হেমনগরের হিমেল হাওয়া / আবু এন এম ওয়াহিদ
আগের অংশ
আজ যে-দিনের বয়ান দিয়ে শুরু করতে চাই, সে এক ফকফক রোদ ঝলমল বিকেল। শশীমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে উত্তরমুখী হয়ে দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে চ্যাপ্টা ঘাসে জমেছে আড্ডার আসর। ততক্ষণে জায়গাটি এক মায়াময় ঘন ছায়ায় ঢেকে ফেলেছে! ছায়াটি স্কুল-ঘরের নাকি মাথার ওপরের শিমুল গাছের, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। পারিপার্শ্বিক পরিবেশে একটা থমথমে গুমট গুমট ভাব। কোনো হাওয়া নেই। গাছের পাতায় নড়াচড়া নেই। দীঘির পানিতে নেই কোনো অস্থিরতা, শুধু কয়েকটি হাঁস উল্টোদিকে ঈশান কোণে আনন্দে জলকেলিতে মত্ত। আমাদের মাঝে এক দিকে ভ্যাঁপসা গরমের যন্ত্রণা, আরেক দিকে তাজা রসালো আড্ডার মাদকতা মিশ্রিত আকর্ষণ ও উত্তেজনা। দু’য়ের সংমিশ্রণে গরমের কষ্ট অনেকটাই উবে গেছে। আসরে উপস্থিত ছিলেন কমসে কম আরও চার-পাঁচ জন। এর মাঝে শুধু দু’জনের নাম আজ স্পষ্ট মনে পড়ে। তাঁদের এক জন বন্ধু-সহকর্মী শাহাবুদ্দিন, আরেক জন জনাব আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। যাঁদের নাম বলতে পারলাম না, আশা করি ভুল করে ভুলে যাওয়ার জন্য তাঁরা আমাকে মাফ করে দেবেন। শাহাবুদ্দিন ও অন্য যারা ছিলেন তাঁদের সাথে আমার সখ্য বেশ কিছু দিনের, পক্ষান্তরে কাশেম ভাইয়ের সাথে বস্তুতপক্ষে আমার পরিচয়, জানাশোনা ও বন্ধুত্ব প্রথম বারের মত গড়ে ওঠে হেমনগর সফরের ওই তৃতীয় পর্বেই। দীর্ঘ দিনের পরিচয় না হলেও, সফরের সময়ে দিনে এক সাথে চলাফেরা ও রাতে স্কুল-ঘরের একই কামরায় থাকা, খাওয়াদাওয়া ও সর্বোপরি কাশেম ভাইয়ের মনখোলা স্বভাব ও অমায়িক ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মাতে অসুবিধাও হয়নি, দেরিও হয়নি।
ওই দিন তিনিই ছিলেন আমাদের আড্ডার মধ্যমণি। তিনি যে শুধু আড্ডার আসরেরই প্রাণপুরুষ ছিলেন তাই নয়, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত ইতিহাসের এক মহানায়ক ও প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। অনেকে হয়ত জানেন না, এই সাহসী মানুষটি শুরু থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এবং এর প্রথম খবর-পাঠকও ছিলেন। উত্তাল মার্চের সেই রক্তঝরা শেষ দিনগুলোতে তিনি কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সরজমিন উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম....’, এই জনপ্রিয় গানটি তাঁরই লেখা। ছোটখাটো এই ত্যাগী বীরের ঠোঁটের ওপর ছিল হালকা মোচের রেখা আর তাঁর মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকত। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, সাহিত্যচর্চা, গণশিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা, সাক্ষরতা, ইত্যাদি ছিল তাঁর জীবনের নেশা ও পেশা। কী করে, কী শর্তে, কতদিনের জন্য তিনি আমাদের এনজিও - ‘ভিইআরসি’-তে যোগ দিয়েছিলেন তা আমি জানতামও না এবং কখনো তাঁকে জিজ্ঞেসও করিনি। এ লেখা লিখতে গিয়ে ‘উইকিপিডিয়া’ ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, তিনি আমাদের অফিসে কাজ নিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ-সমন্বয়কারী ও উপ-পরিচালক হিসেবে।
সেদিনকার লম্বা আড্ডায় যত কথা, যত গল্প, যত হাসিঠাট্টা ও মশকারা হয়েছিল তার কিছুই আমার মনে নেই। যা আছে, তা শাহাবুদ্দিন ও কাশেম ভাইয়ের বৈবাহিক জীবনের অতি ব্যক্তিগত কিছু বয়ান যা এখানে লিখা যায় না। আর এ কারণেই শুধু এ দু’জনের নাম আজও আমার মনে আছে। আমি আজ ওই আড্ডার বাকি সব বিষয়বস্তু ভুলে গেছি বলে আমার কোনো দুঃখ নেই, কিন্তু আফসোস হচ্ছে, যে গল্প সেদিন হতে পারত তা হয়নি বলে। এবার আপনারা বলবেন, কী গল্প হতে পারত? আমি যদি বলি, আবুল কাশেম সন্দ্বীপের মত এক জন মানুষের উপস্থিতিতে কী না হতে পারত! মুক্তিযুদ্ধের কত গুরুত্বপূর্ণ কথা, কত তথ্য, কত কষ্ট, কত সমস্যা, কত জটিলতা, কত কুটিলতা ও হাসি-কান্নার কথা তাঁর কাছ থেকে সরাসরি জানতে পারতাম, কিন্তু কিছুই জানা হলো না! কেন হলো না, তার দু’টো কারণ- প্রথমত, আমি আদৌ জানতাম না যে, কাশেম ভাই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির এত বড় এক জন বেসামরিক সৈনিক ছিলেন! সহকর্মীদের কেউও এ-কথা আমাকে বলেননি। তাঁরাও জানতেন কি না, তাও আমি জানি না। আবুল কাশেম সন্দ্বীপের এই পরিচয় আমার কাছে প্রকাশ পেয়েছে অনেক পরে, ১৯৯৫ সালে তাঁর ইন্তেকালেরও পরে।
দ্বিতীয়ত, কাশেম ভাই ভীষণভাবে একজন নিরহঙ্কারী ও আত্মপ্রচার বিমুখ মানুষ ছিলেন। নিজের কথা নিজের মাঝে যত্ন করে ধরে রাখতে তাঁর জুড়ি ছিল না। আমার বিবেচনায় তিনি একটি ভুল করে গেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা তো তাঁর নিজের কথা নয়, গোপন কথাও নয়। এ যে দেশের কথা, দশের কথা, জাতির কথা, আপনার আমার সবার কথা। তাঁর জানা সত্য কথা, সত্য ঘটনা, সত্য ইতিহাস ছড়িয়ে দিলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহরহ যে-সব অহেতুক বিতর্ক হয়, তা কিছুটা হলেও হয়তো বা কমতে পারত। এমনি একটি আড্ডায় স্বাধীনতা যুদ্ধের এত বড় এক অংশী-জন হয়েও কাশেম ভাইয়ের কথাবার্তা ছিল অতি সাধারণ, সাদাসিধে এক জন মানুষের মতন। এই আড্ডা বাদেও, যে কয়দিন এক সাথে ছিলাম, রাত-দিন অন্তরঙ্গ পরিবেশে তাঁর সঙ্গে কত কথা বলেছি, কত হাসাহাসি করেছি, কত ফাজলামি করেছি, অথচ ঘুণাক্ষরেও কখনো তাঁর মুখ থেকে বের হয়নি যে, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের এক জন একনিষ্ঠ কণ্ঠ-সৈনিক। তাঁর ভেতর মুক্তিযুদ্ধের জ্ঞানভাণ্ডারের যে সিন্দুক ছিল তিনি তা সচেতনভাবে সযত্নে তালা মেরে রেখেছিলেন। ভুলেও কোনো দিন সে তালা খুলেননি। আশ্চর্য এই মানুষটি! কী করে এত কথা গোপন রাখলেন! মুক্তিযুদ্ধের একটি কথাও আমাদের জানতে দিলেন না! এত কথার মাঝে, এ নিয়ে তিনি একটি বাক্য নয়, একটি শব্দ নয়, একটি অক্ষরও উচ্চারণ করেননি। কেন করেননি, আমার কাছে এ এক গভীর রহস্য! আমি জানি না, তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপর কোনো বই লিখে গেছেন কিনা। যদি লিখে থাকেন, তাহলে আমার এই আহাজারির যৌক্তিকতা অনেকটাই হ্রাস পায়।
পরবর্তী যে ঘটনাটি আজ আবছা আবছা মনে পড়ছে, সংক্ষেপে তা এইরূপ: এক রাতে স্কুলঘরে গ্রামের লোকজন গানের আসর বসিয়েছেন। স্থানীয় কারো বাড়ি থেকে হারমোনিয়াম ও তবলা আনা হলো। গান শুরু হলো মাগরিবের পরে। গ্রামের জোয়ান-বুড়ো সবাই মিলে গান গাইলেন। কী ধরনের গান হয়েছিল, সে-সব কথা মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে, যার যার ইচ্ছে মত সবাই গান ধরেছেন - কেউ সুরে, কেউ বেসুরে গাইলেন, কারো তাল ঠিক ছিল, কারো তাল কাটা। এতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি এবং আমি এতটুকু বিরক্তও হইনি। ওই আসরে বসে বসে আমি ভেবেছি অন্য কথা, যমুনা-পাড়ের একটি অজ পাড়া গাঁয়ের মানুষ - তাঁরা হারমোনিয়াম-তবলা জোগাড় করেছেন, বাজাতে পারেন আর নাই বা পারেন, সাহস করে ধরেছেন তো। আমার গ্রামে, কি তার আশপাশ চৌদ্দ গ্রাম খুঁজেও একটি হারমোনিয়াম পাওয়া যাবে না। দশ জন মানুষের সামনে বসে যন্ত্র বজানো ও গলা ছেড়ে গান গাওয়ার লোক পাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। (তবে আমাদের অঞ্চলে পুঁথি-পড়া ও কবিগানের লোক ছিল। আজকাল হয়তো গ্রামে গান-বাজনা হয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত, পুঁথি পাঠক ও কবিয়াল আর পাওয়া যাবে না। দেখুন, এখানেও বাণিজ্য - কিছু এলো, তো বাকি কিছু গেল)। এর চেয়ে বড় কথা, সেদিনকার গানের গুণমান যাই হোক না কেন, দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি দেখিনি! গানের আয়োজনে সবচেয়ে উৎসাহী ছিলেন মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক, তিনি গানও গেয়েছিলেন, তিনি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতেন, তাঁর সাথে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের দেখা হত। একদিন দুপুরে নিজ বাড়িতে আমাদের ডেকে নিয়ে ভাত খাইয়েছেনও, সময় পেলেই তিনি আমাদের ডেরায় চলে আসতেন, গল্প করার জন্য। দুঃখিত, তাঁর নামটাও আজ ভুলে গেছি। হয়তো তিনি আজ বেঁচেও নেই।
আমাদের সহকর্মীদের মাঝে একজন শিল্পী ছিলেন, তিনি ছবি তুলতেন এবং বেশ ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতেন। তাঁর নাম - হালিম খান। ওই সময় হালিম খানের গাওয়া দু’টো গানের কথা আজও আমার মনে আছে। গানগুলো আমি তাঁর কণ্ঠেই প্রথম শুনেছি।
ক. ‘ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী একা একা করি খেলা, আনমনা যেন দিক বালিকার ভাসানু মেঘের ভেলা.......’
এবং
খ. ‘পুরনো জানিয়া চেয়ো না চেয়ো না আমার আধেক আঁখির কোণে অলস অন্য মনে তোমার আধেক আঁখির কোণে.......’
তৃতীয় আরেক দিনের কথা, দুপুর বেলা হেমনগরের কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছি। স্কুলে আমাদের আস্তানায় ফিরে আসছি, না অন্য কোথাও যাচ্ছি, তা মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, পথ থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রাস্তার পাশের এক বাড়িতে, স্কুল থেকে এক-দেড় কি.মি. দূরে। বাড়ির উঠোনের এ কোণে আমগাছের ছায়ায় চেয়ার-টেবিল পেতে আমাদের বসতে দেওয়া হলো। আমার সাথে সহকর্মী আরও কয়েক জন ছিলেন, তবে কে কে, সে কথা ভুলে গেছি। বাড়ির ঘর-দরজা দেখে মনে হলো, এটি একটি সচ্ছল কৃষক পরিবার। তাঁদের ব্যবহার, আচার-অনুষ্ঠান এবং চা-পানি যেভাবে দেওয়া হলো, এতে এ বাড়িতে যে শিক্ষা-সংস্কৃতির আলোর ছোঁয়া লেগেছে তা স্পষ্ট ফুটে উঠলো। বাড়ির মেয়েরা প্রচুর সুতোর কাজ করেছেন। এগুলো একে একে আমাদের এনে দেখালেন, এঁদের কেউ স্কুল-পড়ুয়া, কেউ গৃহবধূ, কেউ আবার কাজের মেয়ে। তাঁরা এসব শিল্পকর্ম বানিয়ে থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন, কিন্তু বাজারজাত করতে পারছেন না। আমি বললাম, ঢাকায় ব্র্যাক-এর সাথে যোগাযোগ করুন, এর চেয়ে বেশি পরামর্শ আমাদের কাছে আর নেই। সে-দিন যে বিষয়টি আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল সেটা হলো, গ্রামীণ মেয়েদের ওই সৃষ্টিশীল প্রচেষ্টার সমন্বয়কারী ছিল ২০/২২ বছরের এক প্রতিবন্ধী তরুণ। তার নামটাও মনে নেই। সে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করত।
এবার বলছি পরের ঘটনা, একটি দুর্ঘটনার কথা। স্কুলের যে কামরায় মেঝেতে বিছানা পেতে আমরা ঘুমাতাম, সেটা ছিল ঘরের একদম পূর্বপ্রান্তের একটি বড় শ্রেণীকক্ষ। শ্রেণীকক্ষের একটি জানালা ভাঙ্গা ছিল। দিনের বেলা উন্মুক্তই থাকত, রাতে আমরা জানালার ওপর ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলিয়ে দিতাম যাতে বৃষ্টির পানি না ঢুকে। এক দিন গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন হঠাৎ ধুন্ধুমার ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। আমার বিছানা জানালা থেকে অনেক দূরে ছিল, তথাপি চার-পাঁচ জনকে টপকিয়ে ব্ল্যাকবোর্ড উড়ে এসে আমার ওপর পড়ল। আমি হুড়মুড় করে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আধা হুশ আধা বেহুশ অবস্থায়, আমি ভেবেছি ভূমিকম্প হচ্ছে এবং ঘরের ছাদ ভেঙ্গে আমার মাথায় পড়ছে। জান বাঁচাবার জন্য মুহূর্ত দেরি না করে আমি এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমার চিৎকারে বাকি সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কেউ আলো জ্বেলেছিলেন কিনা জানি না। ততক্ষণে আমি ঘন অন্ধকারে দীঘির পাড়ে বসে হাপাচ্ছি, ভয়ে বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে। মিনিট দশেক পর সম্বিত ফিরে পেলাম। ঘরে এসে দেখি, আমাকে না পেয়ে সবাই উৎকণ্ঠিত, হতবিহবল! সবার কণ্ঠে একই আহাজারি, ‘ওয়াহিদ কই, ওয়াহিদ কই!’
আগের অংশ
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ, ন্যাশভিল, টেনেসি Email: awahid2569@gmail.com
এপ্রিল ০৬, ২০১৮
|