bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



মোবাইল ফোন: ইতিহাস, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ
আবু এন. এম. ওয়াহিদ



আধুনিক মানুষ হিসেবে জামাকাপড়ের সাথে আমরা প্রতিদিন নানা জাতের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ব্যবহার করে থাকি। যেমন, জুতো-স্যান্ডেল, ছাতা, চশমা, কলম, ঘড়ি, ল্যাপটপ, ইত্যাদি। এ সব কিছুর চেয়েও আজকাল বেশি জরুরি আমাদের কাছে মোবাইল ফোন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মোবাইল আমরা কখনো হাত ছাড়া করতে চাই না; এমন কি ঘুমোবার সময়ও তাকে রাখি বালিশের পাশে। মোবাইল ফোন দেখতে এখন যেমন, দু’দশক আগেও এরকম ছিল না। এটা তার বর্তমান প্রযুক্তিগত আঙ্গিকে একদিনে আসেনি; দীর্ঘ সময় ধরে স্তরে স্তরে এর উন্নতি ও অগ্রগতি হয়েছে। আদি অবয়বে মোবাইল ফোনের প্রথম ব্যবহার হয় ১৯২৬ সালে জার্মানিতে - বার্লিন ও হামবুর্গের মাঝে চলাচলকারী ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর কামরায়। ওই সময় জার্মানিতে বেসামরিক বিমান চলাচলেও মোবাইল ফোনের চল ছিল। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী রণাঙ্গনে এক ধরণের মোবাইল ফোন সীমিত পরিসরে ব্যবহার করেছে।

১৯৪০ সালে গাড়িতে ব্যবহারের জন্যে প্রথম কারফোন আবিষ্কার করে আমেরিকার এটি-অ্যান্ডটি কোম্পানি। ওই কার ফোন গাড়িতে স্থায়ীভাবে সংস্থাপন করতে হত। পরে এটি-অ্যান্ডটি একটি উন্নত মানের কারফোন বের করে, যা কিনা পোর্টেবল ছিল। গাড়ির সিগারেট লাইটারের আউটলেটে প্লাগ করা যেত। ১৯৪৫ সালে একই কোম্পানি আরো উন্নত ফোন আবিষ্কার করে। এটি ব্যবহার করা হত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ‘বেস স্টেশন’ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি মাত্র ছোট্ট এলাকায়। যোগাযোগের চ্যানেল ছিল কেবল একটাই। একজন একটা ফোন কল করলে একই সময়ে অন্য কেউ ওই চ্যানেল ব্যবহার করতে পারত না। ১৯৪৭ সালে এটিঅ্যান্ডটির প্রকৌশলী ড্যালাস রিং এবং ডব্লিউ ইয়ং কারফোন ব্যবহারযোগ্য অঞ্চলকে হেক্সাগনেল আকারে বিভিন্ন সেলে বিভক্ত করেন। তাঁরা যোগাযোগ টাওয়ারকে হেক্সাগনের মধ্যখানের পরিবর্তে কোণে প্রতিস্থাপন করেন। ১৯৫০-এর আগ পর্যন্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়া সাধারণ মানুষ কারফোন ব্যবহার করতে পারত না। ১৯৫০ সালের প্রথম দিকে জার্মানির রাইন নদীতে বিনোদনের জন্যে চলাচল করা নৌযানে সাধারণ যাত্রীদের জন্য ব্যবহারোপোযোগী মোবাইল ফোন প্রথম চালু করা হয়।

স্বয়ংক্রিয় আধুনিক মোবাইল ফোন ১৯৫৬ সালে প্রথম আবিষ্কার করে সুইডেনের এরিকসন কোম্পানি, কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত ভারি - ওজনে ৪০ কেজি। পরে বাজারে আসে ৯ কেজি ওজনের উন্নত সংস্করণ। ১৯৬০-এর আগ পর্যন্ত যে তিনটি কারণে মোবাইল ফোন জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তা হল ওজনে ভারি, সীমিত ব্যবহার এবং অত্যধিক দাম। একই সময়ে আমেরিকায় মোবাইল ফোন প্রযুক্তিতে আসে এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। এটিঅ্যান্ডটির বেল ল্যাবের প্রকৌশলী রিচার্ড ফ্র্যাঙ্কাইল এবং জোয়েল অ্যাঙ্গেল মোবাইল যোগাযোগ পরিসরকে সফলভাবে ক্রমানুসারে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেলে বিভক্ত করতে সক্ষম হন, আর এ জন্যই মোবাইল ফোনকে সেলফোনও বলা হয়। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সেলফোন কেবল মাত্র একটি যোগাযোগ সেলের মধ্যে ব্যবহৃত হত। ১৯৭০ সালে একই ল্যাবের আরেকজন প্রকৌশলী, অ্যামোস জোয়েল জুনিয়র আন্ত-সেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। ১৯৭১ সালে আধুনিক সেলফোনের প্রথম সফল বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় ফিনল্যান্ডে। আধুনিক সেলফোনের জন্মভূমি আমেরিকায় এবং এর বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৮২ সাল থেকে। তারপর আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে।

দুই দশক মোবাইল ফোন ব্যবহারের পর, স্ক্যানডিনেভিয়ান অঞ্চলের স্বাস্থ্য বিভাগে যে সাধারণ প্রশ্ন দেখা দেয় তা হল, মোবাইল ফোনের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কি না? এর ব্যবহারের সাথে ব্রেন টিউমার বা অন্য কোনো ধরণের ক্যান্সারের কোনো যোগসূত্র আছে কি না? এ প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখে স্ক্যানডিনেভিয়ান দেশসমূহে ১৯৯০-এর দশকে বেশ কয়েকটি গবেষণা জরীপ চালানো হয়। প্রথম দিকে সবকটা জরীপের ফলাফলে দেখা যায়, মোবাইল ফোন ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য কোনোভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ নয়। ১৯৯৫ সালে ড্যানিশ ইন্সটিটিউট অফ ক্যান্সার এপিডেমিওলজি একটি বড় ও ব্যাপক গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়। এ গবেষণার উপসংহারেও একই কথা বলা হয়; অর্থাৎ মোবাইল ফোন ব্যবহারের সাথে ব্রেন টিউমার বা ক্যান্সারের কোনো সম্পর্ক নেই।

বর্তমানে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশেরও বেশি লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ‘বেশি দিন মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে কোনো প্রকার স্বাস্থ্য-ঝুঁকি নেই,’ এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগে ঢালাও ছাড়পত্র দিয়ে থাকলেও, আরও ব্যাপক গবেষণা ছাড়া, এখন নিশ্চিত করে কিছু বলছেন না, কারণ ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার-এর এক গবেষণা জরীপে কিছুটা আশংকাজনক ফলাফল পাওয়া গেছে। এই জরীপে সাড়ে ৪ হাজার মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী অংশ নেয়। তাদের মধ্যে প্রান্তিক-ভাবে মাথার যে দিকে মোবাইল ব্যবহার করা হয়, সে দিকে ব্রেন টিউমারের একটি ইতিবাচক আলামত দেখা যায়। এই ফলাফল উন্নত বিশ্বে মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ক্যান্সার-গবেষণার জন্ম দিয়েছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি গবেষণায় ভিন্ন ধরণের ফলাফল লক্ষ করা যায়। ওই গবেষণা অনুযায়ী, যে সব পুরুষ দিনে চার ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করে তাদের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়ার নজির দেখা গেছে। যারা ছয় ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করে তাদের প্রজনন ক্ষমতা স্বাভাবিক পুরুষদের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ কমে যায়। অন্যান্য বেশ কয়েকটি গবেষণা জরীপেও মোটামুটি একই রকম ফলাফল ধরা পড়ে। যে সব যুবক প্যান্টের পকেটে অথবা কোমরে বেল্টের সাথে মোবাইল ফোন ঝুলিয়ে চলা ফেরা করে, তাদের মধ্যেও প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই ফলাফলের স্বপক্ষে হাঙ্গেরির সাগোদা ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা রিপোর্টেও সমর্থন পাওয়া গেছে।

মোবাইল ফোন থেকে অনবরত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশন বের হয়, যা মানুষের হার্টের জন্য ক্ষতিকর, আর তাই সার্টের বুক পকেটে মোবাইল ফোন রাখা একেবারেই নিরাপদ নয়। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারির মুখের থুথু কিংবা লালা ফোন সেটের কীপ্যাডের ওপর পড়ে থাকলে, থার্মাল রেডিয়েশনের ফলে ধরণের ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিতে পারে, যা মানবশরীরের জন্য কোনো কোনো সময় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে যে তাপ বের হয় তা চোখের জন্যও খারাপ। অন্য এক জরীপে, মোবাইলের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশনের সাথে খরগোসের চোখে ক্যাটারাক্ট হওয়ার ইতিবাচক সম্পর্ক পাওয়া গেছে এবং বর্তমানে মানুষের মধ্যে এ ধরণের গবেষণা কাজ চলছে। আমেরিকার ওয়েন স্টেইট ইউনিভার্সিটি, এবং আই.টি.আই.এস. ইন্সটিটিউট ও সুইডেনের উপ্সালা ইউনিভার্সিটি ও কারালিন্সক্ ইন্সটিটিউটের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে অনেকের মধ্যে দীর্ঘকালীন মাথাব্যথা, মাথা ঘোরানো, ক্লান্তিবোধ, ইত্যাদি উপসর্গ ক্রনিক আকারে দেখা যায়। বছর দু’এক আগে একটি ফরাসী সরকারী স্বাস্থ্যসেবা অ্যাজেন্সির প্রেসিডেন্ট সাধারণ জনগণের প্রতি একটি উপদেশ বাণী দিয়েছেন। তাতে তিনি পরিষ্কার ভাষায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন দিতে নিষেধ করেছেন।

এছাড়াও পরোক্ষভাবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর মোবাইল ফোনের বিরূপ প্রভাব রয়েছে। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা যায়, মোবাইল ফোন কমিউনিকেশন টাওয়ারের কারণে ‘কলোনি ব্যাল্যান্স ডিসঅর্ডার’ হচ্ছে যার ফলে ওই সব টাওয়ারের আশেপাশে মৌমাছির আনাগোনা এবং মৌচাকের সংখ্যা ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। উন্নত বিশ্বে এবং আমেরিকায় পুরনো এবং অব্যবহৃত কোটি কোটি মোবাইল ফোন পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এ পর্যন্ত ১০০ কোটিরও অধিক অব্যবহৃত পুরনো মোবাইল ফোন আবর্জনার সাথে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আরও অন্তত ৫০ কোটি পুরনো মোবাইল ফোন শিগগির ময়লা আবর্জনার সাথে ফেলা হবে। এখানেই শেষ নয়, আমেরিকায় প্রতি সপ্তাহে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা কমপক্ষে ৩০ লাখ পুরনো ফোন আবর্জনা স্তূপে ফেলে থাকে। এর পরিমাণ দিনে দিনে আরও বাড়বে। এটা আমেরিকার পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ।

সর্বশেষে, উন্নত বিশ্বে গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে প্রতিদিন ঘটছে অসংখ্য ট্র্যাফিক দুর্ঘটনা এবং এতে মারা যাচ্ছে প্রচুর লোক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গাড়ি চালাবার সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিপক্ষে আইন পাশ হচ্ছে। এত কিছুর পরও পৃথিবীতে মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, এমন কি কমানোও যাবে না, বরং এর ব্যবহার দিনে দিনে আরো বাড়বে। এর কারণ এখনও তার উপকার, অপকারের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ একটি অতি ঘনবসতিপূর্ণ গরিব দেশ। এখানে পরিবেশের ওপর এমনি অনেক চাপ ও ঝুঁকি রয়েছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার থেকে আগামী দিনে যাতে কোনো রকম বাড়তি চাপ না আসে, সে ব্যাপারে আগে থেকেই সরকার, বেসরকারি সংস্থা, এবং জনগণের সাবধান হওয়া খুবই দরকার।



লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ;
Email: wahid2569@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 17-Nov-2016

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot