‘গুড়ের চা’- অতঃপর? আবু এন এম ওয়াহিদ
এবার ক্ষণিকের জন্য একটু পেছনপানে ঘুরে দেখতে চাই, আমার বিগত লেখার দিকে আপনাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাই। আমি অনেক আশা করে, মেহনত করে গুড়ের চা নিয়ে লিখে আপনাদের খেদমতে পেশ করলাম। আপনারা সবাই যত্ন নিয়ে পড়লেন, মজা পেলেন কি না জানি না, তবে লেখাটি পড়ে কেউ কেউ যে নিজ হাতে বানিয়ে মজাদার গুড়ের চা খেয়েছেন সে খবর আমি রাখি। যে লেখা পড়ে আপনারা চা-পানি খেলেন তার বিনিময়ে আমি কী পেলাম, তা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? শুনে আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হবেন ‘গুড়ের চা’ লিখে আমি পেয়েছি শাসন, খেয়েছি ‘বকা’! তাও আবার বন্ধুর ‘বকা’, আমার প্রিয় বন্ধুর ‘বকা’! আমার এই বন্ধুর কথা আপনারা অনেকেই জানেন, সে থাকে ইংল্যান্ডের শেফিল্ড শহরে, তার নাম মাহবুব। আমার প্রায় লেখাতেই তার সরব উপস্থিতি আপনারা টেরও পেয়ে থাকেন। একান্তই নিভৃতচারী প্রচার-বিমুখ মানুষ বলে তাকে নিয়ে আমার এত মাতামাতি সে পছন্দ করে না, বরং বিব্রত বোধই করে, কিন্তু আমাকে কিছু বলতেও পারে না। মাহবুবের জন্য এ এক উভয় সঙ্কট বটে!
তার সাথে আমার জানাশোনা ও বন্ধুত্ব দীর্ঘ দিনের। আমাদের নিত্য দিনের আড্ডায় ও আলোচনায় কোনো সময়ই নির্দিষ্ট কোনো অ্যাজেন্ডা থাকে না, ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’, দু’জনের মাঝে সবই চলে। আমরা যেমন গভীর দার্শনিক তত্ত্বকথা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘনটা আলাপ করি, তেমনি আবার অতি তুচ্ছ বিষয়েরও গভীরে যাওয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করি। ‘কপালের টিপ আর সিঁথির সিঁদুরের তফাৎ’, ‘বাপকা বেটা’-র তাৎপর্য, ‘জয়তুন তেলের প্রকারভেদ’, ‘চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতিতে ‘প্লিজ’ এবং ‘থ্যাংক ইউ’’ শব্দ দু’টোর সরাসরি ব্যবহার না হওয়া, ‘দুই বাংলা ছাড়া ভারতীয় সকল ভাষাতেই ‘শিন্নি’ শব্দের অনুপস্থিতি’, ইত্যাদি বিষয় অতি গুরুত্বের সাথে আমাদের অলোচ্যসূচীতে সহজেই স্থান করে নিতে পারে। মাহবুবের সাথে আমার গল্প, হাসাহাসি, ঠাট্টা, খিলখিলানি শুনে যে কেউ হিংসে করতে পারেন। একজন একদিন করেছেনও এবং তা প্রকাশ করতেও দ্বিধা বোধ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘এ তো দেখছি তোমরা দুই বন্ধু মিলে মেয়ে মানুষদেরও হার মানাবে!’ এতে কি নারীসমাজকে মহিমান্বিত করা হলো? আমি তো মনে করি ঠিক তার উল্টোটাই হলো। কথাটার অর্থ এমন দাঁড়ালো না যে, ‘পুরুষের কাজই হলো শুধু কাজ করা, আর মহিলাদের কাজ নেই তাই গল্প করা’! গল্পগুজবে নারী-পুরুষের সমান অধিকার মেনে নিলে সহজেই দু’কুলেরই ইজ্জত বাঁচে। ঠিক বলিনি?
বন্ধুটির সাথে আমার জীবনদর্শন ও চিন্তাধারার অস্বাভাবিক রকমের মিল! তথাপি মতপার্থক্য যে একেবারেই হয় না তা নয়। হয় বটে, কিন্তু দু’জনের বন্ধুত্বের ছায়া এত গাঢ়, এত ঘন যে, মতের অমিল আলো পায় না, পানি পায় না, ডালপালা মেলতে পারে না, মতানৈক্য কখনো মনোমালিন্যে রূপ নিতে পারে না, তাই সম্পর্কেও ফাটল ধরে না। আমাদের এই গহিন বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব ও মাধুর্যের তিনটি গূঢ় সূত্র আছে। প্রথমত, দু’জনের মাঝে অকৃত্রিম মনের মিল; দ্বিতীয়ত, পূর্ণ পারষ্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধা এবং তৃতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, একজনের কাছে আরেক জনের বৈষয়িক কোনো প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো লেনদেন। যেহেতু প্রত্যাশা ও লেনদেন নেই, তাই যখন-তখন চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে হয় না। গরমিলের প্রশ্নও ওঠে না, বন্ধুত্ব চাপমুক্ত থাকে, নিরাপদে বিকশিত হয়। মাহবুবের সাথে আমার যোগাযোগ কেবলই বন্ধুত্বের নয়, এ যোগাযোগ বহুমাত্রিক। তার মাঝে আমি এ পর্যন্ত মাত্র যে দু’টো আবিষ্কার করেছি, নিয়মিত তাদের স্বাদও আমি আনন্দের সাথে উপভোগ করে আসছি। বাকিগুলো এখনো রহস্যাবৃতই আছে! এই দু’য়ের মাঝে, এক দিকে সে আমার দোস্ত, আরেক দিকে আমার ওস্তাদ! আমি যে লেখালেখি করি তার প্রেরণাও সে এবং প্রশিক্ষকও সে। আমার প্রায় প্রতিটি লেখা আপনাদের মনিটরের পর্দায় ভেসে ওঠার আগে মাহবুবের কাছে যায়। সে টাইপো, যতি চিহ্ন, বানান, শব্দ প্রয়োগ, বাক্য বিন্যাস ইত্যাদি সব ঠিকঠাক করে দেয়। তারপরই আমি পাঠক-বন্ধুদের কাছে পাঠাই। মাহবুবের হাতের ছোঁয়া ছাড়া যে সব লেখা আপনাদের কাছে যায় তাতে প্রচুর ভুলভ্রান্তি রয়ে যায় এবং এ কথা আপনারাও জানেন, তবে শালীনতার খাতিরে আমাকে কিছুই বলেন না, সে আমি বুঝতে পারি। একটি সামান্য ধন্যবাদ দিয়ে আপনাদের এমন উদারতাকে খাটো করতে চাই না। এখানে অবশ্য আরেকটি কথা বলে রাখা জরুরি; মাহবুব দেখে দিলেই যে লেখাটা ষোল আনা সহি হয়ে গেল এমন কথা আমি বলি না, কারণ মানবিক দুর্বলতার ঊর্ধ্বে তো আর কেউই নয়।
ফিরে আসি ‘গুড়ের চা’য়ে। লেখাটি যখন দাঁড়িয়ে গেল তখন গতানুগতিক ভাবেই এর মুসাবিদাও চলে গেল মাহবুবের কাছে। রচনাটি পড়ে সে আমাকে জানাল, ‘বানান ও উল্টাপাল্টা শব্দ প্রয়োগ ছাড়াও বেশ কিছু টাইপো রয়ে গেছে’। আমি বললাম, বাকি সব দেখে দে, টাইপো বড়জোর দু’একটা থাকবে, থাকলে থাকুক গে, অসুবিধা নেই, পাঠকরা নিজে থেকেই বুঝে নেবে। এই আলোচনার ভিত্তিতে মাহবুব সময় নিয়ে যত্ন করে ‘গুড়ের চা’ পড়ে সমস্যাগুলো টুকে রাখলো। পরে এক দিন আমার আপিসে ফোন করে বলে দিলো, কোথায় কোথায় ভুল হয়েছে এবং কোন ভুল কিভাবে শুধরাতে হবে। মাহবুবের কাছ থেকে টেলিফোনে সবক বুঝে নিয়েই সে দিনের মত বাড়ি চলে এলাম। সন্ধ্যায় ক্লান্ত দেহে আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় এডিটিঙের কাজ সেরে একটু তাড়াহুড়া করেই আমি লেখাটা আপনাদের কাছে ছেড়ে দিলাম। এডিটিঙের সময় দু’টো টাইপো আমার চোখে ধরা পড়লো, আমি ঠিক করে দিলাম, কিন্তু এ জাতীয় ভুল যে আরো বেশ কয়েকটা রয়ে গিয়েছিল সে বাস্তবতা আমার নজর এড়িয়ে গেল। এ ছাড়াও অন্য কিছু ভুল ঠিক করতে গিয়ে নিজের অজান্তে কিছু নতুন সমস্যারও জন্ম দিয়ে ফেললাম। এ ভাবে আমার গাফলতিতে ভুলে ভরা লেখাটাই আপনাদের কাছে পৌঁছে গেল। এর এক দিন কি দু’দিন পর মাহবুব আমাকে ফোন করে বকা দিল। বলল, ‘এ কী, এত ভুল রয়ে গেল কী করে? এত তাড়াহুড়ার কী দরকার ছিল’? মাহবুবের এমন ‘বকা’ অহরহই আমার প্রাপ্য, কিন্তু তা আমার ‘ভাগ্যে’ কদাচিৎই জোটে, কারণ আমার বন্ধুর ধৈর্য সীমাহীন! ‘বকা’ খাওয়া আবার ‘ভাগ্য’ হয় কী করে? ধৈর্য ধরুন, তাও খোলাসা হয়ে যাবে, একটু পরেই।
সে দিন আমি আর তেমন কিছু বললাম না, কথাও বাড়ালাম না, তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে দিলাম। বিষয়টা নিয়ে আমি একটু ভাবলাম এবং মাহবুবের জন্য একটি হাস্যরসাত্মক উত্তরও বের করলাম, ঢাকায় ‘রানা’-র সাথে এ নিয়ে কথাও হলো। আরো ঠিক করলাম, এটি মাহবুবকে বলব। কয়েক দিন পর তাকে আবার ফোন দিলাম, পেলাম না। পরে সে আমাকে কল করে আপিসে পেল। আমি বললাম, সেদিন যে তুই আমাকে বকা দিলি, ‘এ কী, এত ভুল রয়ে গেল কী করে? এত তাড়াহুড়ার কী দরকার ছিল?’ তার উত্তরে আমি যদি তোকে পাল্টা বকা দিতাম এই বলে যে, ‘তোর শাগরেদ তোর কথা শুনে না, তাতে আমার দোষটা কোথায়? আমি তো তোর বন্ধু, প্রাণের বন্ধু! তুই আমাকে বকাবকি করিস কেন? যেই বলা সেই হাসি, দুই বন্ধু এক যোগে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম, দু’জন মিলে আচ্ছাসে কতক্ষণ হাসলাম। হাসির বন্যায় মাহবুব শেফিল্ড ভাসিয়ে দিলো আর আমি ন্যাশভিল! এই হাসির আনন্দ থেকে আপনাদের কাউকে বঞ্চিত করতে চাইনি বলেই এই ক্ষুদ্র নতুন লেখার অবতারণা।
হাসাহাসি থিতু হলে মাহবুব সহজেই বলতে পারত, ‘আমি আমার শিষ্যকে বকেছি, তোকে তো বকিনি, তোর অসুবিধাটা কোথায়?’ কিন্তু আমার বন্ধু সে কথা বলেনি। বলেনি যে তারও কারণ আছে। তত্ত্বগত ভাবে এ কথা যেমন ঠিক নয় তেমনি আমার হাস্যরসের কথাটাও ঠিক নয়। তার কাছে আমার ছাত্র-সত্তা ও বন্ধু-সত্তা তো সর্বদা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে! দু’টো বৈশিষ্ট্যই অবিভাজ্য, অবিচ্ছেদ্য! কখন আমি ছাত্র এবং কখন আমি বন্ধু এর সীমারেখা টানা মাহবুব কেন, কারো পক্ষেই সম্ভব নয়! গল্পটি আজকের মত এভাবে এখানেই শেষ হয়ে যেত পারত, কিন্তু কথা যে আরেকটু বাকি রয়ে গেলো। এবার শুনুন আসল কথা, গভীর মর্মকথা!
গুড়ের চা আপনারা খেয়েছেন, আমিও খেয়েছি। গুড়ের চায়ের সুগন্ধি স্বাদের কথা কে না জানে? তবে বন্ধুর ‘বকা’, সে যে কত মিষ্টি, সে যে কত মধুর হতে পারে, এ কথা মাত্র সে দিনই বুঝলাম, হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম! এ এক স্বর্গীয় উপলব্ধি বটে! যার এমন বন্ধু আছে, কেবল সে-ই জানে! যার নেই, তাকে বলব, জগতে যদি সুখী হতে চাও, বন্ধু খুঁজো, বন্ধু বানাও, নিঃস্বার্থ বন্ধু, খাঁটি বন্ধু!
পুনশ্চ: আজকের এই লেখাটি এভাবে আপনাদের কাছে যাক, এতে মাহবুবের ঘোর আপত্তি ছিল। অনেক কথার পর, অবশেষে কিছুটা বুঝিয়ে, কিছুটা জোর করে তাকে রাজি করিয়েছি।
The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|