হঠাৎ সেদিন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আচমকা এক ইমেল পেলাম! পাঠিয়েছেন শামসুদ্দিন আহমেদ নামে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। বলে রাখতে চাই, শামসুদ্দিন সাহেবের সাথে আমার আগের কোনো জানাশোনা নেই। ইমেলের সাথে তিনি একটি অ্যাটাচমেন্টও পাঠিয়েছেন। ডকুমেন্ট খুলে দেখি এটি একটি চাঞ্চল্যকর ও সাড়া জাগানো চিঠি, যা কিনা ২০১১ সালের ১৯শে মার্চ New America Media - তে প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের নাম হা মিন থান। তিনি জাপানি পুলিশ বিভাগে কর্মরত একজন ভিয়েতনামি অভিবাসী। হা মিন পত্রটি লিখেছেন তাঁর এক স্বদেশী বন্ধুকে, সম্বোধন করেছেন ব্রাদার বলে। বলতে গেলে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই চিঠিটি ফেস বুকের মাধ্যমে পৌঁছে যায় দেশ-বিদেশে অবস্থানরত লক্ষ লক্ষ ভিয়েতনামির ঘরে ঘরে। তারপর এই চিঠি Viral হয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে স্ক্রিনে ঘুরে বেড়িয়েছে সারা পৃথিবী।
আমার আজকের চিন্তার খোরাক এসেছে ওই অসাধারণ চিঠির বিষয়বস্তু এবং তার কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে। আপনারা সবাই জানেন ২০১১ সালের ১১ই মার্চ তারিখে জাপানের সেন্ডাই উপকূলে ৯.১ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হানা দেয়। ভূমিকম্পের সাথে আসে সুনামি। ভূমিকম্প ও সুনামি, এই দুই প্রাকৃতিক দুর্যোগের যৌথ আঘাতে ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার কমপ্লেক্সের ৬টি রিয়াক্টরের মধ্যে ৪টিই ভেঙ্গে পড়ে। ভূমিকম্প, সুনামি ও নিউক্লিয়ার মেল্টডাউনের ফলে ফুকুশিমা-র আশপাশের মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা এবং পরিবেশের ওপর নেমে আসে এক মারাত্মক ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়। চিঠিতে এই দুর্ঘটনা ও তৎপরবর্তী জনদুর্ভোগের এক বিস্তৃত ও হৃদয়স্পর্শী বিবরণ বাঙময় হয়ে উঠেছে।
হা মিন লিখেছেন, দুর্যোগের অব্যবহিত পরে দুর্গত মানুষের সেবা-সাহায্য এবং উদ্ধারকাজে তারা দৈনিক ২০ ঘণ্টা করে কাজ করেছেন। তারপরও তার কাছে মনে হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ তৎপরতা খুবই অপ্রতুল। মানুষ দিনের পর দিন সীমাহীন আতঙ্ক ও ভোগান্তির মধ্যে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে প্রতি মুহূর্তে বাঁচার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। উদ্ধারকাজের জন্য জরুরি সেবা ও মানুষের প্রয়োজনীয় সহায়তা-সামগ্রী পর্যাপ্ত পরিমাণে ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছিল না। পানি ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না, ঘর-বাড়ি ছাড়া অসহায় মানুষ এবং উদ্ধারকর্মী। সবার জন্য খাবার রেশন ফুরিয়ে আসছিল। এমন অবস্থায় তাদের দিন কেটেছে একদিন একদিন করে। এক দিন বেঁচে আছে, তো পরদিন থাকবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না কারোরই। সার্বিক অবস্থা ছিল এতোটাই করুণ এবং নাজুক!
হা মিন আরো লিখেছেন, মানুষের লাশ ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এমন হয়েছিল, চোখ খুললেই তিনি দেখতে পেতেন শুধু লাশ আর লাশ। চোখ বন্ধ করলেও চারদিকে দেখতেন লাশের মিছিল। তাঁর অবস্থান এবং কর্মক্ষেত্র ছিল ফুকুশিমা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে। উদ্ধারকাজের সময় একদিন তাঁর সাথে দেখা হয়েছিল ভিয়েতনামি বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ারের। তাঁর নাম টোয়া। টোয়া, ফুকুশিমা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের কোনো এক রিয়াক্টরে কাজ করতেন। দুর্ঘটনায় তাঁর শরীরের বিভিন্ন জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। পরিচয় পেয়েই হা মিন সাথে সাথে টোকিও-র আমেরিকান অ্যাম্বেসীতে ফোন করেন। অ্যাম্বেসী কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে টোয়াকে নিকটবর্তী আমেরিকান মিলিটারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করে।
হা মিনের জানা মতে ওই অঞ্চলে কয়েকজন ভিয়েতনামি ছাত্রছাত্রী থাকত, কিন্তু ঠিকানা না জানায় পুলিশ অফিসার হয়েও তাঁদের ভাগ্য জানার কোনো উপায় ছিলো না তাঁর। জাপানে প্রাইভেসি প্রটেকশন আইনের কড়াকড়ির কারণে অন্য দেশের মতো পুলিশের কাছে কারো নামঠিকানা থাকে না, যার ফলে তাদের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। সাগর-সৈকত থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার ভেতরে থাকতেন এক জাপানি মহিলা। তাঁর নাম নগোয়েন থি হুয়েন। তিনি ১১ জন ভিয়েতনামি মহিলার একটি গ্রুপের সাথে কাজ করতেন। সুনামির সময় থি হুয়েন যখন দৌড়ে পালাচ্ছিলেন তখন ভিয়েতনামি মহিলারাও প্রাণপণে তাঁকে অনুসরণ করছিল অনেক দূর পর্যন্ত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনা কারো জানা নেই। নিরাপদ স্থানে এসে থি হুয়েন যখন পেছন ফিরে তাকালেন, তখন আর কাউকে দেখতে পেলেন না। শত চেষ্টা করে সম্ভবত তারাও কেউ জীবন বাঁচাতে পারেনি। সে-দিন অবধি ওই ভিয়েতনামি মহিলাদের কোনো সন্ধান মেলেনি। হা মিন দুঃখ করে লিখেছেন, টোকিওর ভিয়েতনামি অ্যাম্বেসি তাদের এই হারিয়ে যাওয়া নাগরিকদের কোনো খোঁজ-খবরই করেনি। আমেরিকান অ্যাম্বেসি যেখানে তার একজন নাগরিককে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানে ভিয়েতনামি অ্যাম্বেসি তার এতোগুলো নাগরিকের জন্য একটা ফোন কলও করেনি। উন্নত বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে নাগরিক জীবনের মূল্যায়নের ফারাক দুঃখজনক হলেও এরকমই।
পানি, বিদ্যুৎ, জরুরি চিকিৎসাসেবা ও খাবারের স্বল্পতার সাথে সাথে ঠাণ্ডার কারণে মানুষের কষ্ট বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। দিনে সহনীয় হলেও রাতে ঠাণ্ডা নেমে আসত হিমাঙ্কের কাছাকাছি। খাদ্য-পানীয়ের সাথে শীতবস্ত্রের অভাবে মানুষ হয়ে উঠছিল দিশেহারা। তখন অবস্থা এতোটাই নাজুক ছিল যে, উদ্ধারকর্মী এবং পুলিশ কর্মকর্তারাও ন্যূনতম খাবার এবং পানীয় পাচ্ছিল না। এতো দুর্দিন ও দুর্দশার মধ্যেও জাপানিরা ধৈর্য এবং শৃঙ্খলার কোনো ব্যত্যয় ঘটায়নি। এরকম বিপদের সময়েও তাঁদের আত্মসংবরণ, আত্মমর্যাদা, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগ দেখে হা মিন রীতিমত বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন!
তারপর হা মিন রচনা করেন তাঁর চিঠির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ৯ বছরের এক ক্ষুদ্র জাপানি বালকের অসাধারণ চরিত্র। চিঠিতে হা মিন তার নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু ছেলেটির করুণ কাহিনী, গভীর মানবতা বোধ ও চরম আত্মত্যাগের হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছেন। হা মিন তাঁর এই মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার কথা এভাবে লিখেছেন - উদ্ধার কাজ চলাকালীন সময়ে এক দিন রাতে তিনি গিয়েছিলেন উপদ্রুত এলাকার এক গ্রামার স্কুল-এ, যেখানে ওই অঞ্চলের আশ্রয়হীন শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল। সে-দিন রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণ এবং খাদ্য বিতরণ করা হচ্ছিল। হা মিন ছিলেন ডিউটি অফিসার। ত্রাণ নিতে আসা শরণার্থীদের লাইন ছিল অনেক লম্বা। লাইনের একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়িয়েছিল ৯ বছরের এই বালকটি। তার গায়ে ছিল একটি টি সার্ট এবং পরনে হাফপ্যান্ট। ঠাণ্ডায় ছেলেটি থর থর করে কাঁপছিল। হা মিন তার কাছে গিয়ে নিজের গায়ের জ্যাকেটটি খুলে দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন তার মায়ের কথা। ছেলেটি বললো, তার বাড়ি একেবারে সাগর তীরে। তার মা এবং ছোট বোনের কথা সে কিছুই জানে না। সম্ভবত সুনামির ঢেউয়ে তারা দুজনই ভেসে গিয়ে মিশে গেছে সাগরের নোনা পানিতে। বলতে বলতে সে চোখের পানি মুছলো।
হা মিনকে সে আরো বললো, যখন ভূমিকম্প হানা দেয় তখন সে স্কুলে পি.ই. ক্লাসে ছিল। সুনামি আসার ঠিক আগে আগে ছেলেটি স্কুল বিল্ডিঙের তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল। তার বাবা স্কুলের খুব কাছেই কাজ করতেন। সুনামির খবর পেয়ে তিনি দ্রুত গাড়ি চালিয়ে তাকে নিতে স্কুলের দিকে আসছিলেন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল তার বাবার গাড়িখানা হঠাৎ ফুলে ওঠা ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে উল্টেপাল্টে গিয়ে ডুবে গেলো ফেনায়িত সাগরের পানিতে। প্রকৃতির করাল গ্রাসে মাত্র ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে একটি বালক এক সাথে মা, বাবা ও বোনকে হারিয়ে এত বড় পৃথিবীতে একাই পথ চলার পথিক হিসেবে বেঁচে রইলো। কী নির্মম ও নিষ্ঠুর বাস্তবতা!
কীভাবে ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেবেন, হা মিন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এ-দিকে বিতরণযোগ্য খাদ্য দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল। হা মিন আন্দাজ করলেন, লাইনের শেষে আসার আগেই খাবার মজুদ শেষ হয়ে যাবে। ছেলেটির ভাগ্যে কিছুই জুটবে না। মা-বাবা-বোনকে হারিয়ে অনাথ ছেলেটি সারা রাত উপোষ করবে, হা মিনের তা সহ্য হচ্ছিল না। তিনি তাঁর নিজের খাবার প্যাকেট ছেলেটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার কাছে আসতে আসতে সব শেষ হয়ে যাবে। তুমি এটা খাও, আমি খেয়েছি। ছেলেটি প্যাকেট নিয়ে মাথা নামিয়ে জাপানি কায়দায় বাও ডাউন করে ধন্যবাদ দিলো এবং কিছুই না খেয়ে লাইনের সামনে গিয়ে ফুড বাস্কেট-এর মধ্যে প্যাকেটটি রেখে দিয়ে লাইনের শেষে এসে আবার দাঁড়াল। হা মিন অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছুই না খেয়ে ওখানে নিয়ে প্যাকেটটি রেখে দিলে কেন? ছেলেটি বলল, আমার চেয়েও বেশি ক্ষুধার্ত কেউ আমার আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন, তাই এটি আমার আগে তাঁরই পাওয়া উচিৎ।
হা মিনের মাথা লজ্জায় হেঁট হয়ে এলো। তিনি বললেন, যে সমাজ এবং শিক্ষা ব্যবস্থা একটি ৯ বছরের বালককে এমন উন্নতমানের মানবতা বোধ ও আত্মত্যাগ শিক্ষা দিতে পারে, সে সমাজের ক্ষয় নেই, সে জাতির পরাজয় নেই! বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হা মিনের গল্প শুনে আমার দুটো কথা মনে পড়ল। প্রথমত, ছোটবেলা ক্লাস নাইনে চিলড্রেন ইন হিস্টরিতে পড়েছিলাম, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশন। হ্যাঁ, সত্যি, বাস্তবতা কখনো কখনো কল্পনাকেও হার মানায়! দ্বিতীয়ত, একজন জাপানি পুলিশ অফিসার যখন চিঠির মাধ্যমে একটি ৯ বছরের বালকের মানবতা বোধ ও চরম আত্মত্যাগের কথা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন সারা পৃথিবীতে, তখন বাংলাদেশের র্যাবব-পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় জীবনসংগ্রামে অগ্রগামী আরেক বালক, ঝালকাঠির লিমন হোসেনের পায়ে গুলি করে, পঙ্গু করে মামলা সাজাবার ফন্দিফিকির আঁটছিল। উন্নত বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বে জীবনযাত্রার মান নির্ণয়ের এটিও একটি মানদণ্ড বটে! কোথায় তাঁরা আর কোথায় আমরা!
ন্যাশভিল, মার্চ ২০১১
The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
Share on Facebook               Home Page             Published on: 10-Jul-2018