আমার প্রথম চাকরিজীবনের বৈচিত্র্যময় অস্থিরতা - ৪ আবু এন. এম. ওয়াহিদ
| | আনুমানিক ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মেজোমামা ফোন করে বললেন, আমি যেন সেভ দি চিলড্রেন ফেডারেশন-এর (এসসিএফ) ডিরেক্টর - ড. ম্যাকভিকার-এর পিএ সেলিম চৌধুরীর সাথে শিগগির গিয়ে দেখা করি, একটি ভালো চাকরির সম্ভাবনা আছে। মামার কথামতো একদিন অফিস কামাই করে গেলাম এসসিএফ-এ। সেলিম চৌধুরী সময় নষ্ট না করে আমাকে একটি চিরকুট দিয়ে পাঠালেন মাত্র কয়েক ব্লক দূরে ধানমণ্ডিতেই তাঁদের সাবসিডিয়ারি ভিলেজ এডুকেশন রিসোর্স সেন্টার (ভিইআরসি)এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর শেখ হালিমের কাছে। শেখ সাহেব আমার সাথে ৪/৫ মিনিট কথা বলার পর গবেষণা বিভাগের প্রধান রথীরঞ্জন রায়ের কাছে সোপর্দ করে দিলেন। ইন্টারভিউ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় সবশেষে কথা হলো অফিসের বড়কর্তা প্রজেক্ট ম্যানেজার তরুণ মার্কিন নাগরিক - মি. জ্যাক ফল-এর সঙ্গে।
এখানে এসে ধরা খেয়ে গেলাম, চাকরির আশাও ছেড়ে দিলাম! accent-এর জন্য ফল সাহেবের প্রশ্ন আমি বুঝি না এবং কথ্য ইংরেজিতে অভ্যস্ত না থাকায় আমার উত্তরও তাঁকে বোঝাতে পারি না। তিনি সওয়াল করেন তাঁর মতো করে, আমি জওয়াব দেই আমার মতো। আমি নার্ভাস, আমার চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তিনিও নার্ভাস, প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। সম্ভবত, এই ভেবে তিনি বিভ্রান্ত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়ও হয়েছেন যে, সিভি-তে ছেলেটির রেজাল্ট এতো ভালো, অথচ ইন্টারভিউতে কেবল আবলতাবল বকছে! আর কথা না বাড়িয়ে অল্পক্ষণ রেখেই তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন। সেদিন জ্যাক ফল সাহেব আমার উপর বিরক্ত হয়েছিলেন কি না জানি না, তবে পরে বুঝলাম, তিনি আমাকে দি বেনিফিট অফ দি ডাউট দিয়েছিলেন; আর আমার জন্য স্বস্তির জায়গাটা ছিল, কষ্ট করে সেদিন কোনো রকমে আমি তাঁকে ম্যানেজ করতে পেরেছিলাম। এখানে ভাষা এবং দুর্বোধ্য উচ্চারণকে ম্যানেজ করা নিয়ে দুএকটি কথা না বললেই নয়।
১৯৭৮ সালে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই আমি ফল সাহেবকে সফলভাবে ম্যানেজ করেছিলাম ঠিকই, অথচ ৪০ বছর ধরে উত্তর আমেরিকায় ইংরেজি ভাষায় পড়ানোর পরও আমার ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে আমার accent শতভাগ ম্যানেজ করতে পারে না, অর্থাৎ বুঝতে পারে না। তবে এই দুই ঘটনার মধ্যে একটা মিলও আছে। সেই সময় মি. ফল-এর উচ্চারণ বুঝতে না পেরে আমি যেভাবে হতাশ, ভীতসন্ত্রস্ত ও বিব্রত হয়েছিলাম, আজো সেভাবেই লজ্জিত ও বিচলিত হই যখন দেখি, ক্লাস পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীরা আমার accent অনুসরণ করতে পারছে না। এ দেশে accent ছাড়াও আমাদের মতন ফার্স্ট জেনারেশন আমেরিকানদের আরো চ্যালেঞ্জ আছে। ব্রিটিশ ইংরেজি ও আমেরিকান ইংরেজির মধ্যে উচ্চারণ বাদে শব্দ ব্যবহারে তারতম্যও একটি বড় সমস্যা। একদিন ক্লাস পড়াতে গিয়ে কোনো কারণে আমি উচ্চারণ করেছি, godown, ব্যাস, আর যায় কোথায়, যেই বলা সেই কাজ, একযোগে ছেলেমেয়েরা হো হো করে হেসে উঠলো। আমি ভীষণভাবে বিব্রত হলাম এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যখন বোঝালাম godown মানে কী, তখন তারা সমস্বরে বললো অহ, বুঝছি, বুঝছি, warehouse. ইংরেজি ডিকশোনারিতে থাকলেও, godown শব্দটি তাদের ভক্যাবোলারিতেই নেই। ব্রিটিশরা যাকে godown বলে, আমেরিকানরা তাকে বলে warehouse. এরকম আরো অনেক শব্দ আছে যা সময় সময় আমাদের জন্য দারুণ বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়।
ফিরে আসি ভিইআরসি-র কথায়, সবার সাথে দেখাসাক্ষাতের পর, ঘন্টাখানেক অফিসে বসলাম, চলে আসার আগে প্রতিষ্ঠানটির পার্সোন্যাল ম্যানেজার - জনাব জাফর আহমদ আমাকে একটি নিয়োগপত্র দিলেন। আমি এবার ট্রেইনার হিসেবে ১২ শ টাকা মাইনেতে নতুন চাকরি পেলাম। পরে দেখলাম, টিএ-ডিএ যোগ করলে সহজেই মাসে আরো ৪/৫ শ টাকা কামাই করা যায়। আরো বুঝলাম, চাকরি পাওয়া না পাওয়া মূলত নির্ভর করে Who you know, not what you know. এখন যা দেখছি, এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশের বেলাও কমবেশি প্রযোজ্য। পরদিন থেকেই নতুন কাজে যোগ দিলাম। চাকরি বদলের সঙ্গে সঙ্গে আমার বাসস্থানেরও উন্নতি হয়ে গেলো। বাসাবো থেকে এক লাফে উঠে চলে এলাম অভিজাত আবাসিক এলাকা - ধানমণ্ডিতে - মেজোমামার বাসায়, কারণ ভিইআরসি-র অফিস ছিল এই এলাকায়ই। আমার নতুন কাজের জায়গায় নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে জ্যাক ফল বাদে আরও দুজন বিদেশি দেখলাম। গবেষণা টিমে অস্ট্রেলিয়ান লি রিডাউট এবং আর্টিস্ট গ্রুপে ফিলিপিনের রেনে তেয়াগ। তাঁদের সাথে জানাশোনা হতে আরেকটু সময় লেগেছিল বটে। ইতিমধ্যে বেশ কদিন কেটে গেছে, সেই যে ব্র্যাক অফিসে কামাই দিলাম, সেখানে যাওয়ার আর ফুরসতই পেলাম না, সঙ্কোচ করে অফিসে ফোন করে কাউকে জানালামও না, আমি কী করছি বা আমার কী হয়েছে।
অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যেন আমি কাজ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এ পর্যায়ে এসে আমার হুঁশ হলো, আর দেরি না করে ব্র্যাক অফিসে ফোন করে বলে দিলাম, আমি আর মগবাজারস্থ ৩ নম্বর নিউ সার্কুলার রোডে ফিরিব না! কথাটি কাকে বলেছিলাম, সে নামটি আজ স্মৃতি থেকে একেবারেই হারিয়ে গেছে। ওই সময় মগবাজারে ফিরিনি ঠিকই, তবে ২০ বছর পর একদিন মহাখালিতে ব্র্যাক সেন্টারে গিয়েছিলাম। অফিসের হাল-হকিকৎ, শানশওকত দেখে আর পুরনো এক সহকর্মীর সাথে কথা বলে মনে হলো, বিদেশ না গিয়ে ব্র্যাকের চাকরিটিকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিলেও খুব একটা লোকসান হতো না, বৈষয়িক দিক থেকে হয়তোবা এগিয়েই থাকতাম, তবে কোনটা এগোনো আর কোনটা পিছানো তা নিয়ে দীর্ঘ অ্যাকাডেমিক বিতর্ক হতেই পারে, এ জন্য আফসোসও করি না। কপালে যা ছিল, তাই হয়েছে এবং এতে আমি একেবারেই নাখোশ নই! ব্র্যাক, ভিইআরসি এসব এনজিও অফিসে বেতন-ভাতা সব নগদ দেওয়া হতো। ব্র্যাক থেকে আমার ভাঙ্গা ফেব্রুয়ারি মাসের বেতনটা কিভাবে কার কাছ থেকে কত টাকা তুলেছিলাম, এসব কথাও আজ বেমালুম ভুলে বসে আছি!
আমার যোগ দেওয়ার ১০/১২ দিনের মাথায় ভিইআরসি অফিস ধানমণ্ডি থেকে সাভার চলে এলো। মনে আছে, যেদিন ঢাকা থেকে সব গুটিয়ে এলাম, সেদিন ট্রাকে মাল উঠানো-নামানোর যাবতীয় কাজ আমরাই করেছি। দিন তারিখ মনে নেই, পথে কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনিনি, শিমুল ও পলাশের শাখা প্রশাখায় ফাগুনের আগুন চোখে পড়েনি, তবু গাছে গাছে কচি পাতা দেখে ও ধুলিওড়া বাতাসের ঘ্রাণ শুঁকে মনে হলো, বসন্ত বুঝি এসে গেছে! বসন্তের হাওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে খোলা ট্রাকে চড়ে অফিসের আসবাবপত্রসহ গন্তব্যে পৌঁছে দেখি, মাথার চুল ও কাপড়চোপড়ে পাতলা সাদা আস্তরণ পড়ে গেছে। আমাদের নতুন অফিস ঘরটি ছিল ঢাকা-আরিচা হাইওয়ে থেকে কমবেশি আধমাইল পশ্চিমে সাভার বাজার ও থানা সড়কের প্রায় মাঝামাঝি কাঁঠালগাছ ঘেরা ছোট্ট এক টুকরো ধানকাটা মাঠে। গিয়ে দেখলাম, বাড়ির নির্মাণকাজের ফিনিশিং চলছে। বাড়িওয়ালি এক ভদ্রমহিলা কাজের তদারকি করছেন। অফিস বদলের সাথে সাথে আবার আমার ঠিকানা বদল হলো। এবারের আশ্রয়দাতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের দক্ষিণ দালানের দক্ষিণ উইং-এর আমার এক বছর জুনিয়র নারায়ণগঞ্জের এআরএম মাহমুদুল হাসান। সে সিঙ্গল রুমে থাকত, প্রথম দিন থেকেই নির্দ্বিধায় আমাকে তার বিছানাটি ছেড়ে দিয়ে অন্য কারো রুমে গিয়ে ডাবলিং করতে লাগলো। তখনকার সংস্কৃতি এমনই ছিল, ৪০ বছর পরে আজ কেমন, আমি আর কী বলব, আমার চেয়ে আপনারাই ভালো জানেন - যারা দেশে থাকেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি মাহমুদের অসুবিধা না করে সাভারে কেন একটি ফ্ল্যাট কিংবা রুম ভাড়া করে থাকলাম না। প্রশ্নটা যতটা না যৌক্তিক, উত্তরটা তার চেয়ে কঠিন ও জটিল। প্রথমত, চাকরি আমার নিতান্তই অস্থায়ী - মাস আনা মাস খাওয়ার মতন অবস্থা। আমি একা মানুষ, বিয়েশাদী করিনি; আমার আসবাবপত্র, বাসনকোসন তো নেই-ই এমন কি কাপড়চোপড়ও হাতে গোনা। বাড়ি ভাড়া করে কী করব, করলে তো এগুলো কিনতে হবে, আর কেনাকাটার টাকাইবা কই, যা জমে তার পুরাটাইতো বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। এবার দ্বিতীয় যে বিষয়টির দিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি ফেরাতে চাই তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরেকটু গভীরে প্রথিত। বাসা ভাড়া না করায় বাড়তি যে ৪/৫ শ টাকা আমার সঞ্চয় হয়েছে তা ভোগ করেছে আমার পরিবার, বিনিময়ে কষ্ট করল মাহমুদ। তখন বিষয়টি আমি এভাবে দেখিনি, সেই বিবেচনা ও অন্তর্দৃষ্টি আমার ছিলই না। মাহমুদ যে শুধু আমারই উপকার করেছে তা নয়, আমার মা-বাবা-ভাইবোনের প্রতি সেও যে একটা মূল্যবান পরোক্ষ অবদান রেখেছে, এ কথা তখন তার মাথায় খেলেছিল কি না জানি না, তবে আমি অনুধাবন করতে পারিনি। দেশ ছাড়ার পর থেকে আমার ওই প্রিয় ছোটভাইটির সাথে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। আজ মাহমুদের ঋণ শোধ করিই-বা কি করে! মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে কারো জানাশোনা থাকলে অবশ্যই আমাকে তার সন্ধান দেবেন। আর কিছু না হলেও তার সেই সময়ের বদান্যতার কথা স্মরণ করে একটি ধন্যবাদ তো দিতে পারব, একটু কৃতজ্ঞতা তো জানাতে পারব।
যে কয়দিন ভিইআরসি-তে চাকরি করেছি, ততদিন আমি সেখানেই ছিলাম। হলে থাকতাম, সকালের নাস্তা ও রাতের খাওয়া হলেই চলতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে যাতায়াত করতাম। তখন আমি আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র নই, শিক্ষক নই, কর্মচারী নই, কিছুই নই, তবু কেউ কোনো দিন মুখ ফুটে আমাকে কিছু বলেনি। কে কী বলবে, এ যেন আমার জন্মগত অধিকার, কারণ আমি যে জাবিয়ান, জাহাঙ্গীরনগরের সন্তান, জাহাঙ্গীরনগরের উৎপাদিত পণ্য! প্রতিদিন সকালবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা চলাচল পরিবহণ-এর বাসে সাভার বাজার স্টপে নেমে ধানক্ষেতের আইল ধরে হেঁটে হেঁটে ধুলোবালি মেখে গিয়ে উঠতাম অফিসঘরে। যেদিন কোনো কারণে হলের ক্যাফেটেরিয়ায় নাস্তা খেতাম না বা খেতে পারতাম না, সেদিন বাস স্টপে নেমে পথের ধারের একচালা টিনের ঘরে আলুর দম দিয়ে মাটির চুলায় তৈরি ফুলে ওঠা গরম গরম তন্দুরি রুটি খেতাম। মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফেরার পথে রাস্তার মোড়ে চায়ের স্টলে মজা করে আরেকটা জিনিস খেতাম। দোকানে চায়ের কেটলির পাশে অন্য চুলায় সকাল থেকে রাত অবধি অনবরত চায়ের দুধ জ্বাল হতো, চা-ওয়ালা ছেলেটি যত্ন করে ফুটন্ত দুধের উপরিভাগে পরতে পরতে জমে ওঠা দুধের সর তুলে রাখত, আমি এক কাপ দুধের সরের সাথে আচ্ছাসে চিনি মাখিয়ে খেতাম। আহা! কী যে মজা! সাভার ছাড়ার পর এভাবে আসুদা হয়ে চিনি দিয়ে দুধের সর আর কোনো দি...ন খাওয়া হয়নি!
হাই স্কুলের টিচার্স কমনরুমের আদলে অফিসঘরের দক্ষিণদিকে বড় একটি কামরায় কনফারেন্স টেবিলের চারদিকে আমরা কর্মকর্তারা সবাই বসতাম। এমন পরিবেশে কাজের চেয়ে আড্ডাই হতো বেশি। কতক্ষণ পর পর চা আসতো, তবে আফসোস, ব্র্যাক-এর মতন শিঙ্গাড়া-বিস্কুটের কোনো বালাই ছিল না! চায়ের সঙ্গে টা না থাকলেও ভিইআরসি-তে দুপুরের খাবারটা ছিল ভীষণ মজাদার! অফিসের বাবুর্চি জেবিয়ার ডিকস্টা (সংক্ষেপে জেবি দা) সকালবেলা সাভার বাজার থেকে তাজা মাছ-তরকারি কিনে আনতেন। কুটনো কোটা, ধোয়া, রান্নাবান্না চলতো টানা বারোটা পর্যন্ত। আমি ফাঁকে ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে দেখতাম, কোনদিন কী মেন্যু পাক হচ্ছে, কারণ রান্নার প্রতি আমার আকর্ষণ একেবারে ছোটবেলা থেকেই। পাকঘরের খিদেজাগানো খুশবুর ঢেউ দুই কামরা মাড়িয়ে আমাদের কনফারেন্স রুমেও এসে লাগতো - বিশেষ করে যেদিন খাসীর গোস্ত ভুনা হতো এবং যেদিন জেবি দা গরম তেলে শুকনো মরিচ আর রসুন ছেঁচা দিয়ে ডাল বাগাড় দিতেন। একই দিন মেন্যুতে খাসী ও ডাল, দুটো থাকলেতো কথাই নেই, তীব্র ওই দুই ঘ্রাণে এক পূর্ণ ভোজন - যেন খাওয়ার আগেই পেট ভরে যাওয়া! বিদেশিদের মধ্যে রেনে এবং লি আমাদের সঙ্গেই হাত দিয়ে ডাল-ভাত মেখে খেতেন, কিন্তু প্রজেক্ট ম্যানেজার জ্যাক ফল সবার সাথে বাঙালি কায়দায় বসে খেতেন কি না সে কথা আজ আর মনে করতে পারছি না।
অফিস ঘরে এয়ার কন্ডিশনিং ছিল না, সিলিং ফ্যানও অপর্যাপ্ত। এমতাবস্থায় প্রায়শই গরমে হাঁফিয়ে উঠতাম। এই অজুহাতে ফুরসত পেলেই কাঁঠালতলায় গিয়ে প্রাণ ভরে হাওয়া খেতাম (আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না, তাই মুক্ত বাতাস খেলা করতো বিনা বাধায়) আর গাছের ডালে ডালে শালিক পাখির লাফালাফি দেখতাম। স্কুল-ফেরত ছেলেমেয়েদের চঞ্চলতা ও উচ্ছলতায় মুগ্ধ হতাম! দৃষ্টি প্রসারিত করলে দেখা যেত লাল মাটির ধুলো উড়িয়ে গরুর গাড়ি এলোমেলো ছুটে চলেছে এদিক-ওদিক। হারানো দিনের এই সব চিত্র জীবন্ত হয়ে যখন তখন আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে! সেই মধুর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে রীতিমত স্মৃতিকাতর করে তুলে! এই কাঁঠালতলায় আরো অনেক কিছুই হতো, এখানকার দুএকটি ঘটনা এখনো আমার হৃদয়ে গাঁথা আছে! মাঝে মাঝে বিদেশি এনজিওকর্মীরা এলে গাছতলাতেই মিটিং বসতো। এক দিন এরকমই এক সভা বসেছিল ভারত থেকে আসা ১০/১২ জন অতিথিকে নিয়ে। সেই দলের নেত্রী ছিলেন শ্রীমতী কমলা বাসিন। তাঁর কাছে আমি যাইনি, তাঁর সাথে কোনো কথাও বলিনি, কী বলব, ইংরেজি বলতে গেলে তো আমার দাঁতই ভেঙ্গে যাবে, ভদ্রমহিলাকে ক্ষণিকের জন্য দূর থেকে দেখেছি মাত্র, অথচ আমার মনে আজো অম্লান হয়ে আছে তাঁর বেশভূষা, তাঁর ছবি, তাঁর চেহারা, তাঁর নামখানি। এখানে আমার স্মরণশক্তির তেজ, তীক্ষ্ণতা ও প্রখরতা দেখে আমি নিজেই হতবাক! (চলবে)
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|