জিমি হেন্ডরিক্স এর কথা ও বাংলাদেশে তার প্রাসঙ্গিকতা আবু এন এম ওয়াহিদ
শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য আমি বিকেলবেলা আমাদের বাড়ির আশপাশে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করি। শীত মৌসুমে ঠাণ্ডার জন্যে হয়ে ওঠে না, কিন্তু গরমকালে আমার লক্ষ্যমাত্রা সপ্তাহে অন্তত তিন দিন দু’মাইল করে হাঁটা। ব্যক্তিগত অনেক কাজেই আমার ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা আছে, কিন্তু শরীর চর্চায় আমি নিজেকে কখনো ঠকাতে চাই না, তবু সময় সময় এ দরকারি কাজে কসুর হয়ে যায়। যে বছরের কথা বলছি, সেবছরের গ্রীষ্মে আমার হাঁটাহাঁটিতে বড় ধরণের ঘাটতি পড়ে। কিছুটা অতিরিক্ত গরম এবং কিছুটা রোজার কারণে। শাওয়ালের চাঁদ দেখে ন্যাশভিলের বাংলাদেশি সমাজের সাথে যথারীতি আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে আমরাও সেবারকার ঈদ উদযাপন করেছি মাত্র। ঈদের ঠিক পরদিনই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম বাড়ির পাশে বেলভিউ'র হারপেথ নদীর পাড় ধরে। আমার নিত্যদিন-কার হাঁটার পথের এক প্রান্তে এসে দেখতে পেলাম এক প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে একটা ফুল-ফোটা ক্রেপ মার্টল্ গাছের ছায়ায় একখানা পুরনো বড় ভ্যান রাস্তার ডান দিকের বদলে বাঁ দিকে পার্ক করা। গাড়ির পেছনে একটা বাম্পার স্টিকার নজর কাড়ল। কাছে গিয়ে পড়লাম একটা সুন্দর উক্তি, ÔWhen the power of love will overcome the love of power, the world will know peaceÕ। অর্থাৎ, যখন ভালোবাসার শক্তি, শক্তির ভালোবাসাকে হার মানাবে তখন পৃথিবী সুখশান্তির মুখ দেখবে। এ বিখ্যাত কোটেশনটা জিমি হেন্ডরিক্স এর।
স্বীকার করতে আমার মোটেও লজ্জা নেই, জিমি হেন্ডরিক্সের নাম এর আগে আমি কখনো শুনিনি। বাসায় এসে আমাদের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, আসাদ, জিমি হেন্ডরিক্সের নাম শুনেছিস? সে বলল ÔHe was a prolific guitarist.Õ আমি যেখানে জিমি হেন্ডরিক্সের নামই শুনিনি, সেখানে তাঁর কোটেশন জানার বা পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কম্পিউটারে বসে গুগল সার্চ দিয়ে বুঝলাম, পাশ্চাত্য সঙ্গীত বিষয়ে আমি কত অজ্ঞ! জিমি হেন্ডরিক্স কোনও সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন গত শতাব্দীর একজন অত্যন্ত প্রতিভাবান ও সার্থক সঙ্গীত বিশারদ। কারো কারো মতে, জিমি হেন্ডরিক্স ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় একজন ইলেকট্রিক গিটারিস্ট। তিনি শুধু গিটারই বাজাতেন না, তাঁর সাথে অনেক কালজয়ী গানও লিখেছেন। তাঁর একটা নিজস্ব রেকর্ডিং স্টুডিও ছিল। সেখান থেকে তিনি অসংখ্য গানের রেকর্ড উৎপাদন করে গেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের প্রশান্ত মহাসাগর তীরের সৌন্দর্যমন্ডিত সিয়াটল শহরে এক কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে ১৯৪২ সালের ২৭শে নভেম্বর জিমি হেন্ডরিক্সের জন্ম। প্রসঙ্গক্রমে আপনাদের জানিয়ে রাখতে চাই, এ সিয়াটল শহরেই আকাশচুম্বী সফলতা অর্জন করেছেন আধুনিক কালের দুই বিশ্বনন্দিত কর্পোরেট জায়েন্ট ও ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা - বোয়িং কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বিল বোয়িং এবং মাইক্রোসফটের বিল গেটস।
জন্মসূত্রে হেন্ডরিক্সের দেহে চেরোকি ন্যাটিভ ইন্ডিয়ান রক্তও ছিল। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জনি অ্যালেন হেন্ডরিক্স। ওই সময় তাঁর বাবা ছিলেন আমেরিকার সেনাবাহিনীতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে তিনি সম্মানের সঙ্গে চাকরি ছেড়ে বাড়িতে ফিরে আসেন, ইংরেজিতে যাকে বলে, Honorable Discharge। বাড়িতে এসেই হেন্ডরিক্সের বাবা, হেন্ডরিক্সের নাম বদলিয়ে তাঁর (হেন্ডরিক্স এর) প্রয়াত বড় ভাই লিওন মার্শাল হেন্ডরিক্সের নামের সাথে মিলিয়ে নতুন নাম রাখেন জেমস মার্শাল হেন্ডরিক্স - সংক্ষেপে জিমি হেন্ডরিক্স। জিমি হেন্ডরিক্সও পিতার মত মার্কিন দেশরক্ষা বাহিনীতে যোগ দেন এবং ১০১ এয়ার বোর্ন ডিভিশনের সদস্য হিসেবে বেশ কিছু দিন আমাদের বাড়ির কাছে কেন্টাকি অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট ক্যাম্বেলে কর্মরত ছিলেন। সেনাজীবনের কড়া নিয়ম কানুন জিমি হেন্ডরিক্সের একেবারেই ভাল লাগেনি, তাই অল্প দিন পর, বাবার মত তিনিও চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসেন।
জিমি হেন্ডরিক্স বেসামরিক জীবন শুরু করেন সঙ্গীতচর্চা ও গিটার বাজানো দিয়ে। সঙ্গীত জীবনের শুরুতে তিনি চলে যান ইংল্যান্ডে। গিটারিস্ট হিসেবে জিমি হেন্ডরিক্স প্রথম স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা পান ইংল্যান্ডে ও ইউরোপে। তাঁর ব্যান্ড গ্রুপের নাম ছিল - ‘জিমি হেন্ডরিক্স এক্সপিরিয়েন্স’। আস্তে আস্তে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে আমেরিকাতেও তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালের ÔMonterey Pop FestivalÕ - এ গান গাওয়া ছিল হেন্ডরিক্সের জীবনে সফলতার সবচেয়ে বড় মাইলফলক। এর পরে তিনি আমেরিকার বিভিন্ন শহরে আরো অনেকগুলো বড় বড় কনসার্টে গিটার বাজিয়ে হাজার হাজার দর্শক শ্রোতার কেবল প্রশংসাই কুড়িয়েছেন। এখনো আমেরিকা থেকে ইউরোপে তাঁর ভক্তের সংখ্যা অনেক বেশি। সঙ্গীতে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যে, জীবিত থাকা অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও তিনি অনেকগুলো দুর্লভ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৭০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর মাত্র ২৭ বছর বয়সে লন্ডনে এই গুণী শিল্পীর জীবনাবসান ঘটে।
হেন্ডরিক্সের জীবনী থেকে এবার ফিরে আসি তাঁর বিখ্যাত উক্তিতে। জিমি হেন্ডরিক্স কেবলই একজন গিটারিস্ট এবং সঙ্গীতজ্ঞই ছিলেন না, তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর শান্তি-বাদী উক্তি, (যা আমি শুরুতে উল্লেখ করেছি) নিঃসন্দেহে একটা অতি শক্তিশালী বাণী। সেদিন গাড়ির বাম্পার স্টিকারে হেন্ডরিক্সের কোটেশনটা পড়েই আমার কাছে মনে হয়েছিল অনেক দেশের মত আজকের বাংলাদেশেও ভালোবাসার বড়ই ঘাটতি চলছে। এখানে ভালোবাসা বলতে আমি সঙ্কীর্ণ অর্থে কেবল এক তরুণীর কাছে আরেক তরুণের প্রেম নিবেদনকে বোঝাচ্ছি না, বরং ব্যাপক অর্থে ভালোবাসা বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, সহমর্মিতা, সহৃদয়তা, সহযোগিতা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। বেশি বেশি ভালোবাসার চর্চা করলে বাংলাদেশের জনগণের পারিবারিক, সামাজিক, ও রাষ্ট্রীয় জীবন হতে পারে অনেক সুখের, শান্তির, আনন্দের!
যে পরিবারে মা-বাবা ছেলেমেয়েদের মধ্যে পারষ্পরিক প্রেম প্রীতি ভালোবাসা নেই, সে পরিবারে শান্তি আশা করা যায় না। একইভাবে যে সমাজে এবং দেশে মানুষে মানুষে নেই ভালোবাসা, সুচিন্তা, ও সহযোগিতা, সে দেশে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা থাকা তো খুবই স্বাভাবিক। যে দেশের রাজনীতিতে বোঝাপড়া, দেওয়া-নেওয়া, এবং পারষ্পরিক আস্থা ও সম্মানবোধ নেই, সে দেশের নাগরিক-জীবন বিষাক্ত হতে বাধ্য। আজকালকার বাংলাদেশে, ভালোবাসার শক্তি বড়ই দুর্বল। ভালোবাসার বাতিটা যেন একেবারে নিভু নিভু করে জ্বলছে। অবস্থাটা এমন যেন মৌমাছির ডানা ঝাপটার মত সামান্য বাতাসেই চিরতরে দপ্ করে নিভে যাবে সে বাতি।
পক্ষান্তরে, এ দেশে অহরহ দেখা যায় শক্তির ভালোবাসার মহড়া। সবার ভালোবাসা শক্তিহীন, কিন্তু তারা সবাই শক্তিকে ভালোবাসে, তাকে পূঁজো করে অন্ধ ভক্তের মতন। আর তাই এ দেশে দেখা যায় সবকিছুতে শক্তি প্রয়োগের মহোৎসব। শক্তি দিয়ে এবং শক্তির ভালোবাসা দিয়ে সবাই নিজেদের সব দাবি আদায় করে নিতে চায়। স্বামী জোর করে স্ত্রীর ভালোবাসা পেতে চায়। ব্যর্থ হলে স্ত্রীকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করে না, কারণ তার মাঝে ভালোবাসা আদৌ নেই। স্কুল-কলেজের বখাটে ছেলেরা শক্তি দিয়ে প্রেমিকার কাছ থেকে প্রেম আদায় করতে চায়। না পেলে তার চোখে মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারে, হত্যা করে। শ্রমিকরা মালিকের কাছ থেকে শক্তি দিয়ে বাড়তি বেতন-ভাতা পেতে চায়। না পেলে কারখানা ভাংচুর করে, ধ্বংস করে, নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারে। বিরোধী দল সরকারের কাছ থেকে জোর করে দাবি আদায় করতে চায়। সরকার শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে চাপের মুখে রাখতে চায়। কৌশলে ও গায়ের জোরে জনগণের অধিকার হরণ করে। এ টানাপড়েনের যেন কোনও শেষ নেই! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পরস্পরকে যুক্তি, তর্ক, ভালোবাসার পরিবর্তে শক্তি দিয়ে বশ করতে চায়। সুযোগ পেলেই শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর জোর-জুলুম চালায়, নির্যাতন করে, এমন কি খুন-গুম করতেও তাদের হাত-পা কাঁপে না। পদপ্রার্থীরা মানুষের জন্যে কিছু না করে, তাদেরকে ভালো না বেসে শক্তির জোরে অথবা টাকার জোরে নির্বাচনে জিততে চায়।
কী ঘরে কী বাইরে, বাংলাদেশের সর্বত্র আজ ‘শক্তির ভালোবাসা’র কাছে ‘ ভালোবাসার শক্তি’ মার খেতে খেতে দারুণভাবে পরাজিত, পর্যুদস্ত ও বিধ্বস্ত! এবং এ পরাজয় দেখতে হলে দূরে কোথাও যেতে হয় না। ঘরে বসেই দেখা যায়, ঘর থেকে বেরোলেও সাক্ষাৎ মিলে, দু’কদম হাঁটলেও যত্রতত্র পাওয়া যায় তার দেখা। দোকানপাট, অফিস আদালতে চলছে অহরহ এর খেলা। ভালোবাসার পরাজয় চারদিকে ঘটছে - অহরহ, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে! এ যেন নিত্য দিনকার ঘটনা - ঘটছে হর হামেশা - সদা সর্বদা। যে দিকে তাকাবেন, সে দিকেই দেখবেন শক্তির ভালোবাসার মহড়া, দেখবেন শক্তির পতাকা পৎপৎ করে উড়ছে, আর ভালবাসার পতাকায় বাতাস ধরে না - ঝিমিয়ে আছে - নেতিয়ে আছে। এ অবস্থায় জিমি হেন্ডরিক্স এবং তাঁর উক্তি আজকের বাংলাদেশের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, দেশ, এবং দেশের মানুষের জন্যে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে আমার মনে হয়। নয় কি?
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ। Email: wahid2569@gmail.com
|