bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













আমার প্রথম চাকরিজীবনের বৈচিত্র্যময় অস্থিরতা - ৭
আবু এন. এম. ওয়াহিদ



এরপর আমাদের পাঠানো হলো মানিকগঞ্জে ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন ফেডারেশন’-এর (এসসিএফ) ‘জাবরা’ তবলা প্রকল্প দেখবার জন্য। শ্যামলিমায় ঘেরা ওই গ্রামটি জেলা সদর থেকে কয়েক কি.মি. উত্তর-পশ্চিম দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ডান দিকে একটু ভেতরে । মূল রাস্তা থেকে গ্রামে ঢোকার পর গাড়িতে করে আমাদের গন্তব্যে যেতে যেতে জায়গাটিকে নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। চতুর্দিক বনবাদাড়, ঝোপঝাড় ও ছোটবড় অসংখ্য গাছপালায় ভরা। সর্বত্র সবুজে সবুজময়। ছবির মতন সুন্দর গ্রামখানি দেখে মনে পড়ে গেল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মিষ্টি-মধুর গানের একটি চরণ, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী....’ আর মনে হলো, ‘জাবরা’ যেন এক নববধূ – সদ্য লাল শাড়ি ছেড়ে সবুজ সাজে সেজেছে, ঘোমটা মাথায় - লাজুক লাজুক মুখখানি - একটু লুকোয় একটু দেখায়! হয়তো এরকমই কোনো এক ‘মুখ’ দেখে একদা কবি জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর....’।

সাজানো গোছানো এমন গ্রামে যেখানে সেখানে রস-কাটা খেজুর গাছ এলোমেলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ পরিকল্পনা করে সারি বেঁধে লাগায়নি, কিন্তু তাই বলে দেখতে একটুও খারাপ লাগছে না, একটুও বেমানান ঠেকছে না। বুঝলাম, প্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলারও একটি শৃঙ্খলা আছে, তারও একটি অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য আছে যেটা স্বাভাবিকভাবে নান্দনিকতার সাথে আপন সাজে সময়ের সাথে ধীর লয়ে সেজে ওঠে। লতাপাতা বৃক্ষরাজি যেন ‘জাবরা’র অবালবৃদ্ধবনিতা ও পশুপাখির সঙ্গে আত্মীয়ের মতন মিলেমিশে অনাবিল আনন্দে ও প্রশান্তিতে বসবাস করছে! আরো মনে হলো, স্বল্পদিনের অতিথি হিসেবে গোটা গ্রাম যেন আমাদেরকে বিনম্র অভিনন্দন জানাচ্ছে, আন্তরিকতার সাথে দু’হাত মেলে আলিঙ্গন করছে, প্রাণ খুলে বলছে, ‘স্বাগতম, হে আমাদের অতিথি, স্বাগতম!’

ধোঁয়ার মতন সাদা সাদা ধুলো উড়িয়ে কাঁচা সরু পথ ধরে চলতে চলতে আমাদের গাড়ি এসে থামলো একটি চারচালা টিনের ঘরের সামনে। রাস্তার পর এক চিলতে ছোট্ট সবুজ মাঠ তারপর অতি সাধারণ ছোট্ট একটি ঘর। বুঝলাম, এটাই হতে যাচ্ছে নব গ্রামে আমাদের নব আস্তানা। শহর থেকে দূরে এখানে এই অজপাড়া-গাঁয়ে এসে ‘ভিইআরসি’র ডেরা বাঁধার পটভূমিটি এরূপ: উনিশ শ’ সত্তর দশকের মাঝামাঝি ‘এসসিএফ’ ‘জাবরা’র একদল ভূমিহীন কৃষককে সংগঠিত করে, তারপর ‘এসসিএফ’-এরই সহযোগিতায় গ্রামবাসী ঋণ নিয়ে সমবায়ের ভিত্তিতে তবলা বানানো শিখতে লাগেন। কারা তাঁদের তবলার কাজ শেখালেন? ওই কারিগররা কি স্থানীয়, নাকি তাঁদেরকে বাইরে থেকে আনা হয়েছিল, এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। তবে এটুকু জানি, উৎপাদিত তবলাগুলো বাজারজাত করতে কৃষকদের সাহায্য করেছিল ওই সাহায্যকারী বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি। সে-বার ‘জাবরা’তে আমরা যে ক’দিন ছিলাম, অনেক কিছু করেছি, অনেক জায়গায় গিয়েছি, অনেক কিছু দেখেছি, আবার অনেক কিছু ভুলেও গেছি। যা করেছি, তার চেয়ে আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হলো যা করতে পারিনি এবং করিনি। গ্রামে আমরা তবলা দেখিনি, তবলার কারিগরদের দেখিনি, কাউকে তবলা বানাতেও দেখিনি। তবলার আড়তে যাইনি, হারমোনিয়াম-তবলার আসর বসিয়ে কেউ আমাদের গানও শোনায়নি। আশ্চর্য, কারো কাছে আমরা তবলার কথা কিছুই জানতে চাইলাম না, তবলা তৈরির কারখানায়ও যেতে চাইলাম না। এর মানে কী হতে পারে! সম্ভবত তখন ‘জাবরা’ গ্রামের তবলা প্রকল্প বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। আর তাই যদি হবে, তাহলে এতো ঘটা করে সেদিন আমাদের সেখানে পাঠানোই বা হলো কেন। এসব সওয়াল আজ কার কাছে রাখব, কে এতসব জবাব দেবে? জবাবতো আমারই দেওয়ার কথা, অথচ আমি মা’সুম বাচ্চার মতন কিছুই জানি না, নাকি জানতাম, আজ সব ভুলে বসে আছি, তাইবা কী করে হয়!

‘জাবরা’তে আমি যা দেখেছি ও শিখেছি, তা সম্ভব হয়েছে মূলত, দু’জন মানুষের জন্য। তার প্রথম জনের সঙ্গে প্রথম দিনেই পরিচয় হলো। তিনি লুঙ্গীপরা, গামছা হাতে উদাম-দেহী মধ্যবয়সী এক কর্মচারী। তাঁকে শুরু থেকেই চাচা বলে ডাকতাম, নাম জানতে চাইনি। পরে জেনে থাকলেও তা এখন মনে নেই। তিনি ওই বাংলো-ঘরের বরকন্দাজ-কাম-বাবুর্চি। পেছনে একটি রান্নঘরও ছিল। নিকটে ‘কালিগঙ্গা’ নদীর পাড়ের ‘জাবরা’ বাজার থেকে চাচা আমাদের জন্য তাজা তরিতরকারি, মাছ-মুরগী কিনে আনতেন। রোজ রোজ রান্না করে গরম গরম পরিবেশন করতেন। আমরা চৌকির ওপর শীতল পাটি বিছিয়ে গোল হয়ে বসে মজা করে খেতাম। আবার খাওয়া শেষ হলে ওই চৌকিতেই বিশ্রাম নিতাম এবং মশারি টাঙ্গালে এটাই হয়ে যেতো আমাদের রাত্রিকালীন আরামের বিছানা। রাতের পর রাত ওই শক্ত সমতল চৌকির ওপর লাইন ধরে সবাই ঘুমিয়েছি, সুখ-দুঃখের কত স্বপ্ন দেখেছি! - কতেক মনে আছে, কতেক ভুলেও গেছি। যেসব স্বপ্ন আবছা আবছা মনে পড়ে, তা আজ অবধি স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল, কোনো দিন বাস্তবে ফলবে বলে মনে হয় না! ‘জীবনভর অবাস্তব স্বপ্ন বয়ে বেড়ানো’ - এ-ওতো এক কাজ, এ-ওতো এক অভিনব অভিজ্ঞতা! এ সুযোগই-বা ক’জনের হয়! ‘জাবরা’য় রোজ রোজ রান্না-খাওয়া বাস্তব হলেও আমি স্বপ্নের মতনই দেখতাম! প্রতিদিনই আমার কাছে ‘পিকনিক’ ‘পিকনিক’ লাগতো! এতবছর পর ওই নদী ও নদী-পাড়ের বাজারের নাম বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। অনুজ-প্রতিম বন্ধু সরকার জাবেদ ইকবাল আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। একই ধরনের কাজের সুবাদে সেও প্রথমে ‘জাবরা’ এবং পরে মহাসড়কের উল্টোদিকে ‘বানিয়াজুরী’তে দীর্ঘদিন ছিল। সময় সময় তার কাছ থেকে আমি বিভিন্ন কিসিমের তথ্য ও লেখালেখিসংক্রান্ত অন্যান্য সহযোগিতা নিয়ে থাকি। এই সুযোগে জাবেদের প্রতি জানাই অকৃত্রিম প্রীতি ও কৃতজ্ঞতা!

কাজের ফাঁকে ফাঁকে চাচার হাতে অফুরন্ত সময়, কিন্তু তাঁর সাথে কথা বলার কেউ নেই। আমাদের কাজ তেমন না থাকলেও সখের ‘অকাজ’গুলো অবসরের অবসাদকে ঘুচিয়ে দিত, যেটুকু ফুরসৎ পেতে পারতাম তাও ছিনিয়ে নিত। ক্যামেরাম্যানসহ হাতে খাতা-কলম নিয়ে প্রতিদিনই বেরতাম। কাজ ছিল গ্রামের উদাসী হাওয়ায় ভবঘুরের মতন লক্ষ্য-হীনভাবে ঘোরাঘুরি করা, পরিবেশ ও প্রকৃতির ছবি তোলা আর একটু আধটু নোট নেওয়া। ভাগ্যিস, আমার হাতে ক্যামেরা ছিল না, আমি ক্যামেরাম্যান হলে রীতিমত সমস্যাই হতো, কারণ আমার কাছে তো গোটা গ্রামটাই ছবির মতন, কোনটায় শট নেব আর কোনটা ছেড়ে যাব তা বলে দেওয়ার জন্য একজন কনসালটেন্ট সাথে থাকতে হতো! সেই সময়কার নোট নেওয়া ডাইরির দু’একটি পাতা যদি আজ খুঁজে পেতাম তাহলে আরো অনেক মজার মজার গল্প-কথা রসিয়ে রসিয়ে বলতে পারতাম! যে ক’দিন ‘জাবরা’তে ছিলাম, বৃষ্টি-বাদলার কোনো উপদ্রব আমাদের পোহাতে হয়নি। হলে ভালোই হতো, গরম খিচুড়ি খেতে খেতে চাচার সঙ্গে নিরিবিলি বসে গল্প করা যেতো! বলতেই হয়, আবহাওয়া সেই সুযোগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে। তারপরও চাচার সাথে আমার কয়েক দফা বৈঠকী আলাপ হয়েছে, যেদিন বাইরে যাইনি অথবা আগে ফিরে এসেছি সেদিন। প্রথম প্রথম গল্প এগোতে চাইতো না। কারণ তাঁর মাঝে বেশ একটু আড়ষ্টতা ছিল, পরে অবশ্য তিনি সেই জড়তা কাটিয়ে উঠেছিলেন। আফসোস, ততদিনে যে আমাদের ফিরে আসারই সময়ই হয়ে এলো!

তারমাঝেও চাচা তাঁর পরিবার, ছেলেমেয়ে ও গ্রামের কথা, গ্রামের মাতবরদের নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন। কথাগুলো তিনি এমনভাবে পেড়েছেন, মনে হয়েছে যেন কেচ্ছা শোনাচ্ছেন, আরো মনে হয়েছে, ওইসব কেচ্ছাকাহিনি তিনি ছাড়া যেন গ্রামের আর কেউ জানে না। তাঁর কাঁচা ভাষার গোছালো-অগোছালো গল্প শুনতে আমার গভীর আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে চাচার বুক যে ক্ষণে ক্ষণে গর্বে ফুলে উঠছিলো তা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। একজন অবহেলিত হত-দরিদ্র গ্রামীণ কৃষকের মূল্য হয়তো কারো কাছে কিছুই নেই, কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর সামনে আমি সেই মন ও মনন নিয়েই বসেছিলাম, যেভাবে কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামনে নতশিরে বসে জ্ঞান আহরণ করতাম। দুঃখের বিষয়, আজ চাচার কোনো কথাই আমার স্মৃতিভাণ্ডারে জমা নেই। সব ভুলে গেছি। চাচা প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে এই মুহূর্তে একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি আমাদের দুপুরে এবং রাতে ভাত খেতে দিতেন, কিন্তু সকালে নাস্তায় কী খাওয়াতেন, চিঁড়া-মুড়ি-কলা, নাকি আঁটারুটি-ভাজি, এসবের কিচ্ছু মনে নেই। নাস্তার সঙ্গে চায়ের অনুষঙ্গ ছিল কিনা, তাইবা কে বলে দেবে আজ? দ্বিতীয় যে ব্যক্তিটি ছাড়া আমাদের গোটা সফরই মাটি হয়ে যেত - তিনি ইয়াকুব ভাই, তাঁর কথায় আসব পরে। এ নামটিও আমি ভুলে গিয়েছিলাম, জাবেদ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

‘জাবরাতে’ যা দেখিনি কিংবা যা দেখে ও শোনে ভুলে গিয়েছি তা নিয়ে এখন আফসোস করে কী লাভ, বরং যা দেখেছি, যা জেনেছি তার স্মৃতি আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে দেখা যাক কোনো আনন্দের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা, কোনো তৃপ্তি মিলে কিনা। গ্রামটিতে যতদিন ছিলাম, অজানা অচেনা মানুষ, মাঠের কৃষক, গরুর রাখাল, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার, স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি, খেলেছি, ভোরবেলা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছি। তাঁদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আতিথেয়তার ছোঁয়ায় বার বার মুগ্ধ হয়েছি! অতি অল্পদিনে গ্রামের মাটি-পানি-হাওয়ার সাথে আমাদের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্বন্ধ গড়ে উঠেছিল। মাঠেঘাটে গ্রামের আনাচে কানাচে ঘুরেছি। ধানক্ষেতের আইল ও ধুলোময় গরু-চলা কাঁচা রাস্তা ধরে এঁকে বেঁকে বাঁশবন ও মুত্রাবনের পাশ দিয়ে কত হেঁটেছি, তার হিসেব কে রাখে! সবুজ শ্যামল গ্রামে প্রকৃতির কোলে গড়াগড়ি করা যে কী মজার, তা সেসময় যতটা অনুভব ও উপভোগ করেছি, আজ তার স্মৃতিচারণ করে তার চেয়েও অনেক বেশি আনন্দ পাই, অনেক বেশি তৃপ্তি পাই! তখন কে জানত, ওই খরাঝরা, ঘামেভেজা দিনগুলোর মধুময় স্মৃতি কোনো দিন ভুলব না। কে জানত, সেই সব রোদে পোড়া ধূলিধূসরিত স্মৃতিময় স্বপ্ন সোনালী রূপালী রঙ ধরে বার বার চোখের সামনে ভাসবে আর দেহমনে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দেবে! (চলবে)




লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com








Share on Facebook               Home Page             Published on: 10-Sep-2019

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far