আমি ও আমার ‘ঠিকানা’ আবু এন. এম. ওয়াহিদ
আজ বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখ, ২০১৯। অন্যদিনের মতন সকালবেলা অফিসে এসে ইমেইল খুলেছি মাত্র। একদিকে মনিটরের আলো ঝলমল পর্দায় ছোট ছোট বৈদ্যুতিক বার্তা পড়ছি অন্যদিকে ফোনের পর ফোন ধরছি আর অনবরত কথা বলেই চলেছি। কোনোটা অফিসের কল, কোনোটা পেশাদারী বাইরের কল, কোনোটা বন্ধুবান্ধবের। সাধারণত এই সময় এত ঘন ঘন ডাক আমি পাই না। কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গে উপর্যুপরি টেলিফোন ধরতে ধরতে আমি যখন রীতিমত দিশেহারা ঠিক তখনই একটি জরুরি ফোনালাপের মাঝখানে ঠিকানা অফিস থেকে পেলাম আরেক কল। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এলো মো: শামসুল হক সাহেবের কণ্ঠস্বর। তিনি আসন্ন ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘ঠিকানা’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে একটি লেখা দেওয়ার জন্য সবিনয় অনুরোধ জানালেন। সময়ের স্বল্পতা ও কাজে অতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য দৃঢ় কথা দিতে পারিনি, তবে হক সাহেবের অনুরোধ ফিরিয়েই বা দিই কি করে। ‘ঠিকানা’ যে আমার আপন, ও-যে আমার আরেক ঠিকানা! লিখতে পারব কি না, লিখব কি না, এই টান পোড়েন নিয়েই দু’কলম লিখতে বসা, যদিও আজকাল আমার লেখালেখি কলম ছাড়াই চলে।
‘ঠিকানা’র কথা বলতে গেলে আমাকে ফিরে যেতে হয় অতীতে, পুরনো একটি লেখায়, অনেক দিন আগের একটি গল্পে, অনেক দিন আগের এক আবেগময় বাস্তবতায়! আবেগময় এ জন্য যে, মূলত যাঁদের নিয়ে এই গল্পের অবতারণা তাঁরা কেউই আজ বেঁচে নেই! এই বয়সে আপন স্মৃতি যদি আমার সাথে প্রতারণা না করে, তা হলে আমি শুরু করব ১৯৯২ সালের কাহিনী দিয়ে। আমি তখন ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর চার্লস্টনে থাকি এবং ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির নীতিকথা আওড়াই। ওই বছর গ্রীষ্মের শুরুতে, মে অথবা জুন মাসে, দেশ থেকে বেড়াতে এলেন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। নিজের মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সাথে শাশুড়ির সময়টা ভালোই কেটে যায়, কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আমার শ্বশুরকে নিয়ে। সকালবেলা আমি চলে যাই অফিসে, তিনি বাড়িতে একা থাকেন, ঘরে তাঁর তেমন কিছু করার নেই, বই পড়ে আর কতদূর যাওয়া যায়। অথচ সরাসরি জড়িত না থাকলেও তিনি খুবই রাজনীতি ও সমাজ সচেতন একজন মানুষ! যেখানেই থাকেন না কেন, প্রতিদিন দেশের তাজা খবর তাঁর চাই-ই চাই। মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারি, বাংলাদেশের খবরের জন্য তাঁর মনটা সবসময় যেন ছটফট করছে। ইন্টারনেটে অল্প স্বল্প বাংলাদেশের খবর পাওয়া যায় - জানি, কিন্তু আমার অফিসে কম্পিউটার নেই, বাসায়ও নেই। উনার জন্য কী করি - ভাবছি, এমন সময় স্পেনের বার্সিলোনায় শুরু হলো সামার অলিম্পিক। তিন চ্যানেলের ‘ট্রিপল কাষ্ট’ সাবসক্রাইব করলাম যাতে তাঁর সময়টা একটু ভালো কাটে। কিছুদিন বেশ উপভোগ করলেন, আনন্দে কাটলো নানান জাতের খেলা ও খেলোয়াড়দের কসরত দেখে দেখে। রাতের বেলা তাঁর সঙ্গে আমিও টিভির সামনে বসি। এরই মধ্যে ন্যাশভিলের টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আমার একটা চাকরির অফার এলো। চাকরিটা ছিল অস্থায়ী, কিন্তু এর বেতন, অন্যান্য সুবিধা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আকর্ষণে আমি সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইনি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে, আগস্ট মাসের শেষের দিকে চলে এলাম ন্যাশভিল। আসার সময়, বউ ছেলেমেয়েদের সাথে আমার শ্বশুর-শাশুড়িকেও সঙ্গে করে নিয়ে এলাম কান্ট্রি মিউজিকের শহর ন্যাশভিলে।
এখানে এসে অফিসে পেলাম কম্পিউটার। মাঝে মধ্যে অফিস থেকে ফেরার পথে আমার শ্বশুর সাহেবের জন্য টুকটাক দেশের খবর প্রিন্ট করে নিয়ে আসি। তিনি এগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন, কিন্তু এতে তৃষ্ণা মেটে না মোটেও, বরং প্রাণের উচ্ছ্বাসে দেশী খবরের চাহিদা তাঁর মনে উথলে উঠে আরো তীব্রভাবে, যখন তখন! অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর আমেরিকায় একটি বাংলা পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করলাম। ওই সময় নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘ঠিকানা’রও খবর পেলাম কোনো এক বন্ধুর কাছে। সাথে সাথে পত্রিকা অফিসে ফোন করে এক কপি পেপারের অর্ডার দিলাম এবং একই দিনে একটা চেকও পাঠিয়ে দিলাম ‘ঠিকানা’র ঠিকানায়। এরপর আমি আর আমার শ্বশুর প্রবেশ করলাম ভিন্ন এক জগতে, ‘ঠিকানা’র অনন্দময় নতুন জগতে। কোনো সপ্তায় কাগজখানা সময়মতও দরজায় এসে কড়া নাড়ে, কোনো সপ্তায় চলে আসে আগে, কোনো সপ্তায় দু’এক দিন চলে গেলে দেখা মিলে তার, আবার কোনো সময় সপ্তাহ পার হয়ে যায় ‘ঠিকানা’র হদিস পাওয়া যায় না - অর্থাৎ মিস হয়ে হয়ে যায়। পরের সপ্তাহে এক সাথে পাওয়া যায় দুই সংখ্যা। যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট দিনে আসে না, তাই প্রতিদিনই আমরা মেইল-ম্যানের পথ চেয়ে বসে থাকি, ‘ঠিকানা’র জন্য ইন্তেজার করি। পত্রিকা হাতে পেয়ে, কে আগে পড়ব, এ নিয়ে মাঝে মাঝে জামাই-শ্বশুরের মাঝে রীতিমত টানাটানিরও উপক্রম হয়।
বিশাল আকারের পেপার। এক শ’ পৃষ্ঠারও মতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে পুরো দু’তিন দিন সময় লেগে যায়। পড়ি সব ধরনের দেশী খবর, রাজনৈতিক কলামের বিশ্লেষণ এবং আলোচনা। আরো পড়ি বিয়ানীবাজার এবং সন্দীপ সমিতি সহ, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যলামনাই এসোসিয়েশন ও ছোট বড় সব সমিতির সভা-সমাবেশ, পিকনিক সংবাদ, তাঁদের ভোটাভোটি, হাতাহাতি, মারামারি ও মামলা-মোকদ্দমার খবর। ‘ঠিকানা’য় থাকে ইফতার মাহফিল, দেশী মওলানাদের ওয়াজ, ঢাকা থেকে আগত শিল্পীদের সঙ্গীতানুষ্ঠান ও নাট্যাভিনয়ের সচিত্র চালচিত্র। এই কাগজের পাতায় পাতায় আরো পাওয়া যায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের আমেরিকায় আগমন সংবাদ, তাঁদের মিটিং ও সংবর্ধনার খবর ও ছবি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সেবীদের জন্য গল্প, কবিতা, ছড়া, রম্য আলোচনা, সিনেমার খবর ইত্যাদি, ইত্যাদি। ‘ঠিকানা’র সাদা জমিনে কালো হরফে ছেয়ে যায় পারিবারিক ও বৈষয়িক সংবাদ যেমন - বিয়েশাদী, জমি কেনা-বেচা, উকিল, ডাক্তার, ডেন্টিস্টদের বিজ্ঞাপন, ইত্যাদি, ইত্যাদি! সময় সময় উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত অন্যান্য বাংলাদেশীদের খবরও জানা যায় ‘ঠিকানা’ মারফত - কে কোথায় আছেন, কী করছেন, কী লিখছেন। মাঝে মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সন্ধান মিলে এই ‘ঠিকানার’ই বদান্যতায়। আরো দেখি, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সফলতা, সার্থকতার খবর ও স্কুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের কৃতিত্বের বিবরণ ‘ঠিকানা’য় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। এছাড়া এমনও হয়েছে, পরিচিত জনের মৃত্যু সংবাদও আমি ‘ঠিকানা’ থেকে পেয়েছি। ‘ঠিকানা’র পাতা না উল্টালে ওই খবরটি পেতে আমার কত বছর লাগত, কে জানে। সে যুগে স্যাটেলাইটে বাংলা চ্যানেল বলতে কিছুই ছিল না, তাই দেশের যেটুকু খবর পেতাম, তার পুরোটাই আসত ‘ঠিকানা’র পথ বেয়ে। এভাবে গত শতকের নব্বই দশকের গোড়ার দিকে ‘ঠিকানা’র মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ‘তৃতীয় বাংলা’র (লন্ডন যদি ‘দ্বিতীয় বাংলা’ হয়, তাহলে নিউ ইয়র্ককে নির্দ্বিধায় ‘তৃতীয় বাংলা’ বলতেই পারি) এক অংশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিল্প সংস্কৃতির সাথে একটা সরাসরি নিবিড় যোগসূত্র তৈরি হয়ে গেলো আমাদের।
২০০৭-০৮ সাল থেকে আমি বাংলায় লেখালেখি শুরু করি। তারপর কোনো এক সময় ঠিকানা আমার লেখা ছাপাতে লাগলো। এর পর থেকে ‘ঠিকানা’র সঙ্গে আমার সম্পর্ক পেলো নতুন এক মাত্রা। ‘ঠিকানা’ নিয়মিত আমার লেখা ছাপে এবং ‘ঠিকানা’র সৌজন্যে আমি ফ্রি এক কপি কাগজ পাই। ঠিকানা হতে এলেই প্রথমে ভেতরের পাতা খুঁজি - নিজের লেখা ছাপা হলো কিনা দেখি। প্রথম প্রথম খুঁজে পেতে অসুবিধা হতো, সময় লাগতো, এখন সহজ হয়ে গেছে, কারণ ছবি থাকে। যেদিন নিজের লেখা বের হয়, সেদিন ঠিকানা পড়তে শুরু করতাম ভেতর থেকে, নিজের লেখা দিয়ে। অন্য লেখকদের হয় কি না জানি না, তবে আমার হয়। নিজের লেখা বার বার পড়ি, অসংখ্য বার পড়ি, পড়ি তিন কারণে। প্রথমত, এডিটিং এর জন্য লেখা বেশ কয়েকবার পড়তে হয়। তারপরও ভুলত্রুটি ষোলো আনা দূর করা যায় না। দ্বিতীয়ত, সময় পেলেই নিজের লেখা নিজে পড়ি - ভালো লাগে, নির্মল আনন্দ পাই, তাই বলে। তৃতীয়ত, যে কারণে পড়ি সেটা আরেকটু মজার ব্যাপার, একটু আজবও বটে! যখন কোনো পাঠক, ইমেইল করে, টেলিফোনে অথবা দেখা হলে বলেন, আপনার অমুক লেখাটা পড়েছি, ভালো লেগেছে, তখন আমি আবার পড়ি, যতবার এমন কথা শুনি ততবারই পড়ি। সন্দেহ নেই, আমার এই অভ্যাস একটি আজব মনস্তত্ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ! এই অর্থে আমি একজন ব্যতিক্রমধর্মী আনাড়ি লেখক।
পনেরো ষোলো বছর আগে লেক্জিংটন কেন্টাকির প্রয়াত ডা. একরামুল কবিরের উৎসাহে, ‘ঠিকানা’র মতন একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করার জন্য নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কাজও অগ্রসর হয়েছিল বেশ কিছুদূর। কিন্তু ইন্টারনেটের দ্রুত প্রসারের কথা চিন্তা করে, ও পথে আর পা বাড়াইনি। আমার ধারণা ছিল, এভাবে চলতে থাকলে, একদিন ‘ঠিকানা’-ও হারিয়ে যাবে বিলুপ্তির পথে, কিন্তু না! ‘ঠিকানা’র নিবেদিতপ্রাণ মালিক, সাংবাদিক, কর্মচারী এবং কলা কুশলীরা, শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে, তাঁদের আত্মবিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি এবং কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে আমার সে ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন। এখানে নিঃসন্দেহে পত্রিকাটির পাঠকদেরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘ঠিকানা’ আজও টিকে আছে। আজও পৌঁছে দিচ্ছে বাংলাদেশিদের ঘরে ঘরে বাংলাদেশের তাজা খবর। আজকে আমি ষোল আনা নিশ্চিত, ‘ঠিকানা’ টিকে থাকবে। টিকে থাকবে ততদিন, যতদিন উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা ভুলবে না মাতৃভাষাকে, ভুলবে না মাতৃভূমিকে। ‘ঠিকানা’ আমাদের মধ্যে আরো বেশি করে জাগিয়ে তুলুক সততা, সত্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম - (আমেরিকার জন্য এবং বাংলাদেশের জন্য) সফল হোক, সার্থক হোক ‘ঠিকানা’র পথ চলা। হাজারো বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অব্যাহত থাকুক ‘ঠিকানা’র এই অগ্রযাত্রা। সত্য ও ন্যায়ের সোজা পথ ধরে চূড়ান্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যাক আমার প্রিয়, সবার প্রিয় ‘ঠিকানা’। সবচেয়ে খুশি হব ‘ঠিকানা’র সঠিক পথে পথ চলায়। সবচেয়ে ব্যথা পাব, যদি দেখি ‘ঠিকানা’ পথ হারিয়ে পৌঁছে গেছে ভুল ঠিকানায়। ‘ঠিকানা’র শুভ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে, ‘ঠিকানা’ পরিবার, তার লেখক এবং অগণিত পাঠকদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা!
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|