bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













‘ঢাকার ভেতরে আরেক ঢাকা’
আবু এন এম ওয়াহিদ



যদিও বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু ‘ঢাকার ভেতরের ঢাকা’, তথাপি শুরু করছি কলকাতার গল্প দিয়ে। ঢাকা-কলকাতার দূরত্ব খুব বেশি নয়, তারপরও এ সম্পর্কের মধ্যে আছে একটি বিশেষ শানে-নযুল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঠকদের কাছে তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এ লেখার ধারণা ও প্রেরণার উৎস ইউটিউবে দেখা কলকাতার ‘তারা নিউজ’-এর অনুষ্ঠান ‘বই পড়া বইপাড়া’। দেখেছি বেশ ক’বছর আগে। অনুষ্ঠানটি একটি জনপ্রিয় টক শ’ - প্রাইম টাইমে প্রচারিত হতো প্রতি রোববার; এখন হয় কিনা জানি না। এর উপস্থাপক, লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় একেক সপ্তাহ পশ্চিমবঙ্গের একেক জন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে স্টার ম্যাক্সের নির্দিষ্ট স্টুডিওতে বসে আড্ডা জমাতেন। এই আলোচনায় অনেক মজার মজার কথা, গল্প, কাহিনী, ঘটনা, তথ্য, ইত্যাদি শুনতে পাওয়া যেতো। উপস্থাপক তাঁর এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে একদিন এনেছিলেন কবি শ্রীজাতকে। শ্রীজাত পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রতিষ্ঠিত এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ কবি।

শ্রীজাত আগাগোড়া শহুরে মানুষ। কলকাতায় তাঁর জন্ম, কলকাতাতে বেড়ে ওঠা, কলকাতাতেই লেখাপড়া, বসবাস, চাকুরী, এবং মূলত কলকাতাই তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু। বিনয় মজুমদার বা জীবনানন্দ দাস যেখানে পল্লিগ্রামে ধান ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে যেতে যেতে কবিতা লিখতেন, সেখানে শ্রীজাত কলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে নগরজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উচ্ছ্বাস, ঘটনা-দুর্ঘটনা, ব্যস্ততা ও বিড়ম্বনা নিয়ে কবিতা লেখেন। তাঁর ভাবনা-চিন্তায়, সাহিত্যকর্মে ও কবিতায়, কলকাতা এবং কলকাতার নাগরিক-জীবন ঘুরেফিরে জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে। শ্রীজাত তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে কলকাতাকে আর দশ-পাঁচ জনের চেয়ে ভিন্নভাবে দেখেন, অন্যভাবে অনুভব করেন। তিনি নিজেকে আসবাবের কবি মনে করেন না, বরং কলকাতার ফুটপাতের কবি হিসেবে পরিচিত হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে কথাপ্রসঙ্গে কবি শ্রীজাত, শঙ্খ বাবুর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলছিলেন, ‘কলকাতার ভেতরে আছে আরেকটি কলকাতা’। তাঁর কথায় আরো বোঝা গেল, ভেতরের কলকাতাকে অনেকে দেখতে পায় না, চিনে না, জানে না, বোঝে না এবং বুঝতেও চায় না, অথচ এটাই আসল কলকাতা, এটাই কলকাতার প্রাণ। কলকাতার ভেতরের কলকাতা কোথায়? দেখতে কেমন? তার পরিচয় কি, বৈশিষ্ট্য কি? এবিষয়ে শঙ্খ বাবুর বক্তব্য আমার জানা নেই, এবং কবি শ্রীজাতও ওই দিন এর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি।

তবু নিজের সাধারণ জ্ঞান থেকে যা বুঝেছি তা যদি সঠিক হয়, তাহলে শঙ্খ বাবুর ভাষায় আমিও বলতে পারি, ঢাকার ভেতরেও আছে আরেকটি ঢাকা। আর এই ভেতরের ঢাকার খোঁজ নিয়েই আজ সাহস করে আমি দু’কলম লিখতে বসেছি। সাহস করে বলছি এজন্য, কারণ ঢাকার অন্তরাত্মা নিয়ে লিখছি অথচ আমার জন্ম হয়নি ঢাকায় এবং আমি বড়ও হইনি ঢাকায়, তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে থাকি সুদূর উত্তর আমেরিকায়। তবে জীবনের একটি মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ সময় আমি ঢাকার পাশে থেকেছি, ঢাকায় কাটিয়েছি। মোটামুটি উনিশ শ’ সত্তরের পুরো দশক ধরেই আমি চষে বেড়িয়েছি ঢাকার অলিগলি তস্যগলি। ওই সময়টাতে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ছাত্র এবং পরে শিক্ষক ছিলাম। বিভিন্ন কাজে সপ্তাহে অন্তত তিন/চার দিন ঢাকায় আসতাম ইউনিভার্সিটির বাসে, কিন্তু শহরে বেশিরভাগই চলাফেরা করতাম পায়ে হেঁটে, কারণ পাবলিক বাসে ওঠানামা এখনকার মত তখনও কঠিন ছিল এবং রিক্সা চড়ার মত পয়সা পকেটে ছিল না। দু’এক বার দৈবসুযোগে গাড়িতে করেও ঢাকা শহরে ঘোরার সুযোগ পেয়েছি। কীভাবে? সেটা আজ নাইবা বললাম। কর্মচঞ্চল বিশাল ঢাকার বুকে দু’ভাবে চলাফেরার অভিজ্ঞতা থাকায় তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, উইন্ডো-গ্লাস নামিয়ে ড্রাইভার চালিত প্রাইভেট কারে চড়লে যে ঢাকা দেখা যায়, স্যান্ডেল পায়ে তপ্ত রোদে মল-মূত্রের দুর্গন্ধ নাকে নিয়ে ফুটপাতে হাঁটলে সম্পূর্ণ অন্য এক ঢাকা দেখা যায়। আর এই অন্য ঢাকাই বোধ হয়, ‘ঢাকার ভেতরের ঢাকা’। যে পথ ধরে সত্তরের দশকে আমি ঢাকার ফুটপাতে হেঁটেছি এবং না জেনেই ঢাকার ভেতরের ঢাকাকে দেখার চেষ্টা করেছি, তার আশপাশের দালানকোঠার হয়ত এখন পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ফুটপাথগুলো যেমন ছিল তেমনি আছে। আমার আট ন’বছরের ওই জীবনে ঢাকার এমন খুব কম রাস্তাই আছে যে পথে আমার পায়ের ধুলো পড়েনি। দিনে ঢাকায় ঘোরাঘুরি করলেও রাতের ঠিকানা ছিল সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা হাওয়ায় ঢেউ খেলা নির্মল নিরিবিলি ক্যাম্পাস। তবে মাঝেমধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকা শহরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কিংবা বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এবং ঢাকা কলেজের হোস্টেলে রাত কাটিয়েছি। এ কারণে সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত ব্যস্ত নগরজীবনের চিত্র আমি যেভাবে দেখেছি, সেভাবে ভোরবেলার ঢাকাকে দেখার সুযোগ পাইনি। তবে অনেক বছর আগের একদিনকার কথা আজ বড় মনে পড়ে।

উনিশ শ’ তিয়াত্তর/চুয়াত্তর সালের কথা। এপ্রিল-মে মাসের কোনো এক সময়। ঢাকায় ভারতীয় চলচ্চিত্র উৎসব চলছে। যে সব ছবি দেখানো হচ্ছিল তার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘অশনি সংকেত’ও ছিল। ছবিটি দেখার জন্য অন্যদের মত আমারও খুব ইচ্ছে হল, কিন্তু একখানা টিকেট যোগাড় করা ছিল বেজায় কঠিন কাজ। নিউ মার্কেটের উল্টো দিকে বলাকা সিনেমা হলে চলছিল ‘অশনি সংকেত’। টিকেটের জন্য অনেক কষ্ট করে কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের ভিড় ঠেলে যখন বক্স অফিসের কাছে গেলাম তখন শুনলাম টিকেট সব বিক্রি হয়ে গেছে। তারপর ঘুরতে লাগলাম দালালদের খোঁজে, ব্ল্যাকে টিকেট কিনতে পারি কিনা। সূর্যসেন ও মহসিন হলের পশ্চিম দিকে তখন ছিল এক বিস্তৃত ঘন বস্তি। সেই বস্তির অলিতে গলিতে ঘুরেছি দালালদের পেছনে পেছনে। অবশেষে অনেক দাম দিয়ে একটি টিকেট কিনেছিলাম এক দালালের কাছ থেকে। আমাকে বলল,‘টিকেটটি ফার্স্ট শো’র যেটা রাত ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চলে। পরে দেখলাম দালাল আমাকে দামেও ঠকিয়েছে, টিকেটেও ঠকিয়েছে, অর্থাৎ ওই টিকেটটি ফার্স্ট শো’র নয়, ছিল সেকেন্ড শো’ বা লাস্ট শো’র, যেটা শেষ হয় রাত ১২টায়।

আমার জীবনে আমি শেষ শো’ সিনেমা একবারই দেখেছি এবং সেটা ঐ রাতেই। সিনেমা দেখব, না ক্যাম্পাসে চলে যাব, এনিয়ে নিজেই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করছি, এমন সময় কয়েক বছর পর হঠাৎ দেখা হল আমার এক পুরনো কলেজ বন্ধুর সঙ্গে। এ মুহূর্তে তার নামটা মনে পড়ছে না। তাকে আমার টানাপোড়নের কথা জানালাম। সে বলল, ‘আমি এই মাত্র ছবিটি দেখে বের হলাম। এটা দেখার মতই। টিকেট যখন কিনে ফেলেছ, সিনেমাটা দেখেই যাও, এবং রাতে আমার সাথে থাকতে পার। আমি ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থাকি’। এই বলে তার রুম নাম্বর দিয়ে সে চলে গেল। আমিও আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। রেস্টুরেন্টে বসে চা-টা খেলাম। তারপর ন’টা-বারো’টা সিনেমা দেখে ঢাকা কলেজ হোস্টেলে গিয়ে বন্ধুর সাথে রাত কাটালাম। বন্ধুটি যদিও বিছানা ছেড়ে দিয়েছিল, তবু ঘুম ভাল হল না, কারণ সে রাতে গরম ছিল ভীষণ। খুব ভোর বেলা পূবের আকাশ ফরসা হতেই বেরিয়ে পড়লাম। যখন বের হলাম, তখন মিরপুর রোডের যে চিত্র দেখেছিলাম, তখন বুঝিনি, কিন্তু আজ শঙ্খ বাবুর কথা শুনে মনে হচ্ছে, সেটা ছিল ওই সময়ের ‘ঢাকার ভেতরের ঢাকার’ই এক খন্ডচিত্র।

এবার শুনুন তার বয়ান। মিরপুর রোডের দু’ধারে ফুটপাতে মানুষ শুয়ে আছে লাইন ধরে। কেউ মাত্র ঘুম থেকে উঠে দেয়ালের মুখোমুখি হয়ে প্রাকৃতিক কাজকর্ম সারছে, কেউ বদনা থেকে পানি ঢেলে হাতমুখ ধুচ্ছে, কেউ ছাই দিয়ে আঙ্গুলে ঘষে দাঁত মাজছে। কেউ তখনো ঘুমোচ্ছে আরামের ঘুম। কারো গায়ে পাতলা চাদর, কারো গায়ে গেঞ্জি, কেউ খালি গায়েই নিদ্রামগ্ন। দিনে বা রাতের প্রথমদিকে যতই গরম থাকুক, শেষ রাতে খোলা বাতাসে ফুটপাথ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে খেটে-খাওয়া মানুষগুলো নিশ্চিন্ত মনে কি আরামেই না ঘুমোচ্ছিল! অথচ তিনতালা বিল্ডিংয়ের নরম বিছানায় গরমে আমি সারারাত ছটফট করেছি। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, মানুষের ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি কুকরও সামনের পা দুখানি ছড়িয়ে দিয়ে আরামছে ঘুমোচ্ছে। জন্তুজানোয়ারের মধ্যে কুকুরই যে সবার আগে মানুষের পোষ মেনেছিল তার প্রমাণ সেদিন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম। সূর্য তখনো ওঠেনি। রাস্তায় গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। দু’একজন রিকশাওয়ালা দেখলাম গুটিসুটি মেরে নিজের রিক্সাতেই আধা-শোয়া আধা-বসা অবস্থায় ঘুমোচ্ছে।

পুরো রাস্তা তখন ধাঙড়দের দখলে - চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। যতদূর চোখ যায় মিরপুর এবং আজিমপুর দু’দিকে তাকিয়ে দেখলাম কয়েক ডজন মেথর রাস্তা ঝাড়– দিচ্ছে, এবং ময়লা ধুলোবালি সাফসুতরা করছে। এরই মধ্যে রাস্তার পরিষ্কার অংশ ঝকঝক তকতক করছে। এত পরিষ্কার রাস্তা আগে কখনো চোখে পড়েনি, এবং এত লোক যে ঢাকার রাস্তা সাফ করতে প্রতিদিন ভোরবেলা বেরিয়ে আসে সেটাও ছিল আমার ধারণার অতীত। গল্পের এখানেই শেষ নয়। সকালবেলা নগরের রাস্তা সাফ করতে শুধু যে মেথররা একাই আসে তা নয়, আসার সময় তারা সাথে করে নিয়ে আসে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। দেখলাম মা-বাবারা রাস্তা ঝাড়– দিচ্ছে, আর বাচ্চারা ফুটপাথে বসেই খেলছে, খাওয়া-দাওয়া করছে, মারামারি করছে, কান্নাকাটি করছে, এবং বাচ্চারা যা করে তাই করছে। কেউ ফুটপাতে রাখা মুড়ি কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছে, কেউ কুকি-বিস্কুট কামড়াচ্ছে, কেউ কলা খাচ্ছে আর চারি দিকে মাছি ভনভন করছে। ফুটপাথে তখনো কেনাকাটা কিংবা পথচারীদের আনাগোনা শুরু হয়নি, দোকানপাট খোলারও সময় হয়নি।

বিদেশে থাকলেও মাঝেমধ্যে দেশে যাই। কখনো বেশিদিন থাকি, কখনো অল্প দিন। সম্প্রতি আমি ঢাকা গিয়েছি ২০০৮ সালে। তার আগে গিয়েছি ১৯৯৯তে। এ ন’বছরেও ঢাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি ঢাকায় গেলে যাই গরমের সময় যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। উঠি আমার শ্বশুরবাড়ি মোহাম্মদপুরে স্যার সৈয়দ রোডে। বৃষ্টিবাদল না হলে, ঢাকায় থাকাকালীন সময়ে আমি ভোরবেলা চন্দ্রিমা উদ্যানে হাঁটতে যাই। এবার বলছি ১৯৯৯তে কি দেখলাম এবং ৯ বছর পরে গিয়ে কি পরিবর্তন দেখলাম তার হাল হকিকত। ১৯৯৯তে যখন চন্দ্রিমা উদ্যানে যেতাম তখন দেখতাম হাজার হাজার লোক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষই ছুটে আসত মর্নিং ওয়াক করতে। কারো মাথায় টুপি, হাতে লাঠি, বগলে ছাতা। দলে দলে সবাই হাঁটছে, কথা বলছে, ঘামছে। কেউ পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছে, কেউ ঝরাচ্ছে তো ঝরাচ্ছে, কেউ বিড়ি-সিগ্রেট খাচ্ছে, কেউ কাশছে, থুথু ফেলছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ লেকের পারে একটুখানি বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। কেউ বসে রসিয়ে রসিয়ে চা খাচ্ছে। কেউ দাঁড়িয়ে গলগল করে দুধের মাঠা (ঘোল) গিলছে, কেউ শরবত খাচ্ছে। মাঝে মাঝে অনেক দিনের পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ওখানে দেখা হয়ে যেতো। কোনো কোনো সময় শিক্ষকদের সাথেও। আবার এমনও হয়েছে ওখান থেকে কোনো আত্মীয়স্বজন ধরে নিয়ে গেছেন তাঁর বাসায়।

২০০৮এ আমি ঢাকায় মাত্র তিন কি চার রাত ছিলাম। তার মধ্যে একদিন মাত্র হাঁটতে গিয়েছিলাম চন্দ্রিমায়। ন’বছর আগের সাথে তুলনা করে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনও লক্ষ করলাম। দু’টো বিষয় আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। প্রথমত: আমার চোখে ধরা পড়ল, ঢাকার লোকজন সংঘবদ্ধভাবে মর্নিং ওয়াক এবং শরীর চর্চা করতে শুরু করেছে এবং মনে হল শরীর চর্চার সাথে তারা প্রাচীন গ্রিসের অ্যাথেন্স-বাসীর মত আরো কিছু অ্যাজেন্ডা যোগ করেছে। একথায় আবার ফিরে আসব, তার আগে দিয়ে নেই তেজারতির বয়ান। মিরপুর রোড পার হওয়ার পরপরই উদ্যানে যাওয়ার পথে ফুটপাথে দেখলাম বসেছে বিরাট জমজমাট হাট। অফিস আদালতে যাওয়ার আগে সকালে হাঁটতে এসে অনেক মানুষ দরকারি কাঁচাবাজারের কাজটি সেরে ফেলে ওইখানে। মাছ-তরকারি রাস্তা থেকে কিনে নেয়। দেখলাম ভোরের ফুটপাথের বাজার, হরেক রকম তাজা মাছ এবং তরিতরকারিতে ভরা। তাজা মাছ বিশেষ করে বড়বড় জ্যান্ত কৈ দেখে আমার ভীষণ লোভ লাগছিল, সেদিন ওয়ালেট সঙ্গে থাকলে আমি কিছু জিয়লমাছ কিনে নিতে পারতাম। সকালে মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে মানুষ ঘরে গ্রোসারি করে ফিরে, এমন ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয় বলে আমার জানা নেই।

ফিরে আসি এক্সারসাইজের কথায়। যখন আরেকটু সামনের দিকে এগোলাম তখন ক্রিসেন্ট লেকের উল্টো দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়ার মাজারের পাশে দেখলাম একটি বড় কাপড়ের ব্যানার গাছের সাথে টাঙানো। সাদা কাপড়ের ব্যানারে বড় বড় হরফে লেখা, ‘ভোরের শিশির ফিটনেস ক্লাব’। তার সামনে দশ বারোজন মাঝবয়সী লোক মিলিটারি কায়দায় ড্রিল করছে। একজন লেফট-রাইট কমান্ড দিচ্ছে আর আর বাকি সবাই তাকে অনুসরণ করে অত্যন্ত সিরিয়াসলি শরীর চর্চার নানা কসরত করে যাচ্ছে। ফিরে আসার সময় লেকের পারে পাকা দেওয়ালে বসে দেখলাম এক গ্রুপ মিটিং করছে। মনে হল তারা হাঁটা কিংবা এক্সারসাইজ শেষ করে একসাথে বসে অন্য কিছু করছে। দেখলাম একজন বই থেকে কিছু পড়ছে অন্যরা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে। তারপর গ্রুপ লিডার একে একে সবাইকে প্রশ্ন করছে আর তারা উত্তর দিচ্ছে। আমার ইচ্ছে ছিল পাশে দাঁড়িয়ে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু কি তা শোনার, কিন্তু সময়ের টানাটানিতে সেবিষয় শোনা হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে এরা কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংগঠনের লোক।

এই যে কেনাবেচা, শরীর ও মনের চর্চা, সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা, আড্ডা দেওয়া, কথা বলা, সকালকে উপভোগ করা, এ সবকিছু যেন ‘ঢাকার ভেতরের ঢাকার’ই চালচিত্র। কলকাতার শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে কবি শ্রীজাত যে কবিতা লেখেন তা যদি বাংলা সাহিত্যে উঠে আসতে পারে তাহলে প্রতিদিনকার ভোরের চন্দ্রিমা উদ্যানে ব্যস্ত নগরজীবন নিয়েও তো সৃষ্টি হতে পারে উন্নত মানের সাহিত্যকর্ম। আশা করি ঢাকার কবি সাহিত্যিকরা ভোরের চন্দ্রিমা উদ্যানে বেড়াতে যাবেন, এবং আমাদের উপহার দেবেন সুন্দর সুন্দর গল্প-কবিতা।



লেখক: অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ।
Email: wahid2569@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 5-Nov-2016

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot