশে, একই সময়ে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের নামের আধিক্য দেখা যায়। ছাত্রাবস্থায় বিষয়টি খুবই সুন্দরভাবে একদিন ক্লাসে তুলে ধরেছিলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক, বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক প্রয়াত আব্দুল মান্নান সৈয়দ। তখন আমি এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে সিলেট সরকারি মহাবিদ্যালয়) পড়ি। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ক্লাসের শুরুতে একদিন রোল-কলের সময় স্যার নাম ডাকতে ডাকতে কী মনে করে হঠাৎ নাটকীয়ভাবে থেমে গেলেন। পুরো ক্লাসের দিকে মুখ তুলে বললেন, সিলেটিদের নাম পড়তে গেলে আমি ঘন ঘন হোঁচট খাই, কোনটা মূল নাম আর কোনটা তার অলঙ্কার, বুঝতে পারি না। এ কথা বলে স্যার যে সব নামের দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন সেগুলো হলো - আলী আহমদ, আহমদ আলী, রহমান আলী, ইসলাম উদ্দিন, ইত্যাদি। ক্লাসে রোল-কলের সময় ওই সব নাম আসলে তিনি নীরবে একা একা উপভোগ করতেন, মুচকি মুচকি হাসতেন, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই বিদ্রূপ বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন না।
অবশ্য আমি এখন অন্য একটি বিষয় আপনাদের নজরে আনতে চাই। সিলেট অঞ্চলে কয়েকটি ব্যতিক্রমধর্মী নাম রাখা হয় যেটা বাংলাদেশের অন্যান্য জেলাই নেই বললেই চলে। এগুলো হলো আছদ্দর আলী, মছদ্দর আলী, গুরফান আলী, ফরমুজ আলী, মোশাইদ আলী, নিমার আলী, তজম্মুল আলী, কিতাব আলী, ইজ্জাদ আলী, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমাদের দুতিন বছর পর সিলেট থেকে এক ছেলে এসে গণিত বিভাগে ভর্তি হলো, তার নাম ছিল কিতাব আলী। কিতাব আলী ছাত্র হিসেবে কেমন ছিল জানি না, তবে সে একজন সুঠাম দেহের অধিকারী ও চৌকস ক্রীড়াবিদ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন হাজারো দর্শকের সামনে, সে লং জাম্প অথবা হাই জাম্পের জন্য কসরত করে চূড়ান্ত অ্যাকশনের দিকে রাজার মতন হেলে দুলে দৌড়ে আসছে - ওই মুহূর্তে দুপাশ থেকে দর্শক-ছাত্ররা সমস্বরে চিৎকার করে বলে উঠত - পুস্তক আলী, বুক আলী, বই আলী ইত্যাদি, ইত্যাদি। যদিও আমি কোনো দিন এ জাতীয় বিদ্রুপানন্দে শরিক হইনি, তথাপি তখন আমি জানতাম না যে, কারো নাম বিকৃত করা একটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ!
নামকরণ নিয়ে আমি এবার আরেকটু গভীর ও গুরুতর একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ষাটের দশকের আমাদের বাড়ির কথা দিয়েই শুরু করি। কিছু ঘটনা ঘটেছে আমার জন্মের আগে, বাকিগুলো যখন ঘটে তখন আমার বয়স আঠারো-কুড়ি, বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চিন্তায় পরিচ্ছন্নতা ও পরিপক্কতা আসেনি, আসলেও কাজ হত না, কারণ ওই বয়সে বাড়ির কোনো সিদ্ধান্তকে কোনোভাবে প্রভাবিত করার মত অবস্থান আমার ছিল না, থাকার কথাও নয়। আমাদের বাড়ি ছিল একটি বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের আবাসস্থল। তার আয়-উপার্জন ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। আব্বা ছিলেন সবার বড় এবং বাড়ির মুরব্বী। তিনি স্থানীয় হাই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, ষাটের দশকে মাইনে পেতেন দেড়শ কি দুশ টাকা। বড় চাচা ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তাঁর মাসিক সম্মানী ছিল মাত্র পঞ্চাশ টাকা। চাচার পদ-পদবীর সুবাদে মানুষের আনাগোনায় আমাদের বাড়ি সব সময় রম রম গম গম করত। বাড়িতে নারী-পুরুষ ছোট-বড় মিলে কাজের লোক ছিল কমসে কম দশ-বারো জন। নারীকর্মীদের নগদ পারিশ্রমিকের কোনো কারবারই ছিল না, তবে কাজের বিনিময়ে দুবেলা পেট ভরে খাওয়া এবং যাওয়ার সময় ছেলেমেয়েদের জন্য পোঁটলা বেঁধে নিয়ে যাওয়াটা ব্যতিক্রমের চেয়ে নিয়মেই পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বেটামানুষদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বেতনভুক; বংশানুক্রমিক ভাবে কয়েক জন পেটে-ভাতেও ছিলেন। বেতন-ছাড়াদের মর্যাদা বেতন-ওয়ালাদের উপরে ছিল, কারণ তাঁদেরকে অনেকটা পরিবারের সদস্য হিসেবেই গণ্য করা হত। এই তফাৎটা তাঁরাও বুঝতেন এবং এর সুবিধাও নিতেন ষোল আনা। কিভাবে সে কথা এখানে আর নাই বা বললাম। এমনি মর্যাদাবান একজনের নাম ছিল চটর। বয়স বিবেচনায় তাঁকে আমরা চটর-চাচা বলে ডাকতাম।
আমার জন্মের অনেক আগে শিশু চটর চাচা তাঁর মা-বাবার সাথে আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। আমার ধারণা, তাঁরা সিলেট অঞ্চলের কোনো চা বাগানের কুলি ছিলেন, কোনো কারণে হয়তো বাগান কর্তৃপক্ষ তাঁদেরকে বের করে দেন অথবা তাঁরা পালিয়ে আসেন। এমনও হতে পারে যে, কেবল চটর চাচার বাবা-মা-ই এসেছিলেন এবং পরে আমাদের বাড়িতেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। চটর চাচার মাকে আমি দেখেছি, তাঁর বাবাকে দেখিনি । চটর চাচার বাবার নাম ছিল মটর। যেহেতু তাঁর নাম মটর, তাই তাঁর স্ত্রীর নাম রাখা হলো - মটরনি। আর মটর-মটরনির ছেলের নাম হয়ে গেল চটর। মটর, মটরনি ও চটর এগুলো সবই অর্থহীন নাম। কে রেখেছিল জানি না, কোনো দিন কাউকে জিজ্ঞেসও করিনি, সময়কালে আব্বাকে প্রশ্ন করলে হয়তো এ রহস্যের সুরাহা হত। এই জাতীয় নামকরণের মাধ্যমে কাজের মানুষের প্রতি আমার পূর্বপুরুষদের একটি দারুণ অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে! এমন নামকরণ যদি আমার বাপ-দাদারা নাও করে থাকেন, তথাপি শোনার পর তাঁদের উচিৎ ছিল নামগুলো বদলে দেওয়া, নিজে করতে না পারলে, বাড়িতে মসজিদের ইমাম থাকতেন, বললেই তিনি তাঁদের জন্য সুন্দর সুন্দর তিনটি নাম রেখে দিতে পারতেন।
একই রকমের অন্য এক কাজের লোকের বেলা এ জাতীয় একটি ঘটনা ঘটেছেও, তবে অনেক পরে। আম্মার বিয়ের সময় তাঁর ফুট-ফরমায়েশ খাটার জন্য নানা একটি ছোট্ট ছেলেকে আম্মার সঙ্গে দিয়েছিলেন। সে ও তার মা, চটর আর মটরনির মতন আমার নানার বাড়িতে আশ্রিত ছিল। ছেলেটির নাম ছিল উদভ তার মায়ের নাম কাঞ্চন। উদভ যখন আমাদের বাড়িতে আসে তখন তাঁর বয়স ছিল বড়জোর তিন কি চার। সে শুধুই আমাদের কোলেকাঁখে মানুষ করেনি, সময় সময় আমাদের খেলার সাথীও ছিল। টুকটাক কাজও করত আবার আমাদের সঙ্গও দিত। উদভ যখন বিশ/একুশ তখন আমাদের মসজিদের ইমাম তার নাম বদলে দিয়ে রাখলেন জমির আলী। তার পর থেকে সে জমির আলীই হয়ে গেল। আমরা তাকে তার নাম-দস্তখত শিখিয়ে দিলাম।
এ দিকে কালের আবর্তে চটর চাচা বিয়ে করলেন। দুএক বছর পর যখন তাঁর এক মেয়ে হলো, তিনি সখ করে শিশু চটর-এর নাম রাখলেন, খাজুরি। তারপর যখন তাঁর আরেক মেয়ে হলো, তখন তিনি নাম রাখলেন এলাছুন, কিন্তু বাড়ির কেউই এই নাম গ্রহণ করলেন না। তাঁদের ভাবখানা, খাজুরি-র বোন তেজুরি, এটাই তো যথেষ্ট, এলাছুন-এর আবার দরকার কী। এভাবে সবাই তাকে তেজুরি ডাকতে শুরু করে দিলেন। এতে করে মেয়েটির আপন বাবার দেওয়া নাম এলাছুন হাওয়ায় হারিয়ে গেল। এলাছুন হয়ে গেল, তেজুরি। চটর চাচা নিরুপায়, তাঁর কিছু বলারও নেই, করারও নেই। তিনি যে বাড়িতে পেটে-ভাতে কাজের লোক! এগুলো সব আমার চোখের সামনে হচ্ছে, এখানে যে একটি অবহেলা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের খেলা চলছে সে সব বিষয় তখন বিলকুল আমার মাথায় আসেনি। গল্পের এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
জমিরের বয়স যখন ২৪/২৫ তখন আমি কলেজে পড়ি। ওই সময় জমির-এর সাথে খাজুরির বিয়ে হলো। দুএক বছরের মধ্যেই তাদের ঘরে ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হলো। মা-বাবাকে আপন ছেলের নাম রাখার সুযোগ না দিয়ে আমার ছোট ভাইয়েরা ভাবলো, জমির-এর ছেলে, তাই তার নাম হওয়া উচিৎ ছমির। ব্যাস জমির-এর ছেলের নাম হয়ে গেল ছমির। তারপর মাস যায়, বছর যায়, আমি কানাডায়, আমার ভাইবোনেরা কলেজে পড়তে এদিক-ওদিক চলে গেল, আব্বা মারা গেলেন। আম্মাও বাড়ি ছেড়ে প্রথমে সিলেট পরে ঢাকায় থাকতেন। পাহারাদার হিসেবে জমিরই তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ির জমিদার হয়ে রইল। জমির আর কাজের লোক নয়, সে এখন বাড়ির রাজা। উনিশ শ সাতানব্বইতে বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখি, জমিরের ছেলে ছমির লায়েক হয়েছে, সে দুবাই যাবে, চটর চাচা তাঁর শেষ সম্বলটুকু (এক টুকরা জমি) বিক্রি করে টাকা দিয়েছেন। নানার টাকায় নাতী দুবাই যাবে, আহ্লাদে আটখানা! জমির-এর কুঁড়েঘরে খুশির বন্যা বইছে! এক দিকে ছমির-এর পাসপোর্ট হয়েছে, আকামাও লেগে গেছে, অন্য দিকে ততদিনে তার নাম বদলে গেছে! ছমির আলী এখন আর ছমির আলী নেই, সে একজন পেটে-ভাতে কামলার ছেলেও নয়, বরং সে এখন রাজার ছেলে - রাজপুত্র! তার উত্তরণ হয়েছে ছমির আলী থেকে আমীর আলী-তে। (আমীর মানে নেতা, বাদশা)। পরিশেষে, আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, নামে যদি কিছু নাই বা আসে যায়, তবে জমির কেন তার ছেলের নাম ছমির পাল্টে আমীর রাখল?
পুনশ্চ: আমার প্রতিটি লেখায় বন্ধু মাহবুবের অবদান অনিবার্য ও অনস্বীকার্য, এ লেখায় তার চেয়েও বেশি, আর তাই তার কাছে আমার ঋণের বোঝাও ভারী।
আগের অংশ
The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|