হেমনগরের হিমেল হাওয়া আবু এন এম ওয়াহিদ
       পরের অংশ 
আমার যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৮-৭৯ সালে আমি পর পর তিনবার ‘হেমনগর’ গিয়েছি। প্রথম বার মাত্র এক দিন কি দু’দিন ছিলাম, দ্বিতীয় বার কয়দিন ছিলাম মনে নেই, শেষ বার সপ্তাহ-দশ দিন থাকতে হয়েছিল; গিয়েছিলাম একটি এনজিও-র হয়ে ওখানকার ভূমিহীন কৃষকদের সমবায়-স্বনির্ভর কর্মকাণ্ড দেখতে। হেমনগর, টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর থানাসদর (থানাগুলো উপজেলা হয়েছে অনেক পরে এরশাদের আমলে) থেকে আনুমানিক ছয়-সাত মাইল দূরে যমুনাপাড়ের একটি ছোট্ট ইউনিয়ন। ইউনিয়নের নামকরণ হয়েছে ‘হেমনগর’ গ্রামের নামে। আর ‘শিমলাপাড়া’-র নাম হেমনগর রাখা হলো রাজা হেমচন্দ্র চৌধুরীর নামানুসারে। হেমচন্দ্র ছিলেন টাঙ্গাইলেরই আরেক উপজেলা - মধুপুরের ‘আমবাড়িয়া’-র জমিদার কালিচন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র এবং পদ্মলোচন রায় চৌধুরীর পৌত্র। পূর্বপুরুষদের মৃত্যুর পর রাজবাড়ির দায়িত্ব হেমচন্দ্রের হাতে এলে তিনি জমিদারিকে সম্প্রসারিত করেন এবং ১৮৮০ সালে মধুপুর ছেড়ে গোপালপুর গিয়ে নতুন বসতি স্থাপন করেন। ওই সময় তাঁর চার লক্ষ একরের জমিদারি টাঙ্গাইল থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
প্রথম বার হেমনগর যাওয়ার আগে এসব ইতিহাসের কিছুই আমি জানতাম না এবং যখন যাই তখন হেমবাবুর জমিদারি ও রাজবাড়ির ইতিবৃত্ত অনুসন্ধান আমাদের উদ্দেশ্যও ছিল না। অবশ্য যাওয়ার পর, অন্যদের কথা বলতে পারব না, তবে নিজে অনুভব করলাম, জব এসাইনমেন্ট এবং ভূমিহীনদের কাজকারবারের চেয়ে আমার যাবতীয় কৌতূহল যেন রাজা হেমচন্দ্রের অবলুপ্ত জমিদারি ও তাঁর পরিত্যক্ত রাজবাড়িকে ঘিরেই ঘোরপাক খাচ্ছে! প্রাচীন জমিদার, জমিদারি ও তাঁদের জীবনযাত্রা বাংলার সামাজিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার বাপ-দাদা কেউ জমিদার ছিলেন না, তথাপি এসব বিষয়ে আজও আমার কৌতূহলের শেষ নেই! কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। একই জায়গায় পর পর তিন বার যাওয়ার পেছনে চাকরির চেয়ে ওই কৌতূহলটি যে বেশি কাজ করেছিল তাতেও আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
প্রথম যাত্রায় আমার সাথে আপিসের আরো চার-পাঁচ জন সহকর্মী ছিলেন। সময়টি ছিল জুলাই মাসের কোনো এক আমপাকা ভ্যাপসা গরমের দিন। আমরা সন্ধ্যার পর গোপালপুর বাজার থেকে (তখনো শহর হয়নি) পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিলাম। ভাঙ্গা লন্ঠন হাতে আগে আগে হাঁটছেন হেমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেবের ভক্ত অনুরাগী মুন্সী ইয়াদ আলী। কোথায় গিয়ে উঠব, কার বাড়িতে থাকব, এসব কিছুই জানি না, শুধু জানতে চাইলাম, কত দূর? মুন্সী বললেন, ‘এই দুই-আড়াই মাইল হবে’ (তখনো দেশে ম্যাট্রিক সিস্টেম চালু হয়নি)। থানাসদরের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়েই একটি খেয়া পার হলাম। তারপর ঘন অন্ধকারে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছি তো হাঁটছি, পথ আর শেষ হচ্ছে না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, আর কত দূর? ‘সামান্য পথ বাকি আছে’, উত্তর দিলেন মুন্সী সাহেব। তার পর আরও মাইল দুয়েক গেলাম। এর মাঝে একটি লোহার পুল ও দু’টো বাঁশের সাঁকোর কথা মনে পড়ে। এবার তিনি বললেন, ‘এই তো এসে গেছি’। মুখে হাসি এসেছিল, কিন্তু গরমে ও ক্লান্তিতে হাসতেও পারলাম না! গ্রামের সহজ সরল মানুষ দূরত্বের মাপজোখ জানেন না, আর তাই সঠিকভাবে বোঝাতেও পারেন না। এ বিড়ম্বনা তখন যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। এ ছাড়াও অনেক শহুরে শিক্ষিত মানুষের মাঝেও দিগ্জ্ঞান ও দূরত্বজ্ঞানের দারুণ ঘাটতি দেখেছি। এ ব্যাপারে আমিও যে খুব চৌকস তেমনটি দাবি করি না।
হাঁটতে হাঁটতে এক সময় মূল রাস্তা ছেড়ে মুত্রাবনের পাশ দিয়ে সরু মেঠো পথ ধরে ধুলিমাখা পায়ে যখন চেয়ারম্যান সাহেবের কাছারি ঘরে এসে উঠলাম, তখন বুঝলাম দেহে শক্তি আর অবশিষ্ট কিছু নেই। ঘড়িতে তখন ক’টা বাজে সেদিকে তাকাবারও প্রয়োজন বোধ করিনি। কাঠের চৌকিতে গা এলিয়ে দিলেই বুঝি ঘুমিয়ে পড়ব, কিন্তু পেটের খিদেয় তো ঘুম জমবে না, তাই বসে রইলাম। মোরগ ধরা হলো, জবাই হলো, রান্না হলো। যখন খানা সামনে এলো তখন বুঝলাম, মুরগীর ঝোলের তীব্র সুগন্ধে আমার মাঝে সদ্যমৃত খিদে আবার নেকড়ের মত জেগে উঠছে! গরম ভাত, মুরগীর ঝোল দিয়ে খুব মজা করে খেলাম। কোনো রকম একটি বালিশ টেনে তোশক ছাড়া, পাটি বিছানো কাঠের তক্তপোষে ঘুমিয়ে পড়লাম। এমন আরামের ঘুম আমার জীবনে খুব কমই ঘুমিয়েছি! সকালে উঠে দেখি, কে যেন দয়া করে মাথার ওপর একখানা মশারি টাঙ্গিয়ে দিয়েছেন। আমরা যে ঘরে ঘুমিয়েছিলাম সেটা ছিল বাড়ির কাজের লোকদের থাকার জায়গা। আমাদের কারণে সে-রাত বেচারাদের নিশ্চয়ই মাটিতে কাটাতে হয়েছে।
সকাল বেলা ডিম-পরোটার নাস্তা খেয়ে তৈরি হতে না হতেই দেখি, আমাদের গাইড মুন্সী সাহেব এসে হাজির। তিনি আমাদের গ্রাম ঘুরে দেখালেন, এ-বাড়ি ও-বাড়ি নিয়ে গেলেন, ‘বেলুয়া’ বাজারে একটি উঠতি বটগাছের তলে এক চায়ের দোকানে চা খাওয়ালেন, সেখানে গ্রামবাসীদের সাথে চায়ের টেবিলে রাজাউজির মারা গল্পে শরিক হলাম, আঞ্চলিক ভাষা - কতক বুঝলাম, কতক বুঝলাম না। সব শেষে মুন্সী সাহেবকে অনুসরণ করে আমরা হেমনগরের রাজবাড়িতে এসে হাজির হলাম। বিশাল রাজবাড়ি, দেখেই তো আমার চক্ষু ছানাবড়া! বললাম, এখানে আগে নিয়ে এলেন না কেন? তিনি কী উত্তর দিয়েছিলেন, সে কথা আজ আর মনে নেই। সময় বেশি না থাকায়, জমিদারবাড়িতে বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারিনি, বেশি কিছু দেখতেও পারিনি। তার পর ওই রাত আবার চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে থাকলাম, না গোপালপুর চলে এলাম স্মৃতিতে সেকথা আজ একেবারে ম্লান হয়ে আছে।
দ্বিতীয় বার যখন হেমনগর যাই তখন আমরা মাত্র দু’জন। আমি ও আমার সহকর্মী জনৈক অস্ট্রেলীয় নাগরিক ‘লী রিডাউট’। ‘লী’ সাহেব এক বাঙালি মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে সাভারে আমাদের এনজিও আপিসের পাশে এক টিনের ঘরে সংসার পেতেছিলেন। বিয়ের আগে তিনি নাকি ধর্মান্তরিতও হয়েছিলেন, কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘মোহাম্মদ হোসেন লী’, কিন্তু লিখতেন ‘লী রিডাউট’। ‘লী’ সাহেব আমাদের মত মাছভাত খেতেন, লুঙ্গি পরতেন, পুকুরে নেমে গোসল করতেন, সাঁতার কাটতেন, একটু আধটু বাংলাও শিখেছিলেন। ফিল্ডওয়ার্ক শেষে আপিসে ফিরে রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগে, দেশী সহকর্মীদের কেউ কেউ ‘লী’ সাহেবকে দেখাতেন, ইংরেজিটা ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্য। তিনি আজ কোথায় আছেন, তাঁর সংসারেরই বা কী খবর, আল্লাহ্ই মা’লুম।
আপিসের গাড়ি আমাদের দু’জনকে গোপালপুর নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। শুরু হলো ভারী বর্ষণ, তার সাথে আকাশে বিজলী-চমক ও মেঘের কড়কড় আওয়াজ, মনে হচ্ছে যেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আসমান বিদ্রোহে ফেটে পড়ছে। এমন দিনে কি কেউ ঘর থেকে বের হয়? আর হলে তো পুকুর পাড়ে উজাই-র কৈ ধরতে যাওয়ার কথা, কিন্তু আমাদের সামনে একটি পথ, একটি লক্ষ্য - যেতে হবে হেমনগর। একদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে, অন্যদিকে সাথে আজ মুন্সী সাহেবও নেই। এমতাবস্থায় কাঁধে ছোট্ট শান্তিনিকেতনি ব্যাগ, মাথায় ছাতা, কোমরে শক্ত করে লুঙ্গি বেঁধে, খালি পায়ে আল্লাহর উপর ভরসা করে বেরিয়ে পড়লাম দুই বান্দা। কার বুদ্ধিতে পথ সংক্ষেপ করার জন্য রাস্তা ছেড়ে মাঠের মাঝ দিয়ে রওয়ানা দিলাম, তা ভুলে গেছি। মাথায় বৃষ্টি আর পায়ের নিচে কাদা-পানি রেখে দু’জন ছুটছি উল্কাবেগে। মনে পড়ে, অন্তত একটি খাল পার হয়েছি মাথায় লুঙ্গি বেঁধে। এভাবে ঘুটঘুটে আঁধারে কেমন করে নিরাপদে রাজবাড়ির লাগোয়া স্কুলঘরে এসে পৌঁছালাম, সে কথা ভাবতে আজও গা শিউরে ওঠে! হেমবাবু আপন দীঘিরপাড়ে স্কুল করেছেন তাঁর সৎ মায়ের নামে - ‘শশীমুখী’ উচ্চ বিদ্যালয়। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে যখন স্কুলঘরে উঠে আসি তখন একটি মাত্র আদম-সন্তান ছাড়া আশেপাশে অন্য কোনো মানুষের হদিস মিলেনি। সেই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি স্কুলের চৌকিদার - মাঝ বয়সী হাসমত মিঞা। লোকটি বড়ই সরল ও হৃদয়বান! চেনা নেই, জানা নেই, চিঠি নেই, সংবাদ নেই, সরল কথায় কী সরল বিশ্বাস! না চাইতেই অপরিচিত মানুষদের তিনি তাঁর ঘর ছেড়ে দিলেন! এমন একিন, এমন সোজা-সরল জীবন দুনিয়ার আর কোথাও আছে? আমার অন্তত জানা নেই! রাজবাড়ির দীঘি, উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা। তার দক্ষিণ-পাড়ে স্কুল। স্কুলের পশ্চিম প্রান্তে হাসমত মিঞার থাকার ঘর। দীঘি বরাবর ঘরের উত্তর দিকে একটি জানালা। জানালার পাশে একখানা চৌকি পাতা। উল্টো দিকে মাটিতে তিনকোণা একটি চুলো, তার পেছনে বাঁশের মাচার ওপর কিছু হাঁড়িপাতিল। ঘরের পূর্বদিকে দরজা। দরজার ডান পাশে নিতান্তই অবহেলায় মাটিতে পড়ে আছে একটি জং ধরা স্টিলের ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কের ভেতর হাসমত মিঞা কী ধন লুকিয়ে রেখেছেন, তা জানার প্রয়োজন বোধ করিনি। জিজ্ঞেস করলে হয়ত বা আজকের এই লেখার জন্য আরও অনেক মজার মজার উপাদান পাওয়া যেত। কে জানত, ৪০ বছর পর আজ এ নিয়ে লিখতে বসব।
তড়িঘড়ি করে হাসমত মিঞা তাঁর অযাচিত ও অনাহূত মেহমানদের জন্য ভাত-তরকারি রান্না করলেন, খাওয়ালেন। প্রথম বেলা তিনি কী রেঁধেছিলেন, তা মনে করতে পারলে ভালোই লাগত। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে শুরুতেই খেলাম এক ধাক্কা, স্কুল ঘরের উল্টো দিকে একটি কাঁচা টয়লেট ছিল বটে, কিন্তু সেটা ব্যবহার করার মত নয়, তাই নিরুপায় হয়ে বদনা নিয়ে ধানক্ষেতে যেতে হলো। সেখানে যে কয়দিন ছিলাম প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম আমরা এভাবেই সেরেছি। এ নিয়ে আমার তো নয়-ই, ‘লী’-সাহেবেরও তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। হাসমত মিঞা দু’বেলা আমাদের জন্য ভাত রাঁধতেন, কিন্তু সকালে কী খেতে দিতেন? ভাত, নাকি রুটি-বিস্কুট জাতীয় কিছু? তা আজ আর মনে নেই, তবে সাফসফা সিরামিকের পেয়ালায় এক কাপ গরম গরম গুড়ের চা পাওয়া যেত। দিনের বেলা আমরা পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে যেতাম। মাঝে মধ্যে কারো না কারো বাড়িতে দুপুরের দাওয়াত মিলত। রোদে কিংবা বৃষ্টিতে যেদিন বের হতাম না সেদিন হাসমত মিঞার ঘরে তাঁরই চৌকির ওপর প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা বসত। মাঝে মাঝে তাঁরা তাস খেলতে চাইতেন, কিন্তু আমি জানতাম না বলে আর খেলা হত না। বিকেলে বাজার থেকে কোনো দিন তাজা মাছ-তরকারি, কোনো দিন মুরগী কিনে আনতাম। হাসমত মিঞা রেঁধে খাওয়াতেন। রাজবাড়ি থেকে মাইল দুয়েকের মাঝে তিনটি বাজার ছিল, ‘হেমনগর’ বাজার, ‘বেলুয়া’ বাজার ও একদম যমুনাপাড়ে ‘নলীন’ হাট। সপ্তাহের প্রতি দিন কোনো না কোনো হাট বসতই।
আজ লিখতে বসে বিশেষ করে একটি বিশেষ দিনের কথা মনে পড়ছে। সকাল থেকে বড় বড় ফোঁটায় মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালাঘরে বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজ - যেন সঙ্গীতের মত কানে এসে বাজছে। দরজা জানালা খোলা, ভেজা ভেজা শীতল হাওয়া এসে ঘরে ঢুকছে। একটু একটু ঠাণ্ডাও লাগছে। হাতের কাছে কাঁথা-কম্বল কিছুই নেই। হাসমত মিঞার কাছে চাইলে হয়তো কিছু একটা পাওয়া যেত, কিন্তু পেলেই যে তা গায়ে দিতে পারতাম তার কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় আমি চাইনি, আর ’লী’ সাহেবের দরকারই পড়েনি। চা খেতে খেতে আমি হাসমত মিঞার তক্তপোষের ওপর বসে দীঘির দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছি। এক দিকে আমার হাতের কাপ থেকে জলীয় বাষ্প উপর দিকে উড়ছে, আর অন্য দিকে ঢেউ-খেলা দীঘির পানিতে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে আর এক ধরনের ধোঁয়ার মত কী যেন উপরের দিকে উড়ছে, মাঝে মাঝে পানিতে ছোট ছোট মাছও লাফাচ্ছে, দেখতে কী অপূর্ব লাগছে!
এমন বাদলা দিনে মা-বাবা-ভাইবোন থেকে দূরে একাকী গণ্ডগ্রামে রবি ঠাকুরের পোস্ট মাস্টারের মতই যেন লাগছিল! হাসমত মিঞার ঘরে পোস্ট মাস্টার নেই, রতনও নেই, কিন্তু শুনে অবাক হবেন, এখানে পোস্ট আপিস আছে! অর্থাৎ দীঘির কোণায় রাস্তার ওপর হাসমত মিঞার ঘর থেকে মাত্র দশ/পনেরো গজ দূরেই পোস্ট আপিস। ছোটবেলা থেকেই পোস্ট আপিসের প্রতি আমার একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল। সেটা চিঠি লেখার জন্য না যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি চিঠি পাওয়ার জন্য। আর উত্তরের প্রতীক্ষায় এক দিন এক দিন করে দিন গোনা - সে যে কী অনুভূতি! ভাষায় ব্যক্ত করা আমার জন্য শক্তই বটে! আদৌ উত্তর আসবে কিনা, আসলে তাতে কী থাকবে, এসব নিয়ে আশা-নিরাশার অনিশ্চয়তা ও জানা-অজানার কৌতূহল মনের মাঝে এক অব্যক্ত আনন্দ-বেদনার জন্ম দিত, যা গভীরভাবে জমাট বেঁধে আপনা থেকেই আপনি গুমরে মরত। তাকে অতি যত্নে নিজেই ধারণ করতাম, নিজেই লালন করতাম, কিন্তু কস্মিনকালেও কাউকে বলতাম না, যদি কমে যায়, এই ভয়ে! কিসের এই ভয়, কী কমে যাওয়ার ভয়, দুঃখ? না সুখ? আমার মনে হয়, এর কোনোটাই না, বরং উভয়েরই মিশ্রণে নতুন এক গভীর অনুভব, যার নাম আমি জানি না!
দুপুরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেল, কিন্তু দীঘির জল শান্ত হলো না। শীতল বাতাস বয়েই চলল, পানিতে ছোট ছোট ঢেউয়ের খেলা চলতেই থাকল। এমন সময় দেখি এক জেলে জাল দিয়ে দীঘিতে মাছ ধরছেন, তাজা মৌরলামাছ। ঘুরে ঘুরে তিনি বিশাল দীঘির চারদিকেই জাল ফেললেন। মাছ ধরা শেষ হলে খলুইসহ জেলে স্কুলের বারান্দায় উঠে এলেন, আমরা দামদর করে মৌরলামাছগুলো কিনে নিলাম। দাম কত ছিল, তা বেমালুম ভুলে বসে আছি। ওই দিন আর হাটে যাওয়া হলো না। হাসমত মিঞা কাঁচামরিচ দিয়ে তাজা মৌরলামাছের ঝোল রাঁধলেন। সেদিনকার ঝুলে-ভাতের স্বাদ আজও আমার জিবে লেগে আছে!
       পরের অংশ 
|