‘লক্ষ্য বনাম প্রক্রিয়া’ আবু এন. এম. ওয়াহিদ
আমরা কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় এন্ড বা চূড়ান্ত লক্ষ্যের সাথে মিন্স অর্থাৎ প্রক্রিয়াকে গুলিয়ে ফেলি। যার ফলে ভালো এবং নৈতিক কাজ করার সময় দেখা যায় ভুল ও অনৈতিক পথ অনুসরণ করি এবং মনে মনে এটাকে জায়েজ করে নেই এই ভেবে যে, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যতো সঠিক এবং সৎ, সোজা পথের বদলে না হয় একটু বাঁকা পথেই গেলাম, তাতে অসুবিধাটা কি? কাজটা তো সহজে তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। আমরা অনেক সময় বুঝি, আবার কোনো সময় বুঝিও না, কিন্তু এর অসুবিধা আছে বৈকি। একটা নয়, বরং দু’টো অসুবিধা। প্রথমতঃ এটা বেআইনি এবং নিয়মনীতি বিরোধী কাজ। যা বেআইনি, তা-ই বর্জনীয়। দ্বিতীয়তঃ একজনকে অনৈতিক পথ অনুসরণ করতে দেখলে আরো দশজন এ পথে চলতে উৎসাহিত হতে পারে এবং তারা সবাই যে সৎ লক্ষ্য ও গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? নেই, তাই সঠিক কাজটা, সঠিক সময়ে, সৎ উদ্দেশ্যে, শুদ্ধ তরিকামতই করা উচিত। এখানে যে কোনো ধরনের ব্যত্যয় অযাচিত ও অপ্রত্যাশিত। সব সময় আমাদের মনে রাখা উচিত, কাজের শেষ ফলটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কিভাবে কাজটা সম্পন্ন করা হলো সেটাও অবহেলার বিষয় নয়।
কেন নয়? সমস্যাটা আমার আজকের পাঠকদের সামনে আরেকটু খোলাসা করে তুলে ধরার জন্য একটা গল্পের আশ্রয় নিতেই হচ্ছে। গল্পটা পশ্চিমা দুনিয়ায় খুব মশহুর। এ গল্প বিশেষ করে একটি কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রায় সব সরকারি এবং বেসরকারি অফিসের ‘ইক্যোয়াল অপরচুনিটি ও অ্যাফারম্যাটিভ অ্যাকশন বিভাগ’ সততা, সদাচরণ ও নীতি-নৈতিকতার স্বপক্ষে এ কাহিনীকে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে অহরহ কাজে লাগিয়ে থাকে। এখানে তিনজন পেশাজীবী জড়িত। বিপদে পড়ে কখন কোন পেশাজীবীর দ্বারস্থ হতে হয় তার কোনো ঠিক নেই, তাই ইচ্ছে করে আমি আজ এ গল্পের কোনো পেশার নামই উল্লেখ করব না। এতে গল্পের সৌন্দর্যে, সম্পূর্ণতায় কিংবা তার মর্মার্থে কোনো ঘাটতি হবে না। যারা গল্পটি শুনেছেন তারাতো জানেনই, আর যারা শোনেননি তাঁরা যদি প্রাইভেটলি আমার কাছে জানতে চান তা হলে আমার প্রতিশ্রুতি রইলো, আমি আপনাদের ইমেল মারফত সংশ্লিষ্ট তিনটা পেশারই নাম গোপনে জানিয়ে দেব।
এবার আসা যাক মূল গল্পে। একবার এক ধনাঢ্য ব্যক্তি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর আর বেশি সময় নেই, যে কোনো মুহূর্তে আজরাইল (আঃ) তাঁর জান কবজ করতে পারেন। এ-রকম অবস্থায় তিনি তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধুকে ডেকে পাঠালেন। যখন তাঁরা এলেন তখন তাঁদের প্রত্যেকের হাতে নগদ ১ লাখ ডলারের একটা করে প্যাকেজ তুলে দিয়ে বললেন, ‘বন্ধুগণ, তোমাদের সাথে আমার আর দেখা হবে না, কথাও হবে না। মৃত্যুর পর ওপারে আমার ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে, জানি না। তোমাদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ রইলো, আমার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা এখানে ছুটে আসবে এবং আমার সৎকারের ব্যবস্থা করবে। তার আগে আমার কফিনের ভেতর টাকাসহ এই প্যাকেজগুলো গুঁজে দেবে। আশা করি এতে করে কবরে আমার টাকা পয়সার কোনো অসুবিধা হবে না’। তিনজনই মুমূর্ষু বন্ধুকে এই বলে আশ্বস্ত করলেন, ‘প্রিয় বন্ধু আমাদের, তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমরা তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব’। এই বলে তিন বন্ধু টাকা নিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেলেন। দু’দিন পরই রোগীর মৃত্যু হলো। সংবাদ শুনে তিন বন্ধু যথারীতি যার যার প্যাকেজ হাতে করে মরাবড়িতে এসে হাজির হলেন। মৃত বন্ধুর দাফন-কাফনে শরিক হলেন। বন্ধুর কথামতো তাঁরা প্যাকেজগুলো কফিনে গুঁজে দিয়ে লাশের সৎকার সেরে একসাথে তিনজন বাড়ি ফিরছেন। যেতে যেতে তাঁদের মধ্যে কথা হচ্ছে, প্রথম বন্ধু বললেন, ‘এ মুহূর্তে আমার মধ্যে একটা দারুণ অপরাধ বোধ কাজ করছে। তোমাদেরকে না বলা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আমি কিন্তু পুরো ১ লাখ ডলার দেইনি। দিয়েছি মাত্র ২০ হাজার, বাকি ৮০ হাজার আমাদের বাড়ির কাছের হাসপাতালে ‘গরিব রোগীদের চিকিৎসা ফান্ডে’ দান করে ফেলেছি। আমার যুক্তি, সবগুলো টাকাইতো মাটির নিচে পোকামাকড়ের পেটে যাবে, অন্তত কিছুটাতো মানুষের কাজে লাগল’। দ্বিতীয় বন্ধু বললেন, ‘আমিও একই ধরনের কাজ করেছি, আমি ৫০ হাজার দিয়েছি বাকিটা আমাদের চার্চের গৃহহীন রিলিফ ফান্ডে জমা দিয়েছি’। কারণ হিসেবে তিনি প্রথম জনের মতো একই যুক্তি দেখালেন। তৃতীয় বন্ধু বললেন, ‘তোমরাতো ভারি অন্যায় কাজ করে ফেলেছ। মৃত বন্ধুর শেষ ইচ্ছে পূরণ করনি। কথা দিয়েও কথা রাখনি। তোমাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক ল’স্যুট হতে পারে। আমার কথা আমি ষোলো আনা রক্ষা করেছি। আমি পুরোটাই টাকাটাই দিয়েছি। আমার ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্টের বিপরীতে ১ লাখ ডলারের একটা চেক বন্ধুর নামে লিখে সই করে প্যাকেজে ভরে কফিনে গুঁজে দিয়েছি’। নগদ না দিয়ে চেক দেওয়ার কারণ স্বরূপ প্রথম দু’জনের মতো তিনি কোনো যুক্তি দাঁড় করালেন না।
ক্লাসে এই গল্পটি বলার পর আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করি, আচ্ছা এবার বলতো, এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ কে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তর আসে, ‘তৃতীয় বন্ধু’। আসলে এ জবাব ভুল - এখানে আদৌ কোনো দুর্নীতি হয়ইনি। কিভাবে? প্রসঙ্গ এলে সে কথা অন্য জায়গায় হবে। দুর্নীতির সংজ্ঞা বুঝিয়ে দিয়ে আমি আমার শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দেই, এখানে যা হয়েছে তা হলো সততা, সদাচরণ ও নীতি-নৈতিকতার চরম বরখেলাফ, দুর্নীতি নয়। তৃতীয় বন্ধুর কথা থেকে বোঝা যায়, তিনি ১ লাখ ডলারের ষোল আনাই সাবাড় করে ফেলেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বন্ধু যদি সাচ্চা বাত করেই থাকেন, তা হলে বলতে হয় তাঁরা তাঁদের বন্ধুর বেশ কিছু টাকা নিশ্চিত অপচয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে গরিবের উপকারে লাগিয়েছেন। তারপর আমার শাগরেদদের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় সওয়ালটি ছেড়ে দেই, এবার বলো দেখি, বন্ধুর কাছ থেকে তিন বন্ধু তিন লাখ ডলার নিয়ে যা করলেন তা কি সহি হলো? এ প্রশ্নের আমি দু’ধরনের উত্তর পাই। এক দল বলে, ‘লক্ষ্য যখন খাঁটি, তরিকায় একটু গলতি হলেইবা কি? এটা ঠিক আছে’। আরেক দল বলে, ‘না, কাজটি দোরস্ত হয়নি। ‘দি এন্ড ডাজ নট জাস্টিফাই দ্যা মিন্স’’। আপনাদের প্রত্যেকের প্রতি আমার দু’টো প্রশ্ন – ১. আপনি কোন দলে -প্রথম না দ্বিতীয় দলে? ২. ধনাঢ্য ব্যক্তিটি মৃত্যুর আগে সচেতনভাবে এ-রকম ৩ লাখ টাকা হাত ছাড়া করে গেলেন কেন?
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|