bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন


বোম্বাই থেকে মুম্বাই
আবু এন এম ওয়াহিদ


ছোটবেলা দিল্লি-আগ্রা, এমন কি কলকাতার আগেও আমি বোম্বাইয়ের নাম শুনেছি। তার মানে এই নয় যে, আমি অল্প বয়সে বোম্বাই গিয়েছি অথবা এমনও নয় যে, আমাদের পরিবারের কেউ হামেশা বোম্বাই যাতায়াত করতেন। অবশ্য আমার এক ফুপা (আব্বার চাচাত বোনের জামাই) বোম্বাইয়ে ওকালতি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু হলে কি হবে, আমার জন্মের আগে ওই ফুফু মারা যান এবং জন্মের পর ফুপাকে কোনো দিন আমাদের বাড়িতে আসতে দেখিনি। তিনি যে বোম্বাইতে থাকতেন সেকথাও আমি জেনেছি মাত্র ক’দিন আগে, বড়ভাইয়ের কাছে। এখন প্রশ্ন হলো, বোম্বাই শব্দটির সাথে আমার বাল্য পরিচয় ঘটল কিভাবে? ঘটনাটির দু’টো মাত্রা আছে। একটি চটুল, হালকা দিক, যার সাথে কিছুটা হাস্যরস ও বিদ্রূপ-উপহাস করুণভাবে মিলেমিশে এক হয়ে আছে! অন্যটার মাঝে নিহিত আছে গভীর আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য, যার রহস্য আমি আজও ভেদ করতে পারিনি!

ঠিক আমাদের গ্রামে বা প্রতিবেশী গ্রামেও নয়, তবে আমাদের এলাকায় এক ‘হাজি’ সাহেব ছিলেন। তাঁকে সবাই ‘বোম্বাই হাজি’ বলে ডাকত। পরিবারে তাঁকে নিয়ে প্রায়ই আলাপ-আলোচনাও হত, তিনি আমাদের বাড়িতে কোনো দিন এলেও এসে থাকতে পারেন, কিন্তু আমি কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আর তাই তো ‘বোম্বাই হাজি’ কেমন ছিলেন এবং গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে তাঁর বয়সই বা কত ছিল, এসবই আমার অজানা। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম, ‘বোম্বাই হাজি’ বুঝি তাঁর নাম। পরে জানলাম, এটা তাঁর ‘নিক নেম’, যৌক্তিক কারণেই তাঁর মা-বাবা, আপন সন্তানের এমন উদ্ভট নাম রাখেননি, রাখতে পারেনও না। গ্রামের লোকজন তাঁকে এ নাম দিয়েছে, কিছুটা খোঁচা মেরে এবং কিছুটা ঠাট্টা করে।

ওই সময়ে সিলেটের অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের ‘বোম্বাই হাজি’-দের দেখা মিলত। এতে বোঝা যায়, ‘বোম্বাই হাজি’ এক জন ব্যক্তি নন, ‘বোম্বাই হাজি’ এক কিসিমের ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষ যারা হজ্জের উদ্দেশ্যে বোম্বাই পর্যন্ত গিয়েই বাড়ি ফিরে আসতেন। হজ্জ তাঁদের নছিব হত না, পবিত্র মক্কা-মদিনার মাটি তাঁরা স্পর্শ করতে পারতেন না। যেসব লোক হজ্জের নিয়ত করে কোনো অজানা কারণে মাঝপথ থেকে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হতেন, তাঁদের মনের অবস্থাটা একটু ভেবে দেখুন। একজন মানুষ একটি পুণ্য কাজে ব্যর্থমনোরথ হয়ে বুকে পাহাড় সমান দুঃখ, বেদনা, হতাশা ও আফসোস নিয়ে বাড়ি ফিরলেন, অথচ নিজের গ্রামের মানুষ, আপন জন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমবেদনা ও সান্ত্বনার কোনো বাণী শুনলেন না, বরং পেলেন, অপমান, তাচ্ছিল্য আর মস্করা! বিদ্রূপাত্মক খেতাব পেলেন, ‘বোম্বাই হাজি’! নিশ্চয়ই তিনি ‘বোম্বাই হাজি’ বলে নিজের নতুন পরিচয় সমাজে উপস্থাপন করেননি। মরার ওপর খাড়ার ঘা আর কাকে বলে! নিষ্ঠুর কৌতুকেরও তো একটা সীমা থাকা উচিৎ!

ঘটনাটির দুঃখজনক লঘু অংশ মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খায়, তা আমাদেরকে আরো গভীর চিন্তার খোরাক যোগায়। প্রশ্নটি হলো, কেন তাঁরা বোম্বাই থেকে ফিরে আসতেন? বড় হওয়ার পর এ নিয়ে আমি বেশ ভেবেছি, কোনো উত্তর পাইনি। সম্প্রতি বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে অভিনব এই ‘হাজি’-দের বিষয়ে একাধিক বার আলাপ হয়েছে, দু’জন মিলেও চিন্তা করেছি, কিন্তু কোনো সমাধান বের করতে পারিনি। যারা দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতির পর, এত আশাভরসা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মহান আল্লাহর মেহমান হয়ে পবিত্র কা’বার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেন, তাঁরা কেন, কোন অজানা কারণে বোম্বাই থেকে ফিরে আসতেন? কারণটা কি পাসপোর্ট-ভিসার জটিলতা? নাকি টাকাপয়সার টানাটানি? নাকি শারীরিক অসুস্থতা? নাকি মাঝপথ থেকে ফিরে এসে নিজেকে ‘হাজি’ বলে জাহির করার কুমতলব? নাকি কোনো ধাপ্পাবাজের দ্বারা প্রতারিত হয়ে খালি হতে বাড়ি ফেরা? মূল প্রশ্নটির এ জাতীয় এক বা একাধিক উত্তর থাকতে পারে, আবার এমনও হতে পারে, এসবের কোনোটিই সঠিক নয়।

ছেলেবেলায় যে বোম্বাইয়ের কথা জেনেছি, কালের আবর্তে সে বোম্বাই-ই মুম্বাই নাম নিয়েছে। নাম শুনলে কী হবে, মুম্বাই যাওয়ার সুযোগের জন্য আমাকে যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে। অবশেষে বৃদ্ধ বয়সে (বয়সের হিসেবে বৃদ্ধ হলেও আমি নিজেকে একজন তরতাজা তরুণই মনে করি) ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ৫ দিনের জন্য আমি মুম্বাই গিয়েছিলাম। এটা আমার জীবনে প্রথম ভারত গমনও বটে। যাওয়ার দিন ইস্তাম্বুল থেকে রাতভর আকাশে উড়ে আমাদের বিমান যখন মুম্বাইয়ে অবতরণ করে তখন পুবের আকাশে আঁধার কেটে গেলেও সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। আমি তাৎক্ষণিক ভেবেছিলাম, ঘন কুয়াশার কারণে বুঝি দিনমণিকে এমন মলিন লাগছে, ঘোলাটে দেখাচ্ছে। পরে বুঝলাম, কুয়াশা নয়, এ অন্য কিছু। যে ক’দিন আমি সেখানে ছিলাম, আকাশ কোনো দিনই মেঘলা ছিল না, অথচ সকাল ১০/১১টার আগে সূর্যের আলোকরেখা দৃষ্টিগোচর হত না, তার তেজও গায়ে লাগত না। কারণ, কুয়াশাও নয়, মেঘে ঢাকা আকাশও নয়, আমার ধারণা, এ বরং মুম্বাইয়ের অন্য এক উপসর্গ - ‘এয়ার পলিউশন’ বা ‘বায়ু দূষণ’। তবে যতদূর শুনেছি দিল্লি-সাংহাই-বেইজিঙের অবস্থা নাকি আরো খারাপ, সেই তুলনায় মুম্বাই অনেক ভালো।

উড়োজাহাজের দরজা পেরিয়ে যেই বোর্ডিং ব্রিজে পা রাখলাম, সাথে সাথে ঢাকার কথা মনে পড়ল। বাতাসের ঝাপটায় একটি মনমাতানো ভেজা ভেজা উষ্ণ মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগল, যা কিনা আমার মাতৃভূমির কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল। কত দিন দেশে যাই না! বাংলাদেশের জন্য হৃদয়ে একটি অব্যক্ত হাহাকার অনুভব করলাম! ক্লান্ত দেহে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এয়ারপোর্টের লম্বা করিডোর ধরে মানুষের ভিড়ে হাঁটছি আর দেশের কথা ভাবছি; ভাবছি, উত্তর-পূর্ব বরাবর আরো ঘণ্টা তিনেক উড়লেই তো ঢাকায় পৌঁছে যাওয়া যায়! এভাবে চলতে চলতে এক সময় দেখলাম, সামনে চলমান সহযাত্রীদের পাদচারণার গতি কমতে কমতে এক জায়গায় এসে একেবারে থেমে গেল। ডানে-বাঁয়ে চেয়ে দেখি একটি বিশাল হল ঘরে সবার সাথে আমিও ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। বাংলাদেশের ঘোর কেটে গেল, সম্বিৎ ফিরে পেলাম, বুঝলাম আমি মুম্বাইতে আছি। কিভাবে বুঝলাম? আশেপাশে, বাতাসে মৃদুমন্দ নতুন গন্ধ পেলাম - মেথি-জিরা-ধনে জাতীয় হরেক রকমের মশলার মিশ্রিত খুশবু। ওই হলঘরে মশলা কেনাবেচা হয় না, রান্নাবাড়া হয় না, খাওয়াদাওয়াও হয় না, তবু ওখানে এমন ঘ্রাণ কেন? উত্তর সহজ, কর্মরত স্থানীয় নারী-পুরুষ ও যাত্রীদের ঘর থেকে জামাকাপড় বেয়ে বেয়ে গন্ধ এসে ইমিগ্রেশন রুমের বন্ধ বাতাসে মিশে গেছে। যারা সব সময় ওই ঘরে, ওই বাতাসে ডুবে থাকেন, কাজে মগ্ন থাকেন, তাঁরা টের পান না, পাওয়ার কথাও নয়, অন্যদের নাকে লাগে, ঠিকই লাগে, ভালো করেই লাগে।

লাইনে সময় একটু বেশি লাগলেও ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস অফিসারদের ব্যবহার ছিল নম্র, ভদ্র, বন্ধুবৎসল। ক্যারোসেল থেকে লাগেজ তুলে গ্রিন চ্যানেল দিয়ে সোজা বেরিয়ে এলাম। আমাকে নিতে আসা হোটেলের ড্রাইভারকে খুঁজে বের করতে একটুও বেগ পেতে হয়নি। এ ব্যাপারে এক ট্যাক্সি কোম্পানির কাউন্টারে কর্মরত জনৈক মহিলা টেলিফোন করে আমাকে সাহায্য করলেন। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভার বাবু আমার হাতে ছোট্ট এক বোতল পানি ধরিয়ে দিলেন। তাঁর সাথে কথা বলতে বলতে ২০/২৫ মিনিটের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেলাম। আমাদের দু’জনের কথোপকথন চললো কিছু মুখে, কিছু আকারে ইঙ্গিতে। বুঝলাম, ড্রাইভার মহাশয় জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকম কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতন ইংরেজি জানেন।

হোটেলের গেটে নিরাপত্তা প্রহরীরা আমাদের থামালেন, গাড়ির ট্রাঙ্ক খুললেন, বোনেট খুললেন, সব ক’টা দরজা খুলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ছেড়ে দিলেন। আরো ৫০/৬০ ফুট সামনে একটি ছোট্ট টিলা বেয়ে উপরে উঠে আমাদের মোটরকার থামল হোটেলের সদর দরজার মুখে। দরজা খুলে নেমেই দেখলাম, আমার বাক্স পেটারা এক্সরে ম্যাশিনের পেটের ভেতর ঢুকানো হচ্ছে, আর আমাকে ‘আর্চ ওয়ে’ অর্থাৎ মেটেল ডিটেক্টারের ভেতর দিয়ে পাস করতে বলা হলো। একটু থমকে গেলাম, ঘাবড়েও গেলাম, ভাবলাম, মুম্বাইয়ের পথ ভুলে আমি কি বৈরুত চলে এলাম! প্রকৃতপক্ষে বৈরুতের চেয়ে মুম্বাইয়ে নিরাপত্তা-তল্লাশি ও কড়াকড়ি আরো বেশি, কিন্তু হোটেলের লবিতে পা রাখার পর মুহূর্তেই সে ভয় কেটে গেল। বৈরুতের বাতাসে যে থমথমে ভাব ও চাপা আতঙ্ক অনুভব করেছি, মুম্বাইয়ের ‘হলিডে ইন’-এ তার ভগ্নাংশেরও আলামত পাইনি। দেখলাম, হোটেল স্টাফদের কর্মব্যস্ততা, গেস্টদের আনাগোনা, পাশের রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসা অতিথিদের কোমল কলরব ও ঠুংঠাং আওয়াজ, সব মিলে সেখানে একটি আনন্দ-মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। এসবের মাঝে ঘড়িতে সকাল দশটা বাজার আগেই স্বস্তির সাথে ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে চেক ইন করলাম। ডেস্কের কাজে ব্যস্ত তরুণ-তরুণীদের চটপটে স্বভাব, বুদ্ধিদীপ্ত চাহনি ও খোশমেজাজি আতিথেয়তা মনে রাখার মতন! তাঁরা এতই ভালো, একটা চাইলে দু’টো পাওয়া যায়, যা চাই, তা তো পাই-ই, যা ভুল করে চাই না, তাও পেয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায় / তেয়াগিলে আসে হাতে’। মুম্বাইয়ের ‘হলিডে ইন’-এ ত্যাগ ছাড়াই সব কিছু না হলেও অনেক কিছু হাতে চলে আসে। রুমে যাওয়ার আগে আমাকে বলা হলো, এখন ন’টা চল্লিশ বাজে, সাড়ে দশটা পর্যন্ত ‘সপ্তমী’ ক্যাফেতে ফ্রি ব্রেকফাস্ট চলবে, খেতে চাইলে দেরি করবেন না।

আমি রুমে গিয়ে গোসল সেরে নাস্তা খেতে নামলাম। ‘সপ্তমী’-তে ঢুকার পর নানান জাতের খুশবুদার খাবারের পাগল করা গন্ধে খিদে যা ছিল তা বেড়ে হয়ে গেল দ্বিগুণ। দেখলাম ডাইনিং এরিয়াতে চলছে এলাহি কাণ্ড! প্রথমে বুঝতে পারিনি, পরে আন্দাজ পেলাম, ওই ক্যাফেতে যুগপৎ দুই তরিকায় সেবা দেওয়া হয়। এক দিকে আছে ‘বাফে বার’, সেখানে দেশী বিদেশী নানা জাতের খাবার পাওয়া যায়। ঘুরে ঘুরে প্লেট ভরে যা ইচ্ছা, যত ইচ্ছা পেট চুক্তি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তার সাথে আবার সরাসরি কিচেন থেকে অর্ডার করে ফ্রেশ তৈরি খাবারেরও মেন্যু আছে। কিচেন থেকে অর্ডার করে যা পাওয়া যায় তা হলো, দোসা, দোসা-মাসালা, চা, চা-মাসালা, অমলেট, অমলেট-মাসালা, আরো অনেক কিছু যার ফিরিস্তি আমি নিতে যাইনি, সব আইটেম খাইও নি। আমার সামনে দূরে এক টেবিলে বসে এক ভদ্রলোক দেখলাম সাদা সাদা পাতলা রুটি খাচ্ছেন। এক ওয়েটারকে কাছে ডেকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম ওটা কী? বলল, ‘দোসা’। আমি বললাম আমার জন্য দু’টো নিয়ে আস। কিছুক্ষণ পর বিরাট এক প্লেটারে এক পিস দোসা এনে আমার সামনে রাখল। তখন মনে পড়ল ২০ বছর আগের কথা। উনিশ শ’ সাতানব্বই সালে ঢাকার নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সময় কেউ একজন আমাকে বনানীর এক রেস্তোরাঁয় নিয়ে দোসা খাইয়েছিলেন। এর পর আর আমার দোসা খাওয়া হয়নি এবং এত দিনে আমি এর কথা ভুলেও গেছি।

পর দিন যখন খেতে নামি তখন এই দোসা নিয়েই আমি আরেকটি দোটানায় পড়েছিলাম। অবশ্য এর সমাধান বের করলাম গিয়ে তৃতীয় দিনে। এ কথায় আবার ফিরে আসব পরে। দোসা খাওয়ার পর আমি কিন্তু কিচেন থেকে আরেকটি আইটেম অর্ডার করেছিলাম এবং একটি তাজা গরম গোলাবজামনও খেয়েছিলাম। অর্ডারকৃত আইটেমটি কী? তা এখন জনসমক্ষে আর খুলে বলছি না, (কেউ প্রাইভেটলি জানতে চাইলে বলে দেব) কারণ আপনারা ভাবতে পারেন, ‘লোকটা ভীষণ পেটুক’। আসলে আমি পেটুক নই, তবে আমি যে ভোজন রসিক এ কথা বলতে আমার কোনো লজ্জাও নেই রাখঢাকও নেই। প্রথম দিন খাওয়া শেষে যখন ‘সপ্তমী’ থেকে বেরিয়ে আসি তখন নাস্তার সময় প্রায় শেষ।

পর দিন নাস্তা খেতে নামি আরো আগে সকাল ন’টার দিকে। প্রথম দিন যে ছেলেটি আমাকে সার্ভ করেছিল, তার নাম ‘সানি’। ‘সানি’ একটি চটপটে বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে। দ্বিতীয় দিন তাকে খুঁজে পেলাম না। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ‘তানভীর’। সানির কথা জানতে চাইলে বলল, ‘আজ তার অফ ডে, কিচেন থেকে আপনাকে কী এনে দেব?’। আমি বললাম, দু’টো দোসা লও। আজও দুই প্লেটে দুটো দোসা আসল। আমি দু’টোকে এক প্লেটে নিয়ে খেতে যাব এমন সময় দেখি, গতকালের দোসা আর আজকের দোসার মাঝে দুই দুনিয়ার তফাৎ। গতকালেরগুলোয় ব্যারিটোর মত র্যা প করা ভেজিটেবল ছিল। আজকেরগুলো কেবলই পাতলা ভাজ করা রুটি। অবশ্য খেতে অসুবিধা হয়নি, কারণ দোসার সাথে একটি ছোট্ট কৌটোয় মশলামেশানো সুস্বাদু রায়তা থাকে।

তৃতীয় দিন সকালে যখন নাস্তার টেবিলে বসলাম, তখন কোথা থেকে ‘সানি’ দৌড়ে এসে বলল, ‘স্যার, আপনার জন্য আমি দু’টো দোসা নিয়ে আসছি’। আমি বললাম দাঁড়াও, প্রথম দিন দোসার ভেতর ভেজিটেবল ছিল, গতকাল খেলাম কেবলই পাতলা রুটি, আজ তুমি কোনটা আনবে। সানির কথায় রহস্যের জট খুলল, সে বললো, ‘প্রথম দিন আপনি খেয়েছেন দোসা মাসালা, গতকাল খেয়েছেন দোসা, আজ কী খেতে চান?’। বললাম, দোসা মাসালা। তৃতীয় দিনে একটু সময় নিয়ে খেলাম, কথা বললাম, সানি ও তার সহকর্মী তানভীরের সঙ্গে, পরিচয় হলো আরেক ওয়েটার নাবিলের সাথেও। জানতে পারলাম, ‘সপ্তমী’-তে দশ/বারো জন ২৪/২৫ বছরের যুবক ওয়েটার হিসেবে কাজ করছে, তাদের দলে দু-তিন জন মেয়েও আছে। কৌতূহল নিয়ে লক্ষ করলাম, ওয়েটাররা সবাই ভালো ইংরেজি জানে। ভোজনরত ভোজন রসিকদের সাথে অতি স্বচ্ছন্দে তারা ইংরেজিতে বাতচিত চালিয়ে যাচ্ছে। পরে কথা বলে জেনেছি, তাঁদের অধিকাংশই এমএ পাশ, হাতে গোনা কয়েকজন বিএ পাশে আছে। ওয়েটাররা সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘হোটেল ম্যানেজমেন্ট’- এ ডিগ্রিধারী। তাদের কর্মদক্ষতা, ভদ্রতা ও অতিথি পরায়ণতা দেখে বিস্মিত ও অভিভূত না হয়ে পারিনি!
‘সানি’-কে জিজ্ঞেস করলাম এমএ পাশ করে এ কাজ কর কেন, অন্য চাকরি পাওনি, অন্য এরিয়ায় বা ফ্রন্ট ডেস্কে তোমার কাজ করতে ইচ্ছা করে না। বলল, ‘স্যার, ইচ্ছা করে এবং আগামীতে করবও’। আমরা কলেজে থাকতে এখানে ইন্টার্নশিপ করেছি, পাশ করার পর চাকরি নিয়েছি। সবাইকে এই ‘সপ্তমী-তে ওয়েটারি দিয়েই শুরু করতে হয়, তার পর পর্যায়ক্রমে সব ডিপার্টমেন্টে আমাদের ট্রেনিং হবে। ট্রেনিং শেষে ম্যানেজমেন্ট ঠিক করবে, কাকে কোন ডিপার্টমেন্টে পোস্টিং দেবে। বুঝলাম হিউম্যান রিসোর্স ডেভোলাপমেন্টের এটি একটি সুন্দর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এদের মাঝে যে লোকটি পর্যায়ক্রমে উপরে উঠতে উঠতে গিয়ে ম্যানেজার হবে সে অন্তত বুঝতে পারবে হোটেলের প্রতিটি বিভাগ কিভাবে চলে, কী তাদের সমস্যা, কী হতে পারে সেসবের সমাধান।



(ন্যাশভিল, সেপ্টেম্বর, ২০১৭)



Abu N M Wahid
The Author is an Economics Professor and an
Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com






Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-Oct-2018

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot