‘জীবনের কলরব’ মিছে নয় আবু এন এম ওয়াহিদ
মুম্বাইয়ের ফুটপাথে পানের দোকানদার আব্দুল খালেক
ছাত্রজীবনে সিলেট অথবা ঢাকা শহরে কিংবা বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রান্তে গরিব মানুষের কর্মময় নাগরিক-জীবন কাছ থেকে দেখার যে সুযোগ পাইনি তা নয়; পেয়েছি, দেখেছিও অনেক, কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখিনি, যাকে বলে ‘পর্যবেক্ষণ’, তা করতে পারিনি, করিনি। করিনি দুই কারণে - প্রথমত, অল্প বয়সে আমার চিন্তা শক্তি দুর্বল ছিল, দূরদৃষ্টি ছিল না, অন্তর্দৃষ্টি তো নয়-ই; দ্বিতীয়ত, জীবনকে গভীরভাবে বোঝার ও অনুভব করার সামর্থ্যও তখন অর্জন করিনি। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে, জীবনে চলার পথে, চলতে-ফিরতে পথেঘাটে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শিখেছি। পরিপক্কতা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা বেড়েছি কিনা জানি না, তবে অনুভূতি তীক্ষ্ণ হয়েছে, মানুষের জীবন ও জীবনবোধ সম্বন্ধে আমার স্পর্শকাতরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসবের সুবাদে আজকাল যখন কোনো খেটে খাওয়া, দিন-আনা দিন-খাওয়া শহুরে মানুষকে কর্মরত অবস্থায় দেখি, তখন মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াই, শ্রদ্ধাভরে তাঁকে সালাম জানাই, কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকি, আপাদমস্তক অবলোকন করি, তাঁর শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম এবং চোখেমুখে প্রকাশিত ক্লান্তির আড়ালে আত্মতৃপ্তি ও প্রশান্তির এক ঝাঁক সোনালী আলোক রেখা দেখতে পাই!
ভাবি, তাঁরই মায়ের গর্ভে আমারও তো জন্ম হতে পারত! আমার ভাগ্যলিপি তাঁর চেয়ে করুণও হতে পারত, আর হলেই বা করার কী ছিল? ক্ষতিই বা কী ছিল? আমি কি ওই মানুষটির চেয়ে খুব একটা ভালো আছি? সুখে আছি? সুখের সংজ্ঞাই বা কী? এক জনের উপযোগিতা, সুখ, শান্তি ও আনন্দ কি আরেক জনের সঙ্গে তুলনা করা চলে? দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীদের মাঝে এসব নিয়ে তর্কবিতর্কের শেষ নেই! প্রাসঙ্গিক হলেও সে তর্কে আমি যাব না, গিয়ে খুব একটা লাভও নেই, কারণ আমি বিশ্বাস করি, মানব জীবনে যত বড় বড় ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে তার ওপর ব্যক্তির কোনোই নিয়ন্ত্রণ থাকে না; আর তাই বাদবাকি মামুলি বিষয়াদি নিয়ে পেরেশানি করার কী-ই বা যুক্তি থাকতে পারে? জীবনকে জীবনের মতই দেখা উচিৎ, সুখ-দুঃখ সব কিছু সব সময় সমানভাবে হাসিমুখে বরণ করা নেওয়াই ভালো, ইংরেজিতে যাকে বলে, 'Coming to terms with life.'
তত্ত্বকথা বাদ দিয়ে এবার মূল কথায় আসা যাক। আজ আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি বাস্তব জীবনের নতুন এক অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে। এ অভিজ্ঞতা আমার জীবনোপলব্ধিতে এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়ে গেছে। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও একটি স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দাওয়াতি বক্তৃতা উপলক্ষে এবারকার শীতের ছুটিতে আমি ভারতের মুম্বাই গিয়েছিলাম। যে ‘মুম্বাই’-এর পটভূমিতে শাহরুখ খান ও মাধুরী দীক্ষিতকে রূপালী পর্দায় নাচতে দেখা যায়, এ মুম্বাই সে ‘মুম্বাই’ নয়; এ মুম্বাই ভিন্ন এক মুম্বাই। এবার এই মুম্বাইয়েরই এক কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম একাধারে ৫ দিন। এই সুযোগে প্রাচীন এই বন্দর নগরীর ফুটপাথের পানের দোকানদার আব্দুল খালেক ও তাঁর মত আরো কয়েকজন অতি সাধারণ মানুষের সাথে আমার ‘অসাধারণ’ সাক্ষাৎ ঘটেছে! ‘অসাধারণ’ বলছি এ জন্য যে, একই রকমের মোলাকাত ও মোয়ামেলাত এর আগে আমার অনুভূতিকে এমনভাবে নাড়া দেয়নি, হৃদয়কে ছুঁয়ে যেতে পারেনি। মুম্বাইয়ে দেখেছি আধুনিক নাগরিক জীবনের বিচিত্র এক চিত্র; দেখেছি রাস্তায় নিচুতলার মানুষের চলাচল; তাঁদের বেচাকেনা, কর্মচাঞ্চল্য ও তাঁদের জীবনের বহুমাত্রিক গতিময়তা। আর এসব নিয়েই রচিত হয়েছে আমার আজকের এই ক্ষুদ্র কাহিনী।
মুম্বাইতে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল ছত্রপতি শিবাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিকটে চার তারকা ‘হলিডে ইন’ হোটেলে। অভিজাত হলেও হোটেলটির অবস্থান কোনো অভিজাত এলাকায় নয়; দেখলাম, এর চারদিকে সাধারণ গরিব মানুষেরই বসবাস। হোটেলের গা ঘেঁষে পশ্চিম দিকে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু দু’টো দালান। বাহির থেকে দালানগুলোর ময়লাযুক্ত জরাজীর্ণ দশা ও তাতে বসবাসকারীদের জীবনমানের চালচিত্র দেখে মনে হলো সেখানে গরিব মানুষরাই থাকেন, বড়জোর তাঁদেরকে নিম্নধ্যবিত্ত বলা যায়, এর বেশি কিছু নয়। পূর্বদিকে হোটেলের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি সরু গলি, গলির উল্টোদিকে একটি মাঝারি আকারের বস্তি। বস্তিটি খড়কুটোর তৈরি ঝুপড়ি ঘরের সমাহার নয়, বরং সেগুলো এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা অতি পুরনো, কোথাও ভেঙ্গে পড়া, কোথাও ক্ষয়ে যাওয়া ইটের দেয়ালের ওপর কোনো রকম দাঁড়িয়ে আছে। সেই সব ঘরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেসব হতভাগা নারী-পুরুষ সংসার পেতেছেন তাঁদের মাথার ওপরে আছে জং ধরা পুরনো টিনের ছাউনি। হোটেলের রুম থেকে বড় কাচের জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, টিনের ছাদে জায়গায় জায়গায় রঙ বেরঙের প্লাস্টিক বিছিয়ে তার ওপর এলোপাথাড়ি ইট-পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে প্লাস্টিকের আবরণ ঝড়-বাতাসে উড়ে পড়ে না যায়, ঘরে বৃষ্টির পানি অঝোরে না ঝরে। চিপা গলির নাম ‘কুর্লা ওয়েস্ট’, তার উল্টো দিকে বস্তির অন্য পাশ দিয়ে সোজা চলে গেছে শহরের একটি ব্যস্ততম চওড়া রাস্তা - যার নাম ‘সাকিনাকা’।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই আমি মুম্বাইয়ের ব্যস্ত নগরজীবন সরজমিনে দেখার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়তাম। ‘কুর্লা ওয়েস্ট’ ও ‘সাকিনাকা’-ই ছিল আমার দৈনন্দিন ভ্রমণের পথ। কর্মচঞ্চল মানুষের ভিড় ঠেলে ঠেলে উভয় সড়ক ধরে আমি নিয়মিত মাইল খানেক হাঁটতাম। কোনো ভাঙ্গা ঘরের দুয়ারে, তার আশেপাশে - ফুটপাথে, কিংবা ঘরের পেছনে লোকজনের বিকিকিনি দেখতাম; ওই সব জায়গায় জোয়ান-বুড়ো, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের নানা কর্মকাণ্ড উপভোগ করতাম; দোকানীদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম; মাঝে মাঝে কোনো ভাসমান দোকান থেকে নিজের জন্য কলা, কমলা, ইত্যাদি কিনেছিও। তাঁদের সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করেছি, কিন্তু উর্দু-হিন্দিতে আমার দৈন্যতার কারণে কার্যকর ভাবে ওই সংগ্রামী মানুষগুলোর সাথে ভাবের কোনো আদান-প্রদান হয়নি। এ সীমাবদ্ধতাকে মাথায় রেখেই এবার বলছি, মুম্বাইয়ের রাজপথে, কাদের সাথে আমার দেখা হয়েছে, সেখানে আমি কী কী দেখেছি, জীবনের পাঠশালা থেকে কী পাঠ নিয়েছি, কী-ই বা শিখেছি?
‘কুর্লা ওয়েস্ট’ একটি চিকন এক লেনের ‘ওয়ান ওয়ে’ সড়ক, কোনো রকম একমুখী হয়ে একটি মাত্র গাড়িই চলতে পারে। তবে এক কালে চললেও আজকাল এ রাস্তা দিয়ে আর তিন বা ততোধিক চাকার যন্ত্রচালিত কোনো যানবাহন চলাচল করে না, করতে পারে না। কেবলই চলে ঠেলাগাড়ি, ভেন্ডিং কার্ট ও বাইসিকল; আর অগণিত মানুষের পাদচারণা তো আছেই; কদাচিৎ চলমান মোটরবাইকে দু’এক জন যাত্রীর দেখা পাওয়া যায়। এর মানে ঐতিহাসিক মুম্বাই নগরীর ওই রাস্তাটি মরে গেছে। তলদেশে জমাটবাঁধা পলি, বর্জ্য নিক্ষেপ ও পানি দূষণের ফলে বাংলাদেশের অসংখ্য নদী যেমন মরে গেছে, মুম্বাই নগরের একটি চলমান রাস্তা হিসেবে ‘কুর্লা ওয়েস্ট’-ও সেভাবে মরে গেছে। মরার কারণ স্বরূপ আমি যা দেখেছি তা ভাষায় বর্ণনা করা বড়ই কঠিন।
মূল রাস্তা যেমনই থাকুক, তার দু’পাশে দু’টো ফুটপাথ আছে, কিন্তু ফুটপাথের অবস্থা রাস্তার চেয়ে আরো করুণ। ফুটপাথ ধরে পথচারীদের হাঁটাচলা করার কোনো উপায় নেই। এর ওপরে আছে পানের দোকান, চায়ের দোকান, আরো আছে রসের দোকান; এখানে রসিকজনরা রস খেতে আসেন, তাঁরা পয়সা দিয়ে রস কিনেন, দিন-দুপুরে এক হাতে কপালের ঘাম মুছেন, আরেক হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক গেলাস ঠাণ্ডা রস খান - ঘন মিষ্টিমধুর আখের রস। দোকানের সামনে এমন কাস্টমার কখনো বেশি, কখনো কম, সব সময় থাকেনও না, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, রসের দোকানে বিনে পয়সার খদ্দেররা সব সময় ভিড় করে থাকে, তারা ভনভন করে ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়ে, আবার বসে, যত্রতত্র বসে, রসওয়ালার রসালো শরীরেও বসে, রসিয়ে রসিয়ে আখের রস খায়। কেউ তাদের বাধা দেয় না, তাড়া করে না। মাছি, সে তো মাছি নয়, এ যেন ব্যস্ত জনজীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, একটি অলঙ্কার, এ যেন সৌন্দর্যের এক কৃষ্ণকায় প্রলেপ!
এই ফুটপাথ কারো জন্য মুনাফার দোকান, কারো জন্য কেনাকাটার জায়গা, কারো জন্য ঘরের বারান্দা। এখানে এমন ঘটনাও বিরল নয় যে, ঘর থেকে বের হয়েই ফুটপাথে শিশুরা খেলছে, গুড়মুড়ি খাচ্ছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে, গলা ছেড়ে কাঁদছে। কারো জন্য এই ফুটপাথ নির্মাণ-সামগ্রী রাখার নিরাপদ গুদাম। কেউ থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন, ইট, বালু, পাথর, ইত্যাদি। কারো ঘরে জায়গা নেই, তিনি তাঁর ভাঙা মোটর সাইকেল, ছেঁড়া বাক্স, ব্যবহার অনুপযোগী সোফাসেট সযত্নে তুলে রেখেছেন ফুটপাথের ওপর। এ ছাড়া কোথাও কোথাও স্তুপাকারে জমে আছে স্রেফ ধুলোবালি ও ময়লা-আবর্জনা, যেখানে মাছি ঘোরাঘুরি করে, ক্ষুধার্ত কুকুর উচ্ছিষ্ট খুঁজে, কাকের দল কা কা করে ওড়া-উড়ি করে, কখনো মানুষ কুকুরের ভয়ে তাদের ন্যায্য হিস্যায় ভাগ বসাতে পারে না।
আরো মজার ব্যাপার, হয়তো বা কোনো পাখির বিষ্ঠা থেকে ফুটপাথের কোনো ফাটলে গজে উঠেছে একটি ছোট্ট বটের চারা। কে বা কারা চারাগাছকে সেবাযত্ন দিয়ে বড় করেছেন। পূজারীরা বটের গোড়ায় দেবতার আসন পেতেছেন, মূর্তি বসিয়েছেন, পুজোর ব্যবস্থা করেছেন। বটের গোড়ায় ফুটপাথের ওপর ছড়িয়ে আছে পুজোর অর্ঘ্য নানা জাতের, নানা বর্ণের শুকনো ফুল। এভাবে সরকারি ফুটপাথে গড়ে উঠেছে বেসরকারি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উপাসনালয়। রাস্তায় অগণিত ব্যস্ত মানুষের পথচলা, চলতে চলতে কেনাকাটা, নাগরিক জীবনের নানা কর্মচাঞ্চল্য এবং পুজো-অর্চনা এমনি করে একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মুম্বাইয়ের রাজপথে। এমন দৃশ্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে, অন্য কোনো নগরীতে আছে কিনা আমার জানা নেই।
যে-সব দোকানীর একটু আধটু নাগরিক জ্ঞান ও বিবেক-বিবেচনা আছে, তাঁরা তাঁদের দোকানের সামনে, ডানে-বাঁয়ে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে রেখেছেন, একটু হলেও মানুষজন দু’কদম হাঁটতে পারেন, সেখানেও দেখেছি অন্য উপসর্গ, অন্য সমস্যা। জনমানুষের পায়ে চলার পথে কোথাও পড়ে আছে সিমেন্টের চ্যাপ্টা ব্লক, কোথাও বা পুরনো টায়ার। ফুটপাথে এগুলো কি অকারণে পাতা হয়েছে? না, তা নয়, এরও যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এ-সব দিয়ে ফুটপাথের ‘পটহোল’ ও ‘ম্যানহোল’-এর উনমুক্ত মুখ ঢেকে রাখা হয়েছে। কী ডান, কী বাম, দু’দিকের ফুটপাথের এই একই অবস্থা। এ-সব আবরণের পরও নজরে পড়ে, কোনোখানে ফুটপাথের ইট ক্ষয়ে গেছে, কোথাওবা কেউ ‘মহামূল্যবান’ ইটগুলো তুলে নিয়ে গেছেন, কে জানে, হয়তো বা ওই সব ইট দিয়ে হেঁশেলে চুলো বানিয়েছেন, মনের সুখে ভাত রান্না করে খাচ্ছেন। ফুটপাথ থেকে ইট খোয়া যাওয়া দেখে পথ চলতে চলতে একা একা হাসলাম, মনে পড়ল আতাউর রহমান স্যারের রম্য রচনা, ‘আমারটা আমি লইয়া গেলাম’। ‘কুর্লা ওয়েস্ট’-এর ফুটপাথের নিত্য দিনের এমনই চিত্র! রাস্তা পরিষ্কার করার কেউ নেই। করুণ এ অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যেন নগরের কোনো পিতা নেই, মাতা নেই, ভ্রাতা নেই, নেই কোনো নগর সরকার!
পরের অংশ
|