“কাগজ কি কাশ্তি” আবু এন এম ওয়াহিদ
পৃথিবীতে এমন মানুষ যদি থেকে থাকেন, যারা তাঁদের শৈশব এবং কৈশোরের মধুমাখা স্মৃতিগুলোকে আজীবন মূল্যবান সম্পদ হিসেবে ধারণ ও লালন করেন না, তবে আমি তাঁদের দলে নই। অন্য আর দশ-পাঁচ জনের মতন আমিও জীবনভর বয়ে বেড়াচ্ছি আমার ছোটবেলাকার অসংখ্য সুখের ও দুঃখের স্মৃতিকথা। কখন, কোন সময়, কোন পরিস্থিতিতে আমার শৈশবের কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনা হঠাৎ মনের আয়নায় ভেসে ওঠে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, নেই কোনো ছক-বাঁধা নিয়মও। সুখের স্মৃতি মনে হলে পুলকিত হই, আনন্দ পাই, বন্ধুবান্ধব, বউ-ছেলেমেয়েদের সাথে ভাগাভাগি করে আনন্দ আরো বাড়িয়ে নেই। দুঃখের হলে সঙ্গে সঙ্গে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে, হৃদয়ে কাঁপুনি লাগে, চোখ দু’টো ছল ছল করে আসে! এমন অবস্থায় কখনো কাছে থাকা প্রিয়জনকে বলে মনটা হালকা করি, কখনো মনের ব্যথা মনেই ধরে রাখি, বেডরুমের দরজা বন্ধ করে একাকী নীরবে কাঁদি।
এ ভাবে সুখ এবং দুঃখ পালাক্রমে আমার জীবনকে ছুঁয়ে যায় হরহামেশা। সুখের কথায় সুখ পাই, এ-তো স্বাভাবিক, কিন্তু অতীতের দুঃখ-মাখা স্মৃতিতে ব্যথার সাথেও এক ধরণের তৃপ্তি অনুভব করি, যা সঠিকভাবে প্রকাশ করার মতন ভাষা আমার জানা নেই! কবি-সাহিত্যিকরা একেই হয়ত বলে গেছেন ‘দুঃখবিলাস’! সত্যি, ‘দুঃখবিলাস’ মানুষের মনোজগতের এক অদ্ভুত অনুভূতি! এ অনুভূতি সবাইকে সব সময় একই তীব্রতায় একইভাবে নাড়া দেয় কি না তা বলা মুশকিল। সম্ভবত ‘দুঃখবিলাস’এর জন্যই আমার কাছে সুখ এবং দুঃখ দু’টোই যেন একই রকম মমতা-মাখা ভালোবাসার পাত্র। সুখ ও দুঃখের স্মৃতিকে আমি অনুভব করি সমান তালে গভীরভাবে, দু’টোকে একই নিক্তিতে মাপি একইভাবে। দু’টোকেই আমি ভোগ করি এবং বলতে পারেন উপভোগও করি। সুখ ও দুঃখ সমানভাবে আমাকে সমৃদ্ধ করে এবং জীবনে চলার পথে নিরন্তর শক্তি যোগায়। চড়াই-উৎরাই নিয়ে গতানুগতিক চলার পথে আজ আমার স্বাভাবিক জীবনের, স্বাভাবিক দিনের একটি স্বাভাবিক সকাল। ক্লাস নেই, তাই আপিসে যাইনি। আমি এবং আমার স্ত্রী রওয়ানা দিয়েছি ডেন্টিস্টের ক্লিনিকে। আজ আমার যন্ত্রণা-কাতর আক্কেল দাঁত উপড়ে ফেলার তারিখ। স্ত্রী, গাড়ি চালাচ্ছেন আর আমি সামনে প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছি। সারারাত অঝোরে বৃষ্টি হয়েছে। তখনো আকাশের কান্না থামেনি। পড়ছে টপটপ বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি। গাড়ির ছাদে উইন্ডশিল্ডে বৃষ্টির আওয়াজ সঙ্গীতের মতন কানে এসে বাজছে! নগরজীবন বড়ই বিচিত্র! যানবাহনে ভরা ব্যস্ত রাস্তাগুলো! এমন বাদলা দিনেও অলস অবসরের অবকাশ নেই, চলছে মানুষ বিরামহীন জীবন-জীবিকার অন্বেষায়, যার যার গন্তব্যে। রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘর, ঝোপঝাড় পেছনে ফেলে আমরা ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। তার মাঝে দু’পাশে এঁকে বেঁকে চলে গেছে ছোট ছোট খাল-নালা। বৃষ্টির পানিতে ভরে টই টুম্বুর, ঘোলা পানি ময়লা আবর্জনা ঠেলে নিয়ে কলকল শব্দে ছুটে চলেছে নিচের দিকে। স্রোতের তোড় সবকিছুকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনে নদীর পানে।
মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারলাম নস্টালজিয়া আমার মনকে টেনে নিয়ে গেছে পঞ্চাশ বছর পেছনে আমাদের বড়লেখার গ্রামের বাড়িতে। স্মৃতিতে ভেসে উঠল সেই সব দিনের কথা যখন আমার বয়স মাত্র দশ কি বারো। বৃষ্টি থামলে খালি পায়ে খালি গায়ে কাগজের নৌকো হাতে করে ছুটে যেতাম বাড়ির পেছনে নালার ধারে যে পথে বৃষ্টির পানি নামত কল কল ধ্বনিতে। ময়লা ঘোলা পানির স্রোতে ছেড়ে দিতাম কাগজের তৈরি আদরের ধন মূল্যবান নৌকোখানা। তারপর উল্লাস আর উচ্ছ্বাসে নৌকোর পিছে পিছে দৌড়াতাম, কখনো বৃষ্টিতে ভিজে, কখনো রোদ-মাখা দেহে। কোনো কোনো দিন নৌকো উল্টে যেত কিছু দূর গিয়েই, কোনো দিন আটকে থাকত নালার পারে কিংবা নালার ধারে কচুবনে, কোনো দিন স্রোতের তোড়ে ছুটে চলত উত্তরে কিশোরী খালের দিকে। এ ভাবে সারাবেলা কাটিয়ে কাদাপানি মেখে ঘরে যখন ফিরে আসতাম তখন মা বকাবকি করতেন। বকুনি খেয়ে আনন্দ কমত না, বরং আরো বেড়ে যেত বহুগুণ। এমন ভাবতে ভাবতে কখন যে গাড়ি এসে থেমে গেল পার্কিংলটে, ডেন্টিস্টের ক্লিনিকের পেছনে, বুঝতেও পারিনি। নস্টালজিক অনুভূতি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হুড়মুড় করে গিয়ে উঠলাম ডেন্টিস্টের অফিসে।
দু’ঘণ্টা আগে সুস্থ-সবল যে মানুষটি দু’পায়ে হেঁটে এসে ঢুকেছিলাম ডেন্টিস্টের কারখানায়, বেরিয়ে এলাম সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ। আমি এখন রোগী। আমাকে স্বপায়ে দাঁড়াতে দিল না। সিডেশনের ঘোর কাটেনি, শরীরে শক্তি নেই, চোখে ঘুম ঘুম ভাব, গাল গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, ন্যাপকিনে মুছে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। দানাপানির অভাবে পেট বিদ্রোহ করছে। বুঝতে আর বাকি রইল না যে, বাড়িতে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ধৈর্যের পরীক্ষা চলতে থাকবে। নার্স ধরে ধরে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিল। যথারীতি আমার স্ত্রী আমাকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন বাড়ির পথে। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। খালনালার পানিও অনেক নিচে নেমে গেছে। বাড়ি ফেরার পথে নস্টালজিয়া ফের এসে ভর করেনি আমার মনের কোণে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে ঘরে এসে উঠলাম। বিশ্রাম নিয়ে হালকা একটু খেলাম। বুঝলাম এরমধ্যে সিডেশনের ঘোর থেকে বেরিয়ে এসেছি। কারো সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করল। ফোন করলাম আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুবকে। তার সাথে কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসল ছোট বেলাকার মজার খেলার কথা। বৃষ্টির পরে খালের পানিতে কাগজের নৌকো নিয়ে খেলা। বাল্যস্মৃতি নিয়ে দু’জনই খেলার গল্পে মেতে উঠলাম। কথায় কথায় মনে পড়ল জগজিৎ সিং ও চিত্রা সিং এর জনপ্রিয় বিখ্যাত গজলের কথা।
“ইয়ে দৌলত ভী লে লো ইয়ে শোহরত ভী লে লো ভালে ছীন লো মুজছে মেরী জোওয়ানী মাগার মুজকো লোটা দো বাচপানকা শাওয়ান উয়ো কাগজ কি কাশ্তি, উয়ো বারিশকা পানি...” মাহবুব বলল, সে জগজিৎ সিং ও চিত্রা সিং এর নাম শুনেছে বটে, কিন্তু তাঁদের গাওয়া কোনো গজল শুনেনি। সাথে সাথে ইউটিউবে সিং যুগলের গজলটি প্লে করে আমার ফোনের হ্যান্ডসেট স্পিকারের সামনে ধরে তাকে শোনালাম পুরো গজল। মাহবুব প্রথমবারের মত শুনে তো অভিভূত, বিমুগ্ধ! আমরা দু’জন মিলে এই গজলের অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার কোশেশ করলাম। মাহবুবের সাথে কথা শেষ করে লিখতে লাগলাম এই কথিকাখানা। আর তাই শিরোনাম দিলাম, “কাগজ কি কাশ্তি”। তবে লেখাটির শেষ দেখলে আপনারা ভাববেন, শিরোনামটি অন্য রকম হতে পারত। কথাটি ঠিক, তবে যেহেতু ওই গজলের চরণটিই আমাকে আজ লিখতে উৎসাহ যুগিয়েছি, তাই আর নামটি বদলাতে চাইলাম না। লেখকের এটুকু স্বাধীনতা না থাকলে চলবে কেমন করে!
এখানে একটি কথা বলে রাখি। আমি যে বয়সে বৃষ্টির পরে খালের বয়ে যাওয়া ঘোলা পানিতে কাগজের নৌকো নিয়ে খেলতাম, সে বয়সে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা এবং গোটা কয়েক বাংলা শব্দ ছাড়া অন্য কোনো ভাষাই জানতাম না, বুঝতামও না। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজির তো প্রশ্নই উঠে না। এখনো হিন্দি, উর্দু বলতে ও লিখতে জানি না, তবে একটু আধটু বুঝি। আর ইংরেজির কথা আজ না হয় নাইবা পাড়লাম।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাই। জগজিৎ ও চিত্রার গজল থেকে বোঝা যায়, শৈশব ও কৈশোরে বৃষ্টির পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে খেলা ভারতবর্ষ তথা এই উপমহাদেশের অন্যত্রও হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, আমার বিশ্বাস ইউরোপ-আমেরিকাতেও ছেলেমেয়েরা এমন মজার খেলা নিশ্চয়ই খেলে। এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য আগামী দিন ক্লাসে আমার ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করব। তাদের দেখাবার জন্য এই লেখার ফাঁকে আজ বসে বসে একটি ছোট্ট কাগজের নৌকোও বানালাম। বানাতে গিয়ে দেখলাম ছোটবেলার সেই মধুর খেলা এখনো ভুলিনি। মনে আছে ষোল আনা, তবে যা ভুলেছি, তার মূল্যও কম নয়। সে কথা হবে আরেক দিন।
এখানে অন্য একটি কথার অবতারণা বোধ হয় খাপছাড়া লাগবে না। হঠাৎ করেই মনে আসল, তাই বলছি। অতীতে রাজা-বাদশাহ যা পারেননি, আজকাল দেশে দেশে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীরা যা পারছেন না, বিশ্বসংস্থাও যা পারছে না, খেলার ছলে শিশুরা বোধ হয় তা করতে পারে। তারা জগতের সব মানুষকে মনুষ্যত্বের বন্ধনে বেঁধে ফেলতে পারে। কথাটা বলছি এ জন্য যে, আমি আফ্রিকার অভ্যন্তরে সুদূর মালাওয়ি এর গহিন গ্রামে, যেখানে মানুষের একমাত্র সম্বল দারিদ্র, সেখানে অবাক হয়ে দেখেছি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ভাঙা মাটির হাড়ির চাঁড়া দিয়ে মাটিতে দাগ কেটে এক্কা দোক্কা খেলছে, যে খেলা ছোটবেলা আমরাও অনেক খেলেছি, একইভাবে ঘরের বারান্দায় এবং মাটির উঠানে!
Writer is an Economics Professor and Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|