ব্যর্থতার বয়ান আবু এন. এম. ওয়াহিদ
আজ ‘ফেসবুক’-এ একজন অজানা অচেনা মানুষের একটা স্ট্যাটাস পড়ে ব্যর্থতার ওপর কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো। স্ট্যাটাসটা কি, সেটা একটু পরেই দেখতে পাবেন, এখন বলি, হঠাৎ করে ওই বিষয়ে আমার লিখার খায়েস হলো কেন। প্রথম ও প্রধান কারণ হিসেবে আমি ভাবলাম, লেখাটা খুব সহজ হবে এ জন্য যে, আমার জীবনটা তো ব্যর্থতায় ভরা, তার মাঝে অনেক মজার মজার অঘটনও আছে। মাত্র কয়েকটার ফিরিস্তি গুছিয়ে উঠতে পারলেই তো গল্পটা দাঁড়িয়ে যাবে এবং সহজেই আপনাদের মন ভরানো সম্ভব হবে, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে ভেবে দেখলাম - না, ও-পথে পা বাড়ানো যাবে না। কেন, সে কথা এখনই বলার দরকার নেই, আমার আজকের লেখাটা একবার পড়ে নিলে আপনাদের কাছে এ রহস্যেরও জট আপনা আপনিই খুলে যাবে।
সে না হয় খুললো, কিন্তু জট খোলার আগেও তো কেউ বলে বসতে পারেন, ব্যর্থতার প্রতি আমার এত আগ্রহ কেন, এত চুম্বকার্ষণের কারণটাই বা কি? আমি যদি বলি, ব্যর্থতার প্রতি মায়া-মমতা আমার হবে না তো কার হবে? জীবনে এ পর্যন্ত যতটা পথ হেঁটেছি, তার বাঁকে বাঁকে বারবার ব্যর্থতার সাথেই আমার মধুর মুলাকাত হয়েছে প্রথম। সফলতার ছিটেফোঁটা যদি কিছু পেয়েও থাকি, তবে তা এসেছে বড় বড় ব্যর্থতার ফাঁকে ফাঁকে কখনো ছোট, কখনোবা মাঝারি আকার ধরে! সামনে যেটুকু দূরত্ব পাড়ি দেব, তারও পথে পথে যে কাঁটা আর পাথর বিছানো নেই, তা কি কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে?
ব্যর্থতা আমাকে সারাক্ষণ শীতের চাদরের মত জড়িয়ে রাখে। আদরে আহ্লাদে আমার সাথে লুকোচুরি খেলে। কেন, তার সবগুলো কারণ আমি জানি না, তবে ফলাফল হাড়ে হাড়ে টের পাই! বুঝতে পারি, কোনো কোনোটার সাথে তাৎপর্যপূর্ণ উপলব্ধি, ভেঙ্গে-পড়া মধুর মধুর স্বপ্ন, আর দুঃখভরা এক গুচ্ছ স্মৃতি মিশে আছে! সময় সময় আজও তারা আমাকে যেমন তাড়া করে বেড়ায় তেমনি আবার সুখও দেয়। আমার দীর্ঘ এ জীবনে এমনও হয়েছে, ব্যর্থতার সাথে সাথে হুঁচট খেয়েছি, আঘাত পেয়েছি, ভেঙ্গে পড়েছি, সবর করেছি, আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। পরে দেখেছি, যা চেয়েছিলাম, তার চেয়ে ভালো কিছু পেয়েছি, বেশি কিছু পেয়েছি, তবে জীবনে এমন অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই। আর তাই, যা আছে তাকে আমি সুখের সাথে স্মরণ করি। ছোট মুখে তো আর বড় কথা মানায় না, তাই এখানে একটা ছোট্ট কথা ছোট করেই বলে রাখি, আপনারা ভেবে দেখুন। সচরাচর আমরা যাকে ব্যর্থতা বলে মনে করি, তার গভীরে যে সফলতার বীজ বোনা থাকে, তা কি কখনো মাথায় খেলে? আবার বিশাল সফলতার সাক্ষাৎ পেয়ে যখন আনন্দে উদ্বেলিত ও উচ্ছলিত হই, তখন কি মনে হয়, একে ছায়ার মতন অনুসরণ করে - আর কেউ নয়, ব্যর্থতাই। কথাটা উদাহরণ দিয়ে আরেকটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার ইচ্ছে আছে, তবে আজ নয়, হবে হয়তো বা আরেক দিন।
এখন শুধু ভূমিকাটাই দিলাম। আগেই বলেছি, আমার ব্যর্থতার ফিরিস্তি আজ এখানে টানতে পারব না। আর সমস্যাটা এখানেই, কিছু একটা তো লিখতে হবে, কিন্তু কার ব্যর্থতা দিয়ে শুরু করব? ঠিক আছে, তা হলে না হয় সবারটাই বলি। প্লিজ, আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমার ওপর রাগ করবেন না, তাই বলে আমি আপনাদের সবাইকে ব্যর্থ মনে করি না! আমি নিজে ব্যর্থ, তাই বলে আপনারা ব্যর্থ হতে যাবেন কেন? আর কারো জীবনে যদিও বা একটু আধটু ব্যর্থতা এসে ভর করে, তা হলে কি তার গোটা জীবনটাকে ব্যর্থ বলা যায়? মোটেও না। জীবনের ক্যানভাসটা আরো অনেক বড়, এটাকে এত সহজে কালো রংয়ের তুলি দিয়ে কালিমায় পুরোপুরি লেপটানো যায় না। তাই তো বলি, জীবনটা এত সহজে বরবাদ হয়ে যায় না, বিফলও হয় না। পরাজয় তখনই আপনাকে জয় করে নেয়, যখন আপনি তাকে মেনে নিয়ে হতাশায় দিগ্বিদিক-জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
ব্যর্থতা - সে যত ছোট কিংবা বড়ই হোক না কেন, সব সময় মানুষকে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার পথ দেখায়, নব উদ্যমে আবার শুরু করার প্রেরণা যোগায়। যে পথ দেখে, যে প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়, সে তার ব্যর্থতার পর সফলতার মুখ দেখে খুশিতে খুশিবাসি করে, আর যে চোখ-কান খোলা রাখে না, মনের দরজায় কপাট মেরে রাখে, সে জানেও না, বুঝেও না, কীভাবে কী ঘটছে, সে-ই বোকা, সে-ই ব্যর্থতার বেদনায় দিশেহারা! এ জগতে এমন মানুষের অভাব নেই, খুঁজতে জানলে সহজেই চিনতে পারবেন। এর চেয়ে বেশি বলা মোটেও নিরাপদ নয়, আপনারা বুঝে যাবেন, আসল অলক্ষুণেটা কে!
ভেবে দেখুন, আপনি নিজেকে কখন ব্যর্থ বলবেন? ধরুন, আপনি কোনো কাজে একবার ব্যর্থ হলেন, আবার ব্যর্থ হলেন, বারবার ব্যর্থ হলেন, তারপর কি করবেন? একা একা ঘরের কোণে বসে নীরবে কাঁদবেন? না, কক্ষনও না। মনে রাখুন, আপনি এখনো ব্যর্থ হননি, আপনার মাথার ওপর এখনো আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি, বরং আপনি কাজের মাঝেই আছেন, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন, চেষ্টা ছেড়ে দেবেন না। আপনার সফলতার এখনো আশা আছে, এবং ষোল আনাই, কিন্তু হতাশা যদি আপনাকে একবার পেয়ে বসে, আপনি যদি অধৈর্য হয়ে নিরাশায় হাল ছেড়ে দেন, তাহলে ব্যর্থতার পথে কয়েক কদম কিন্তু এমনিতেই এগিয়ে গেলেন, আর যদি পরাজয় মেনে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে দু’চোখে শুধু সরষে ফুল দেখতে থাকেন, তাহলে মনের অজান্তে নিজের হাতে গাঁথা ব্যর্থতার মালাখানা নিজেই গলায় তুলে নিলেন।
এ অবস্থায় আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব কেউ আপনার কাছে ভিড়বে না, এমন কী দূর থেকে খোঁজখবরও রাখতে চাইবে না, যদি কিছু চেয়ে বসেন - এই ভয়ে! কেঁদেকেটে যদিও বা কাউকে আপনার ভাঙ্গা মন্দিরে আনতে পারেন, সে এসে শুধু করুণা আর উপদেশ খয়রাত করবে। বলবে, ‘তোমার এটা করা উচিৎ ছিল, ওটা করা উচিৎ ছিল’, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সে সময় সে যদি আপনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে তাহলে বুঝে নেবেন, আপনি অনেক ভাগ্যবান! আপনি যদি এমন ভাগ্য চান, তাহলে তো কথা নেই, আর যদি না চান, তাহলে আপনাকে মনটা শক্ত করে শিরদাঁড়া খাড়া করে উঠতে হবে। ভয়-ডর ঝেড়ে ফেলে দিন, মনে সাহস রাখুন, হা-হুতাশের কাছে দিয়েও যাবেন না, ধীর-স্থিরভাবে চিন্তা করুন, আপনি লক্ষ্য বদল করুন, নতুন কৌশল নিন, নব উদ্যমে নতুনভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, নিশ্চয়ই সফল হবেন। একবার না হয়, বারবার চেষ্টা করুন, বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ নিন, বিভিন্নভাবে কোশেশ জারি রাখুন, মকসুদে মঞ্জিলে একদিন পৌঁছবেনই। আর না পৌঁছলেই বা কী! জগতে কত মানুষই তো ব্যর্থতার মাঝে জন্মায় এবং সফলতার মুখ না দেখেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়।
আমেরিকার এক কৃতি-পুরুষের জীবন থেকে উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, আমরা সাধারণ মানুষ যত সহজে ব্যর্থতায় কাবু হয়ে যাই, যত সহজে লক্ষ্য-হারা হয়ে পড়ি, তা হওয়া ঠিক নয়, একেবারেই ঠিক নয়। ওই বড় মানুষটার জীবনে বিশাল বিশাল সফলতা রয়েছে, তারপরও কিন্তু :
. জীবনে মাত্র আঠারো মাসের বেশি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাননি। . কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে কোনো ডিগ্রি দেয়নি। . ন’বছর বয়সে বিষ-মেশানো দুধ খেয়ে তাঁর মা মারা যান। . বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না, মারা গেলে বাবার দাফন-কাফনেও তিনি অংশ নেননি। . ব্যবসা করতে গিয়ে প্রথমবার লালবাতি জ্বালান। . আমেরিকার সিনেট নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দু’-দু’বার পরাজিত হন। . নির্বাচন করতে গিয়ে প্রথমবার প্রেসিডেন্সিয়াল টিকেট পাননি। . ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে একবার ব্যর্থ হন। . জীবনে দু’বার মরতে মরতে বেঁচে যান। . ডিগ্রি ছাড়া আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন, সুপ্রিম কোর্টে মামলা চালাতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে হারেন। . জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। . সরাসরি তাঁর কোনো বংশধর আজ আর বেঁচে নেই। . তিনি খুবই পশু-প্রেমিক ছিলেন, একবার আস্তাবলে আগুন লেগে তাঁর কয়েকটি অতি প্রিয় পশু মারা যায়। . আততায়ীর গুলিতে গুডফ্রাইডেতে তিনি মারা যান। . মারা গিয়েও তিনি শান্তি পাননি - কবর দেওয়ার আগে তাঁর কফিন পাঁচবার খোলা হয়। . তিনি মারা যাওয়ার এক বছর পর তাঁর প্রিয় কুকুরটাও মারা যায় - এক মাতাল ঘাতকের হাতে। . ডাকাতরা একবার তাঁর লাশটা কবর থেকে বের করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
এত দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, ব্যর্থতা ও পরাজয়ের পরও তিনি হতোদ্যম হননি, তিনি পরাজয় মেনে নেননি। তিনি পথ খুঁজেছেন, পথ পেয়েছেন, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বায়ান্ন বছর বয়সে ১৮৬০ সালে তিনি আবার নির্বাচন করেছেন। এবার জিতেছেন। কোন পদে, শুনবেন? খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে। তাঁর নাম কি জানেন? এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা বুঝে গেছেন, তিনি আর কেউ নন, আমেরিকার শ্রেষ্ঠতম প্রেসিডেন্টদের অন্যতম - আব্রাহাম লিংকন।
এবার অবশ্যই বুঝে গেছেন শুরুতে আমার নিজের ব্যর্থতার বয়ান দিতে গিয়েও কেন দেইনি। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ব্যর্থতার সঙ্গে আমার মত তুচ্ছ মানুষের ব্যর্থতার তো তুলনা হয় না, হতে পারে না! তাই এমন ধৃষ্টতাও দেখাতে চাইনি।
(যারা স্ট্যাটাসকে পুঁজি করে লেখাটা শেষ করে আনলাম, তাঁর নামটা ফেসবুকের পাতা থেকে টুকে রাখতে আমার কসুর হয়ে গেল, পরে আবার খোঁজাখুঁজি করে ভদ্রলোকের হদিস পেলাম না। এ জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে না পেরে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আজকের লেখা সম্বন্ধে আরেকটা কথা না বললেই নয়, ভদ্রলোক তাঁর ‘ফেসবুক’ স্ট্যাটাসে আব্রাহাম লিংকনের যত ব্যর্থতার বয়ান দিয়েছেন, লিংকনের দু’একটা জীবনী পড়েও আমি সবগুলো তথ্য যাচাই-বাছাই করতে পারিনি। এমতাবস্থায়, তাঁরগুলো বাদ দিয়ে ইন্টারনেট থেকে আমি এ তথ্যগুলো আপনাদের জন্য সংক্ষেপে তুলে ধরলাম।)
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|