ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে এক বিকেলে আবু এন. এম. ওয়াহিদ
জুলাই মাসের শেষ দিকে এবার ব্রুনাই যাত্রায় আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল ইস্তাম্বুলের নতুন এয়ারপোর্টটি দেখে যাওয়া। ঐতিহাসিক এই নগরীর পুরাতন ‘কামাল আতাতুর্ক’ বিমানবন্দর হয়ে আমি অনেকবার যাওয়া-আসা করেছি। ইদানীং নতুনটির কথা অনেক শুনি, কিন্তু ও-দিকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এবার হলো এবং দেখলাম, কাজ ৬০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকিটা পুরো হলে এটা না কি দুনিয়ার সব চেয়ে বড় বিমানবন্দর হবে, আর তাই এত কৌতূহল। এ ছাড়াও অন্য একটা কারণ তো ছিলই - লাউঞ্জে মজার মজার হরেক রকম টার্কিশ খাবার খাওয়া। ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে ‘টার্কিশ এয়ার’-এর লাউঞ্জের মতন খানাপিনার এত বিস্তারিত আয়োজন আমি অন্য কোনো লাউঞ্জে পাইনি। সত্যি, এ হলো তাঁদের সুলতানি আমলের খান্দানি ঐতিহ্য! এখানে প্রক্রিয়াজাত বা টিনজাত খাদ্য সামগ্রীর ব্যবহার খুব একটা নেই। যা পরিবেশিত হয়, তার প্রায় সবই তাজা ফলফলাদি-সবজি অথবা সদ্য রান্না করা গরম গরম উপাদেয় খাবার, অবশ্য মিঠাই জাতীয় নানা পদের বেলা একটু ব্যতিক্রম আছে বৈকি।
এবার হাতে সময় বেশি ছিল না, তবু লাউঞ্জে ঢোকার আগে টার্মিন্যাল ভবনটি ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। টার্মিন্যাল বিশাল বড়! লম্বা লম্বা ৫/৬টা কনকোর্স আছে। দেখে ও গুনে সব শেষ করতে পারিনি। একেকটি কনকোর্সের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে গেলে হাঁটতে হাঁটতে পথ ফুরায় না। ডানে-বাঁয়ে-র বৈচিত্র্যময় রঙ-ঢঙ দেখতে লাগলে নির্ঘাত ফ্লাইট মিস। ভাগ্যিস, আমি আমার দুবাই-সংযোগ ফ্লাইট মিস করতে করতে ধরতে পেরেছিলাম! এয়ারপোর্ট দেখতে গিয়ে পদযুগলের ওপর ভর করে চলতে চলতে এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। মূল ভবনের বাইরে সম্প্রসারিত এক মেঝের ওপর একটি ব্যালকোনি। জায়গাটা বেশি বড় নয়, আর আসবাব পত্রেরও কোনো বালাই নেই। ঠাসাঠাসি করে আনুমানিক শ’খানেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই আনমনে বাইরের দিকে রানওয়ের পানে খুব উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছে! কৌতূহল বশত কাচের দরজা ঠেলে আমিও ভিড়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। দেখলাম, পায়ের তলায় পাকা ফ্লোর আছে বটে, কিন্তু মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই, তিন দিকে তারের জালির বেড়া - যেন একটি খাঁচায় বন্দি মানুষগুলো। এই ভিড়ের মধ্যে পা রেখেই বুঝলাম, সবাই ধুমসে ধূমপানে মগড়ব! ধোঁয়া দেখা যায় না, তবে সিগারেট-পোড়া গন্ধে টিকতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ধূমপায়ীদের প্রতি এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের এত বিরাগ এ জগতে আর কোথাও নজরে পড়েনি। বসার তো কোনো ব্যবস্থা নেই-ই, তার ওপর বাদলা দিনে ধূমপায়ীদের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই সিগারেটে সুখটান দিতে হবে। সিগারেট-ধারীদের কাছে ধোঁকা খেয়ে অনুভব করলাম, আমার খিদে পেয়েছে।
এ বার সোজা চলে এলাম লাউঞ্জে - ‘প্রিমিয়ার’ লাউঞ্জ, এলাহি কাণ্ড-কারখানা। জায়গাটা অনেক বড়, দুই-আড়াই শ’ মানুষ সহজে আরামসে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন, খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। অতিথিদের জন্য টিভি, গান-বাজনা, বিনোদনেরও ব্যবস্থা রয়েছে, তবে উল্টো দিকে। লম্বা হলঘরে আলো-আঁধারির মাঝে সঙ্গীতের মূর্ছনায় আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে আরাম করা এবং নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার কী চমৎকার নিরিবিলি আয়োজন! তারও পেছন দিকে পর্দা টানা কয়েকটি ফ্যামিলি-ক্যাবিন, পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, হোটেলের মতন খাটে বিছানা-বালিশও সাজানো রয়েছে। এমন আয়েস ইউরোপ-আমেরিকার অন্য কোনো এয়ারপোর্টেও আছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
ডাইনিং এরিয়াতে এসে দেখি, পরিবেশটি খুব ছিমছাম, সাজানো গোছানো। চুলা, ডেকচি-পাতিল সব নতুন নতুন। চেয়ার-টেবিল সোফা ঝকঝকে তকতকে। কেউ খেয়েদেয়ে সোফায় বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছেন, কেউ জরুরি কাগজপত্র - বোর্ডিং পাস, পাসপোর্ট মিলিয়ে নিচ্ছেন, কেউ স্মার্ট-ফোনের পর্দায় আঙ্গুল ঘষছেন, ভোজন রসিকরা তো খেয়েই চলছেন, কারো সামনে সাদা পানি কিংবা জুস অথবা সোডার বোতল। অবাক হলাম, লাল পানির কোনো আয়োজন চোখে পড়ল না। কত জাতের কত খাবার! - শুমার করার সাধ্যি কার? চার দিক থেকে রান্নাবান্নার তোড়জোড় ও বসানকোসনের ঠুংঠাং আওয়াজ গানের মতন কানে এসে বাজছে, আর নানান কিসিমের খাবারের খুশবু মিলেমিশে একাকার হয়ে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মনটাকে কানায় কানায় ভরিয়ে দিচ্ছে! এমন পরিবেশে যার খিদে নেই সেও খেতে চায়, খায়-ও। যার পেট ভরা, সে চোখের খিদেয় যতটা না পেটে পুরে তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে। আহা! খাদ্যদ্রব্যের কী অপচয়!
এখানে ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে ধুন্ধুমার কাজ চলে। রাত-দিন সব সময় একই অবস্থা- মানুষ গম গম করে যেন বিয়ে বাড়ির আমেজ লেগেই আছে! মেলার মতন ঘুরে ঘুরে আমার পছন্দের খাবার অল্প অল্প করে গলাধঃকরণ করে অবশেষে এলাম আসল জায়গায়, আমার প্রিয় জায়গায় - ‘কোফতা-কাবাব’-এর স্টলে। কাবাব গ্রিল হচ্ছে, ধোঁয়া উড়ছে, হিসহিস (সিজ্লিং) আওয়াজ উঠছে, আর সুস্বাদু ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে! আমার মতন যারাই এই পাগল করা খুশবু পায়, তারাই নিঃশব্দে কাবাবের লাইনে এসে দাঁড়ায়। প্লেটখানা এগিয়ে ধরলে গ্রিল থেকে তোলা কাবাব সরাসরি পরিবেশন করা হয়। এই কাবাব মাখন-মাখা আঠালো গরম ভাতের সাথে খেতে বড় মজা! বন্ধু মাহবুব যখন এ লেখা পড়বে তখন আমাকে মনে মনে বকা দেবে। কেন, সে সব কথা আর এখানে নাই বা পাড়লাম। খেতে খেতে কাবাব-ওয়ালার সাথে কথা বলছিলাম। জানতে চাইলাম, পুরনো এয়ারপোর্ট থেকে এখানে এসে তাঁর কেমন লাগছে? ‘সব কিছু একই রকম আছে, শুধু পার্থক্য হলো, নামটা ওখান থেকে এখানে আসেনি’, সংক্ষেপে জবাব দিলেন, তিনি। আমি অনুরোধ করলাম, একটু বুঝিয়ে বলবেন? এবার তাঁর মনের কথা আরেকটু খোলাসা করলেন। বললেন, ‘পুরাণ এয়ারপোর্টের নাম ছিল ‘কামাল আতাতুর্ক’ বিমানবন্দর আর এটার নাম - শুধু ‘ইস্তাম্বুল’। আমি একটি প্রতিক্রিয়া দিলাম। বললাম, আপাত, ‘ইস্তাম্বুল’, পরে এটার নাম হতে পারে, ‘এরদোগান’ বিমানবন্দর। শুনে তিনি মুচকি হেসে তড়িৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন।
ভাবলাম, তুরস্কের পিতাকে ভুলতে সন্তানদের ১০০ বছরও লাগেনি! এখানে কী বলবেন? পিতার ভুল, না কি সন্তানরা অকৃতজ্ঞ। বিষয়টি আমি যে ভাবে দেখি, ভুল-ত্রুটির কথা নয়, কথা অন্যখানে। প্রয়াত পিতা যেমন ছিলেন তেমনই আছেন, তাঁর অবদান ও দোষ-গুণের তো কোনো হের ফের হয়নি। যা হয়েছে তা হলো, সময়ের সাথে সন্তানরা যে বদলে গেছে! বদলে গেছে চিন্তাভাবনায়! বদলে গেছে মন-মানসিকতায়! বদলে গেছে অনেকখানি!
আগস্ট ৭, ২০১৯
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|