ডিম ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা আবু এন. এম. ওয়াহিদ
আমার প্রিয় খাবার সমূহের মধ্যে ডিম অন্যতম। যে তরিকাতেই পরিবেশন করা হোক না কেন, ডিমে আমার কোনোদিনই অরুচি ছিল না, এখনো নেই। এই বয়সেও আমি একবারে দু’টো-তিনটে, এমন কি চারটে ডিমও খেয়ে ফেলতে পারি, কদাচিৎ খেয়েও থাকি, কিন্তু সুস্থ ও সুঠাম শরীর গঠনের জন্য যে সময় আমার নিয়মিত ডিম খাওয়ার কথা ছিল তখন কপালে জুটেনি। পরিবারের স্বল্প আয় এবং সদস্য সংখ্যা অধিক হওয়ায় কালেভদ্রে এমন সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার আমার পাতে পড়ত। তার মানে এই নয় যে, তখন ডিম একটি দুর্মূল্য বস্তু ছিল। বাংলাদেশের গ্রামে যে সময় (উনিশ শ’ ষাটের দশকে) আমার বেড়ে ওঠা তখন এক হালি আন্ডার দাম ছিল মাত্র চার আনা, তথাপি এই জিনিসটি কিনে খাওয়া আমাদের বাড়িতে ছিল নিতান্তই বিলাসিতা। শহরের মানুষ ডিম খায় প্রধানত সকাল বেলা নাস্তার সাথে। আমরা চাষাভুষাদের সাথে অজপাড়া গাঁয়ে বড় হয়েছি, আমাদের আবার নাস্তা কিসের। বেলা ন’টার দিকে ডালভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম, বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে শাকসবজির সাথে এক প্লেট ভাত পেতাম। রাতে বাজার থেকে মাছ এলে ঝোলের সাথে ছোট্ট এক টুকরো ভাগে পড়ত, না এলে আবার ডালভাত, নয়তো বা ক্ষেতের লাউ অথবা কচুর মুখি। গোশত খেতে পেতাম ঈদে-পর্বে কিংবা মেহমান এলে - মেহমান মানে বাড়ির জামাই অর্থাৎ ফুফারা। বুঝতেই পারছেন, আঙিনায় এ জাতীয় অতিথিদের পদধূলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঈদ শুরু হয়ে যেত!
ছোটবেলা যেমন ভালো-মন্দ খাবার আয়োজনে আনন্দ পেতাম, আজও পাই, তবে এ দুয়ের মাঝে খানিকটা তফাৎ হয়ে গেছে। আজকাল কাজের ছুতোয় যখন দেশবিদেশে যাই তখন নানা জায়গায় নানা জাতের বিচিত্র রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়ার দিকে সর্বদা আমার কৌতূহলী নজর থাকে। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখি, বোঝার চেষ্টা করি, পারস্পরিক তুলনা করি। দুনিয়ার দেশে দেশে অন্যান্য খাবারের সাথে ডিম যে কতভাবে রান্না এবং খাওয়া হয় তা এখনো দেখছি, জানছি এবং শিখছি। জানি না, এ জানার আর কত বাকি! যখন বুদ্ধি হয় তখন মাত্র তিন পদ্ধতিতেই ডিম খেতে শিখেছি - সিদ্ধ ডিম, ডিমের ঝোল ও ডিম ভাজি। মাথায় স্মৃতিশক্তি দানা বাঁধার আগে মা যদি কোনোভাবে এই খাবারটি খাইয়ে থাকেন সে কথা তো আর বলতে পারব না, তবে বুদ্ধি হওয়ার পর আমার প্রথম ডিম খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা মজার বৈকি! যেদিন একটি ডিম্বের নাগাল পেলাম সেদিনটি আমার কাছে ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দের। ওই দিন একটি মুরগির ডিম হাতে পেয়ে আমি যতটা খুশি হয়েছিলাম, আজ কেউ একটি সোনার ডিম দিলেও সেভাবে পুলকিত হব না, আর ‘ঘোড়ার ডিম’ - তা পেলেই বা কী, আর না পেলেই বা কী, উভয়ই সমান! সেদিন কিভাবে আমি ডিমটির মালিক হয়েছিলাম তা সঠিক মনে না থাকলেও এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, এটি ছিল হয় চুরি করা, নয়তো বা কুড়িয়ে পাওয়া। একান্নবর্তী পরিবার, বড় বাড়ি, পাঁচটা থাকার ঘর, কাজের লোকসহ ৩০/৩৫ জন মানুষের সংসারে আমরা যে ঘরে থাকতাম সেখানে চুলা ছিল না। এখন ডিম খাই কি করে। জিনিসটিকে কোনোভাবে খাওয়ার যোগ্য করতে হলে তো নিতে হবে রান্নাঘরে, কিন্তু সমস্যা হলো, সেখানে ডিম নিয়ে গেলে মা-চাচী না থাকলেও কাজের মেয়েরা জেনে যাবে, বাড়ি জুড়ে হৈচৈ পড়ে যাবে, লোকমান ডিম পেল কোথায়! এ অবস্থায় আমি ভাবছি, কী করা যায়।
এদিকে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে, টেবিলে পড়তে বসেছি, হঠাৎ আমার মাথায় এক বুদ্ধি এলো, ডিমটি এনে সাহস করে হারিকেনের মাথায় রেখে আগুনের সলতেটা একটু উপরের দিকে তুলে দিলাম। দশ-পনেরো মিনিট পর পর আমার প্রিয় খাদ্যবস্তুটিকে পর্যায়ক্রমে ঘুরিয়ে দিতে লাগলাম যাতে গোটা ডিমে সমানভাবে আগুনের উত্তাপ লাগে। এভাবে আনুমানিক ঘণ্টা খানেক তেল-পানি ছাড়া শুকনো রান্নার পর ডিম্বখানা সাবধানে নামিয়ে টেবিলে ঠুকা দিয়ে দেখি, সিদ্ধ হয়েছে। এবার খোসা ছাড়ানোর পালা। ডিম ছিলতে গিয়ে এক অজানা নতুন সমস্যার মুখোমুখি হলাম। আঙ্গুল দিয়ে খুঁটে খুঁটে খোসা টুকরো টুকরো করে তুলে আনছি ঠিকই, কিন্তু ডিমের গায়ে পাতলা পরত রয়েই যাচ্ছে। ডিমকে অক্ষত রেখে তার পেট-পর্দা তুলে আনা যে কি কঠিন কাজ সেটা সেদিন ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম! এই হলো আমার প্রথম ডিম খাওয়ার অভিজ্ঞতা।
পরবর্তী পর্যায়ে ডিম ছিলতে আমার আরো দু’টো সমস্যা হত এবং এখনো হয়। প্রথমত, ঝিল্লিসহ খোসা তুলতে গেলে ডিমের সাদা অংশ খাবলা খাবলা হয়ে উঠে আসে এবং ডিমের উপরিভাগ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, ডিমের খুদে খুদে ভাঙ্গা খোসার টুকরো আঙ্গুলের একটু চাপ লাগলেই ছিলা ডিমের গায়ে গেঁথে গিয়ে ডুব দেয়, খেতে গেলে জিব নাড়াচাড়ার সময় মুখগহ্বরে ভেসে ওঠে, খোঁচা মারে, অস্তিত্বের জানান দেয়।
ডিমের ঝোল রান্নাতে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। কোনোক্রমে বাড়িতে ডজন দেড়ক ডিম জমা হলে সবগুলো সিদ্ধ করে দাদী দুপুরবেলা ডিমের ঝোল রান্না করতেন। মনে রাখবেন, এটা কিন্তু পাতলা ঝোলের তরকারি, ডিম ভুনা নয়। খাবার আগে আগে, লাল তরল পানি থেকে তুলে বটিতে বসে একটি ডিমকে চার ভাগ করা হত এবং এর এক ভাগ আমাদের ভাগে পড়ত। এবার বুঝুন, ডিমের কাঙাল কাকে বলে! তবে বলতে হয়, ডিম ভাজির ব্যাপারে আমার ভাগ্য একটু সুপ্রসন্নই ছিল, কিন্তু সেটা এমনি এমনি পাওয়া যেত না। মায়ের বকুনি অথবা মার খেয়ে কান্নাকাটি করতে থাকলে কদাচিৎ কান্না থামানোর জন্য আম্মা একটা ডিমের সাথে কুচি কুচি করে শুকনো মরিচ এবং চাকতি চাকতি করে পেঁয়াজ কেটে ডিম ভাজি করে দিতেন। তৃপ্তির সাথে পেট ভরে খেয়ে বলতাম, আহা কী মজা! তবে সব কান্নাকাটির সাথে আপসে আপসে যে ডিম ভাজি পাওয়া যেত, তা কিন্তু নয়।
অবশ্য হাই স্কুলে যাওয়ার আগেই ‘হাফ বয়েল’ বলে ডিমের আরেক পদের সাথে পরিচয় হয়ে যায়, কিন্তু তার স্বাদ কেমন তা জানার কোনো উপায় ছিল না। আম্মাই ডিমকে হাফ বয়েল করতেন। চায়ের পাত্রে ফুটন্ত পানিতে তিনি সাবধানে ডিম ভেঙ্গে সযত্নে পুরো ডিম ঢেলে দিতেন। দু’এক মিনিটের মধ্যেই উত্তপ্ত পানিতে ডিমের কুসুম, শ্বেতাংশের সাদা আস্তরণের মাঝে বন্দী হয়ে পড়ত। তারপর বড় চামচ দিয়ে, না শক্ত না নরম, থলথলে নিখুঁত হাফ বয়েল ডিম গরম পানি থেকে ছোট পিরিচে তোলা হত পরিবেশনের জন্য। হলে কি হবে, হাফ বয়েল ডিম আমি কেন, বাড়ির অন্য কেউই খেতে পেতেন না। একটি বিশেষ উপলক্ষে, একটি বিশেষ দিনে, এক জন বিশিষ্ট অতিথিকে আপ্যায়ন করা হত এই জাতীয় ডিমের খাবার দিয়ে। বাড়িতে কারো অসুখ-বিসুখ হলে আব্বার বন্ধু ডা: আব্দুস শাকুরকে বড়লেখা বাজার থেকে ডেকে আনা হত। তিনি ভেতর বাড়িতে ঢুকে দাদীর ঘরের পাশে একটি বড় কামরায় দাদার চেয়ারে বসতেন। আব্বা আরেকটি চেয়ার টেনে বন্ধুর পাশে বসতেন। শুকুর চাচা শুরুতে থার্মোমিটার হাত দিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে চোখের কাছে নিয়ে কী যেন খুব সূক্ষ্ম ভাবে দেখতেন, তারপর রোগীর জিবের নিচে কিংবা বগলে দিতেন, ঘড়ি দেখে ছোট্ট কাঠির মতন যন্ত্রটি বের করে আবার তীক্ষ ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আব্বাকে বলতেন - ‘নরম্যাল’। আমি তো ‘নরম্যাল’ মানে জানি না, ভাবতাম, ‘নরম্যাল’ বুঝি একটি রোগের নাম। রোগী দেখে ওষুধপত্র লেখার পর হাত ধুয়ে ডাক্তার চাচা আবার চেয়ারে এসে বসতেন। তখনই তাঁর জন্য পরিবেশন করা হত এই মহামূল্যবান উপাদেয় খাদ্যবস্তুটি। তিনি পুরো হাফ বয়েল ডিমটা একবারেই খেয়ে ফেলতেন। বালক বয়সে আমি ভাবতাম, হাফ বয়েল ডিম খেতে হলে আমাকে আগে ডাক্তার হতে হবে। তা তো হইনি, আর তাই বুঝি হাফ বয়েল ডিম বলতে গেলে আমার খাওয়াই হয় না। যাওয়ার সময় ওই বিশেষ অতিথির হাতে আব্বা দশ টাকার একখানা নোট গুঁজে দিতেন।
পাঠশালা পাস করে যখন হাই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হলাম তখন শিখলাম আরেক কায়দায় ডিম খাওয়া, কিন্তু সেটা কি সত্যি ডিমের ভিন্ন আরেকটি আইটেম, সে-ও এক প্রশ্ন বটে! তখন বাংলাদেশের গ্রামে এমন কি শহরেও রেস্টুরেন্টকে হোটেল বলা হত, যেমন বুক স্টোরকে বলত লাইব্রেরি। অবশ্য এ ব্যাপারে বড়লেখার হামিদ মিঞা ছিলেন একটু ব্যতিক্রমী। রেল স্টেশনের পূব দিকে রাস্তার ওপর তাঁর একটি খাবার দোকান ছিল। এর নাম ছিল ‘হামিদ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’। তাঁর দোকানের সাথে সত্যি সত্যি একটি ছোট্ট হোটেলও ছিল। ভাটি অঞ্চলের লোকজন মৌলভীবাজার কোর্টে হাজিরা দেওয়ার জন্য এই হোটেলে রাত কাটিয়ে ভোরের ট্রেন ধরতেন। এটাই ছিল তৎকালীন বড়লেখার প্রথম এবং একমাত্র হোটেল। হামিদ রেস্টুরেন্টে ডিমের ‘মামলেট’ (গ্রামের ভাষায় ‘ওমলেটকে’ই বলা হয় ‘মামলেট’) বিক্রি হত। বন্ধুবান্ধবের কাছে আমি এ কথা শুধু শুনেছি - খাবারটি কখনো দেখিওনি, খাইওনি। এক সময় ‘মামলেট’ খাওয়ার জন্য আমার খুব লোভ হলো। কেমনে কেমনে পয়সাও জোগাড় হয়ে গেল। তারপর একদিন হামিদ মিঞার দোকানে গিয়ে বললাম, আমাকে একটি ‘মামলেট’ দাও। ওই সময় একটি ‘মামলেটে’র দাম কত ছিল তা আজ আর মনে নেই - হয়তো বা ছ’পয়সা কি দু’আনা। কতক্ষণ পরে খালি গায়ে ঘাড়ে গামছা ঝুলিয়ে ছোট্ট এক ছেলে চায়ের পিরিচে করে নিয়ে এলো সাধের ও স্বাদের ‘মামলেট’। আমি খেয়ে বললাম, অহ! এই বুঝি ‘মামলেট’, এটা তো আমি খেয়েছি - আমরা একে বলি ডিম ভাজি, আর সিলেটের খাঁটি গেঁয়ো ভাষায় বলে, ‘বইদা বিরান’! (‘বইদা’ শব্দটি এসেছে আরবি ভাষা থেকে)।
বর্ষাকালে আম্মার সাথে নানার বাড়ি যখন নাইয়র যেতাম বড়খালা মাটির চুলায় কেমন কেমন করে ডিম-দুধ-চিনি দিয়ে পুডিং বানিয়ে ফেলতেন। পুডিং-এর মিষ্টি-মধুর স্বাদ ও গন্ধ ভালোই লাগত। প্রথম যেদিন খেলাম, দই ভেবে মুখে দিয়েছিলাম, খেয়ে বুঝলাম এ-তো দই নয়, অন্য কিছু, আরও মজার কিছু! এর নাম যে পুডিং, সেটা জেনেছি অনেক পরে। নানার বাড়িতে আরেকটা জিনিস খেতাম যেটা আমাদের বাড়িতে রান্না হত না। পরোটার সাথে মুরগীর রোস্ট। সেটা তখনই হত, নাইয়র শেষে আম্মাকে নিতে আব্বা যখন তাঁর শ্বশুরবাড়ি আসতেন। একেই বলে, ‘জামাই আদর!’ নানা-নানী আমাদেরকে এত স্নেহ করতেন, কিন্তু ‘জামাই’ না এলে বাড়িতে রোস্ট হত না!
হাই স্কুল ও কলেজ শেষ করে ১৯৭০ দশকের গোঁড়ার দিকে ঢাকায় এসে যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন বুঝলাম, শহরের সব লোকও স্বচ্ছন্দে ডিম খেতে পায় না। এক দিন সকাল বেলা আমার এক মামার বাসায় গিয়েছি (আম্মার ফুফাতো ভাই)। ওই মামা ছোটখাটো নয় বড় চাকরিই করতেন। তখন তিনি ওয়াপদা-র নির্বাহী অথবা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। পরিবাগে একটি সরকারি ফ্ল্যাটে থাকতেন। মামার ঘরে উঠতি বয়সের স্কুল-পড়ুয়া চারটি ভাইবোন ছিল। নাস্তার পরে চা খেতে খেতে শুনলাম মামা, মামীকে বলছেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েদের বল, ডিম ও দুধের মধ্যে একটা বেছে নিতে। সকালে নাস্তায় ডিম খেলে দুধ পাবে না। এই আকালের বাজারে আমার পক্ষে দু’টোর আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব নয়।’ বলাই বাহুল্য, মামা আজীবন সততার সাথেই চাকরি করে গেছেন। একজন সৎ সিনিয়র প্রকৌশলীর জীবনসংগ্রাম তখন কেমন ছিল, আর আজ কেমন, আপনারাই মিলিয়ে নিন।
বিয়ের পর ডিমের হালুয়া ও ডিমের বরফি খেয়েছি ঢাকায় আমার শ্বশুরবাড়িতে। আমার শাশুড়ি নানান জাতের খান্দানি খাবার তৈরিতে খুব পারঙ্গম ছিলেন। আমার শ্বশুরও খাওয়াদাওয়ায় ছিলেন ভীষণ সৌখিন। তাঁদের বাড়ির সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান ছিল অতি উঁচু মানের। কানাডায় যখন পড়তে এলাম তখন প্রথম পরিচয় হলো ডিম পোচ ও এগ স্যান্ডুইচের সাথে। ডিম পোচ ঘরেই পাওয়া যেত। আমার স্ত্রী নিজেই বানাতেন। আর এগ স্যান্ডুইচ খেয়েছিলাম ১৯৮১ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে ক্যালগারি থেকে উইনিপেগ ফিরে আসার পথে। তখন আমার এক মামাশ্বশুর সপরিবারে ছবির মতন সুন্দর সেই শহরে থাকতেন। তাঁর আমন্ত্রণে ও বদান্যতায় আমি ও আমার স্ত্রী বাসযোগে দেড় দিনে পশ্চিম কানাডার এই এক শহর থেকে আরেক শহরে গিয়েছিলাম। আসার দিন, পথে খাবার জন্য আমার মামীশাশুড়ী নিজ হাতে অতি যত্ন করে কয়েকটি এগ স্যান্ডুইচ বানিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে, পথে কিনে খাওয়ার পয়সাটা বেঁচে গিয়েছিল। সেটাও ওই সময়ের জন্য কম কথা ছিল না। আমেরিকায় যখন এলাম তখন পরিচয় হলো এগ সালাদ ও স্ক্র্যাম্বল্ড এগের সঙ্গে। ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে বিশেষ করে সকালের ও দুপুরের পার্টিতে এগুলো পরিবেশিত হয়ে থাকে। উনিশ শ’ আশির দশকের গোঁড়ার দিকে আমরা বস্টন ছিলাম। ওই সময় আমাদের প্রতিবেশী এক নববিবাহিত প্রকৌশলী-দম্পতির বাসায় প্রথম খেয়েছিলাম ডিম ও কিমা দিয়ে তৈরি নার্গিসি কাবাব।
বছর দুয়েক আগে ন্যাসভিল আইসিএন-এর (একটি মসজিদের নাম) পাশে ‘ফ্রথি মাংকি’- রেস্টুরেন্টে একদিন নাস্তা খেতে গিয়ে পরিচয় হলো ফ্রাইড এগের সঙ্গে। রুটি-মাখনের সাথে ওয়েটার যখন ফ্রাইড এগ নিয়ে এলো, দেখেই ভাবলাম, অহ, এ-তো পোচ! কিন্তু এটা যে পোচ ছিল না এবং এ দু’য়ের মাঝে যে একটি তফাৎ আছে, তা পাশাপাশি দেখে শিখেছি মাত্র সেদিন এবং এই জ্ঞান লাভের জন্য আমাকে যেতে হয়েছে সুদূর ব্যাংককে। হোটেলের ক্যাফেটেরিয়াতে নাস্তা খেতে গিয়ে দেখি একই জায়গায় দুই প্ল্যাটারে দুই কিসিম ডিম রাখা। এক জায়গায় যেন, ছোট ছোট সাদা আসমানের ওপর রক্তিম সূর্য ভাসছে - অর্থাৎ ডিম পোচ, পাশেই রাখা ফ্রাইড এগ দেখতে হাফ বয়েল ডিমের মতন। ফ্রাইড এগ ও হাফ বয়েল ডিমের পার্থক্য হলো তেল আর পানির। ফ্রাইড এগ রান্না হয় গরম তেলে, আর হাফ বয়েল ডিম হয় গরম পানিতে। এবার পোচের সঙ্গে ফ্রাইড এগের তফাৎ কী, তা বলব? গরম তেলে ডিম ভেঙ্গে দিয়ে কুসুমকে অক্ষত রেখে এক দিক রান্না করে পরিবেশিত হলে এটাকে বলবে পোচ, আর এটা যদি উল্টিয়ে দিয়ে দুই দিক রান্না করেন তাহলে হয়ে যাবে ফ্রাইড এগ, ব্যাস। সব শেষে বাকি থাকল ওমলেট ও ওমলেট-মাসালার ভিন্নতা। এ দু’টোই ডিম ভাজির আলাদা দুই সংস্করণ। পেঁয়াজ-মরিচ ছাড়া ডিম ভাজি করলে এটা হবে - ওমলেট আর পেঁয়াজ-মসলা দিলে হবে ওমলেট-মাসালা। এ কথা শিখেছি ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মুম্বাই এয়ারপোর্টের কাছে অবস্থিত ‘হলিডে ইন’-এর ‘সপ্তমী’ ক্যাফেটেরিয়ায় কর্মরত তরুণ ও চৌকস ওয়েটার ‘সানী’-র কাছে।
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|