‘জীবনের কলরব’ মিছে নয় / আবু এন এম ওয়াহিদ
আগের অংশ
বিকেল ঘনিয়ে এলে রাস্তা দিয়ে ছুটে রীতিমত জনস্রোত। আপিস-ফেরৎ মানুষ দলে দলে রওয়ানা দেন আপন আপন ঠিকানায়। আর বোঝাই যায় না, হঠাৎ কী করে, কোথা থেকে এত দোকানীরা এসে ভিড় করেন, দোকান বসান, পশরা সাজান একেবারে মূল রাস্তার ওপর। কেউ আলু-পেঁয়াজ-টমেটো বেচেন, কেউ কলা-মুলো, ফলফলাদীর দোকান খুলেন, কারো কারবার ফুচকা-চটপটির, কেউ জামাকাপড় টুপি নিয়ে বসেন, কেউ জুতো সেলাই করেন, কেউ তালা মেরামতে ব্যস্ত, রাস্তার ওপর কারো চুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে - রান্না হচ্ছে ভাত-তরকারি, কারো দোকান থেকে ধেয়ে আসছে ধোঁয়া আর তার সাথে চিকেন-কাবাবের পাগল করা খুশবু, খেতে বড় লোভ হত, কিন্তু সাহস পেতাম না অসুখ-বিসুখের ভয়ে, কষ্ট করে জিহ্বার জল সামলাতাম মুম্বাইয়ের রাজপথে। কারো দোকানে ক্রেতাদের লাইন লেগেই আছে, আবার কারো দোকানে কেউ নেই। ষোলো-সতেরো বছরের একটি ছেলে, কার্টে আইসক্রিম ও ফালুদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কোনো কাস্টমার নেই। শীতের সন্ধ্যায় ফালুদা খাবে কে? এ কথা কে বোঝাবে অবুঝ ওই ছেলেটাকে?
সবচেয়ে ব্যস্ত পানের দোকান - দেদারসে চলছে পানের খিলি ও বিড়ি-সিগ্রেট, আব্দুল খালেকের দম ফেলার সময় নেই, এক জন চায় পানের খিলি তো আরেক জন তামাক পাতা, তিনি নিজেও নিজের কাস্টমার, অনবরত পান চিবোচ্ছেন, তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম, একে তো ভাষার সমস্যা, তারপর তাঁর কি সময় আছে অজানা পথিকের সাথে কথা বলার? তবু দয়া করে নামটা বললেন আর জানালেন, তিনি উত্তর প্রদেশ থেকে এসেছেন। আব্দুল খালেকের একটি ছোট্ট ক্যাশ বাক্স আছে, তার তালাচাবিও আছে। আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দৈনিক কত কামাই হয়? প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে এমন একটি হাসি দিলেন, মনে হলো, জগতে আব্দুল খালেকের চেয়ে বুঝি সুখী মানুষ আর কেউ নেই! ব্যস্ততায় পানের পরেই চায়ের দোকান - আদা কুচি ও দুধ-চিনিতে জ্বাল দেওয়া ঘন সোনালী রঙের চা। চাওয়ালারা কেউ কেটলি ব্যবহার করেন না, চা বানানো হয় এলুমিনিয়ামের ডেগচিতে, তাঁদের একখানা ছাঁকনিও নেই, পাতলা কাপড়ে চা ছাঁকা হয়, ফুটপাথের এই চা খুবই জনপ্রিয়, খুবই মজাদার, রাস্তায় খাইনি, তবে হোটেলের ক্যাফেতে আসুদা হয়ে খেয়েছি মুম্বাইয়ের ‘চা মাসালা’। সন্ধ্যায় বাতি জ্বলে, আর রাস্তায় মেলা বসে, মুম্বাইয়ের ‘কুর্লা ওয়েস্ট’ যান চলাচলের সড়ক, নাকি বাংলাদেশে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা - তফাৎ নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়!
রাস্তায়, ফুটপাথে ময়লা-নোংরা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ, মশা-মাছি যাই থাকুক না কেন, সবই স্থির হয়ে চাপা পড়ে থাকে চলমান মানুষের পায়ের তলে। এগুলো নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই, নেই কোনো আক্ষেপ কিংবা ভ্রূক্ষেপ। ছোটবেলা থেকেই এসব দেখে দেখে তাঁরা অভ্যস্ত, পথের জঞ্জাল তাঁদের স্বাভাবিক জীবনেরই অংশ, ময়লা-আবর্জনাকে তাঁরা এভাবেই দেখেন। তাই, দিনের শেষে ঘরফেরা ব্যস্ত নাগরিকদের চোখেমুখে এসবের কোনো চিহ্ন ধরা পড়ে না। তাঁদের দেহে ক্লান্তি থাকে বটে, কিন্তু দিনের শেষে বাজার-বেসাতি হাতে নিয়ে বউ ছেলেমেয়ের কাছে ফেরার আনন্দ তাঁদের চেহারায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, হাসিমাখা মুখগুলো আলো ঝলমল করতে থাকে। এভাবে ব্যস্ত ও কর্মময় নাগরিক জীবনের কর্মচাঞ্চল্য ও গতিময়তার কাছে পথের ময়লা, মলিন হয়ে যায়, গৌণ হয়ে থাকে। জীবনের চঞ্চলতা ও উদ্দামতার কাছে বাকি সব ক্লেশকষ্ট, বিড়ম্বনা, ও ঝামেলা ক্ষণিকের জন্য হলেও হার মানে। ওই মুহূর্তে রবি ঠাকুরের কথা, ‘...সমাজ সংসার মিছে সব/মিছে এ জীবনের কলরব...’ অসার মনে হয়। মুম্বাইয়ের পথে জীবনের এ জীবন্ত কলবর, এর বহুমাত্রিক গতিময়তা, বিচিত্র বাস্তবতা ও চলমান উচ্ছলতা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।
পুনশ্চ: মুম্বাইয়ের সামান্য যেটুকু আমি দেখেছি তা নিয়েই লেখাটি লিখেছি। এর ওপর ভিত্তি করে, পুরো মুম্বাই এরকম, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
আগের অংশ
ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭ The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|