আমার প্রথম চাকরিজীবনের বৈচিত্র্যময় অস্থিরতা - ২ আবু এন. এম. ওয়াহিদ
| | এত প্রত্যাশার চাকরি, কিন্তু করিনি এক মাসেরও বেশি। ‘ব্র্যাক’-এর এই তিরিশ দিন আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় একটি বিশেষ সময় ছিল! এ পর্যন্ত জীবনে এমন সময় আমি আর কখনও পার করিনি, হয়তো আগামীতেও করব না। তখনকার প্রতিটি সূর্যোদয় সমান্তরালভাবে আমার সামনে দু’টো চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হতো। পকেটে মাত্র ২৫ কি ৩০ টাকা, বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ দিয়ে মাস টেনে নিতে হবে, অন্য দিকে নতুন কাজটি শিখতে হবে, বুঝতে হবে, চাকরির চাহিদা মেটাতে হবে। বুঝলাম চাকরির চাহিদা আমি মেটাব, কিন্তু আমার চাহিদা কে মেটাবে। বেতন, সে-তো পাব মাস পুরলে। তার আগের দিনগুলো যাবে কি করে! নিকটে মামা থাকায় একটা বড় সুবিধা হয়েছিল, থাকতে লাগলাম বাসাবোতে তাঁরই বাসায়। এ জন্য মামা-মামীর কাছে আবদার জানাতে হয়নি, তাঁদের অনুমতিও লাগেনি। বাহ, এ যেন ‘মৌরসি পাট্টা’! বাঙালি সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য! আমাদের এই উপমহাদেশ ছাড়া দুনিয়ার অন্য কোথাও এমন রীতি আছে কিনা আমার জানা নেই।
মামার ‘হোটেলে’ সকালের নাস্তা ও রাতের খাওয়াটা পাওয়া যায়। বিনিময়ে মামী কোনোদিন চটের থলে ও বাজারের ফর্দ হাতে ধরিয়ে দেননি, তবে ছুটির দিনে আমি স্বেচ্ছায়ই যেতাম, পছন্দমত মাছ-তরকারি কিনে আনতাম। কাঁচাবাজারে দরদাম করতে গিয়ে দু’এক দিন অসহিষ্ণু দোকানদারের দুর্ব্যবহারের শিকারও হয়েছি। এক দিনের ঘটনাতো স্পষ্ট মনে আছে, তবে সেকথা পুণর্ব্যক্ত করে আজ আর মনের দুঃখ বাড়াতে চাই না। অফিস যাওয়া-আসায় রিক্সা চড়ার কথাতো চিন্তারও বাইরে। শর্টকাট ভেতরের গলিপথে বাসাবো থেকে মগবাজার হেঁটে যাওয়া - হেঁটে আসা। মাথার উপরে তপ্ত রোদ নিয়ে ঘামে ভিজে খালি হাতে হাঁটা যায়, কিন্তু ঝিরঝির হাওয়ায় মামুলি বৃষ্টি হলেইতো বিপদ! আমার যে ছাতা নেই! এ জন্য যাওয়া আসার পথে দু’এক দিন ভিজে থাকলে ভিজতেও পারি, তবে জ্বরজারিতে ভুগে কোনো দিন অফিস কামাই করেছি বলে মনে পড়ে না। তাই বলে একেবারে গুনে গুনে সব দিনই যে কাজে গিয়েছি এমনটিও নয়; কামাই হয়েছে বটে, তবে অন্য কারণে, সে কথায় আসব পরে।
শুরুতে আমার একটা চিন্তা ছিল, দুপুরবেলা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেতো হাতের টাকায় মাস যাবে না, তাহলে উপায় কী! ভাবতে ভাবতে দু’দিন কাটিয়ে দিলাম এবং এরই মাঝে কপালগুণে সমস্যাটির একটি সহজ সমাধানও বেরিয়ে এলো। বুঝলাম, জোড়াতালি দিয়ে দুপুরের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অফিসে সাড়ে দশটার দিকে এক কাপ চায়ের সাথে সোনালী রঙের একটা মচমচে বড় শিঙ্গাড়া পাওয়া যায় এবং বিকেল তিনটায় আরেক কাপ চায়ের সাথে মজাদার দুই পিস মিষ্টি বিস্কুট থাকে। এ ছিল আমার প্রতিদিনকার লাঞ্চের বিকল্প। তবে মাঝে মাঝে এর বাইরে যে কোনো দিন কিছু কিনে খাইনি তাও ঠিক নয়। যেখানে গিয়ে দুপুরের খাবার খেতাম, তাকে রেস্টুরেন্ট না বলে বরং ‘ভাতের দোকান’ বলাই শ্রেয়। অফিস থেকে দু’তিন ব্লক পশ্চিম দিকে হেঁটে গেলে ‘নিউ সার্কুলার রোডের’ উল্টোদিকে পথের ধারের ঝুপড়ি দোকান। রিকশাওয়ালা ও ফকির-মিসকিনদের সাথে একই কাতারে বসে খেতাম। খাওয়ার সময় দুই হাতে তিনটি কাজ সারতে হতো। ডান হাতে ডালভাত খাওয়া এবং বাম হাতে এক দিকে মাছি তাড়ানো ও অন্য দিকে কপালের ঘাম মোছা; একটু অসাবধান হলে ফুঁটো ফুঁটো নোনা পানি খাবার পাতে পড়ে লবণের কাজটি সেরে দিত। সেদিন প্রথমবারের মত টের পেলাম, মানুষের জীবনে এমনও মুহূর্ত আসে যখন ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাতের উপযোগিতা ও দক্ষতা বেড়ে যায়!
কালোবাজারে বিক্রি হওয়া মোটা মোটা রেশনের চালের হাফ প্লেট ভাতের সাথে ছোট্ট এক বাটি ডাল অথবা নিরামিষ - দুপুরবেলা এটুকুই ছিল আমার চাহিদা। দাম বড়জোর আট আনা কি দশ আনা। কয়েক দিন পর আমার পছন্দের মেন্যু দোকানদার ছেলেটির মুখস্থ হয়ে গেল। আমাকে দেখলেই ডাল/ভাজি-ভাত দিয়ে যেত, কী খাব জানতেও চাইত না। খেতে না পেলেও দোকানের মাঝখানে বাঁশের টেবিলের ওপর খোলা বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের বোলে টকটকে লাল ঝোলে রান্না করা ইলিশ, কৈ, রুই ভাসতে দেখতাম! আহা, পেটের খিদে না মিটলেও চোখের খিদেতো মিটতো! ফিরে আসার সময় বিনে পয়সায় মাছ-তরকারির ঘ্রাণ শুঁকে আসতাম! কথায় আছে না, ‘ঘ্রাণং অর্ধ ভোজনং’। উঠতি বয়সে শরীরের আপন প্রতিষেধক অটুট ছিল, যা খেয়েছি - উপভোগ করেছি; যা খেয়েছি - হজম করেছি। আজ পথের ধারের এমন দোকানে বসে ডাল-ভাত খাই আর মাছ-ভাত খাই, সুস্থ শরীরে নির্ঘাত টাইফয়েড এসে বাসা বাঁধবে!
এভাবে আমার ব্র্যাক-জীবনে অন্ন-সমস্যার সহজ সমাধান মিললেও, বস্ত্রের অভাব আচমকা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিলো! মোজা এক জোড়া, আন্ডারওয়ারও একটা। দু’দিনের বেশি পরা যায় না, অথচ সপ্তাহে ছুটি মাত্র একদিন, সেই রোববার এলে কাজের ফুরসৎ। ‘উইকডে’-তে এগুলো ধুয়ে দিই-ইবা কী করে, আর না দিয়েইবা উপায় কী! সন্ধ্যায় কেঁচে দিলে রাতে তো শুকোবে না, সকালে পরব কী! আর মোজা ছাড়া জুতা পরা গেলেও হাঁটাতো যাবে না। ফুটপাথে ওঠার আগেই পায়ের পাতায় ফোস্কা পড়ে যাবে। এর মাঝে ঝটপট এক বুদ্ধি বের করে ফেললাম। এমন বুদ্ধি আমার মাথায় কী করে খেললো, আজো ভাবতে অবাক লাগে! সন্ধ্যাবেলা মোজার নিচের অংশটা ধুয়ে দিই, সকাল বেলা শুকিয়ে যায়। পরদিন রাতে বাকি অর্ধেকটা। আন্ডারওয়ার-এর বেলাও দেখলাম একই তরিকা ভালোই কাজ করছে, কিন্তু গেঞ্জি নিয়ে আমাকে এমন কেরামতি করতে হয়নি। তার মানে কী বুঝলেন? আমার কোনো গেঞ্জিই ছিল না! হা হা, এবার বুঝুন, জীবনসংগ্রাম কাকে বলে!
ইচ্ছে করলে এই সংগ্রামকে আমি সহজেই আরেকটু সহনীয় করে তুলতে পারতাম। সেজো মামার সংসারে টানাটানি ছিল - মানি, কিন্তু ব্যবসায়ী মেজো মামার অবস্থাতো যথেষ্ট সচ্ছল ছিল। তিনি লন্ডন থেকে এসে গাড়ি-বাড়ি নিয়ে ধানমন্ডিতে সৌখিন সংসার পেতেছিলেন। তাঁর কাছে হাত না পেতেও মামীর কাছে চাইলেই দু’এক শ’ টাকা সহজে পেতে পারতাম, কিন্তু কেন চাইলাম না - আত্মসম্মানবোধ? মানঅভিমান? নাকি অন্য কিছু? আসলে এর কিছুই আমার বিবেচনায় ছিল না। সেই সময়ে আমার মনের অবস্থা ও অনুভূতির কথা আজ যখন পেছন ফিরে স্মরণ করি তখন আমি অন্য এক উত্তর খুঁজে পাই। তরুণ মনের সংগ্রামী সাহসিকতাই কারো কাছে আমার হাত পাততে মূল বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারুণ্যই আপন সঙ্কট আপনাকে সামাল দিতে অসীম সাহস যোগায়। আর তাই তো তরুণদের কাছে মা-বাবা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের এত আশা, এত প্রত্যাশা!
আমার জীবনের বাস্তবতা যত কঠিনই হোক না কেন, একটি কথা আমি আজ আপনাদেরকে আস্বস্ত করতে চাই - এসব কিছুকে আমি অতি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিলাম, অভাবকে আমার সাদামাটা জীবনের অংশ হিসেবে খুশিমনে বরণ করে নিয়েছিলাম। দারিদ্রের কষাঘাত আমার মনকে ছোট করেনি, আমার ঘুমেও কোনো ব্যাঘাত ঘটায়নি, আমার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। আর্থিক টানাটানির জন্য কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ, রাগ, মানঅভিমান ছিল না। আমার মাঝে কোনো দুঃখ, বেদনা, অশান্তি, হতাশাবোধও কাজ করেনি, পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো দ্রোহ-বিদ্রোহও দানা বাঁধেনি। আমি জানতাম, এ-সবই আমার জন্য একটি সাময়িক পরীক্ষা, শিগগির আমি কাদা-পানি মাড়িয়ে সোজা শুকনো সড়কে উঠে যাব। এ ব্যাপারে আমার মাঝে সন্দেহের লেশমাত্র ছিল না। পথ চলতে চলতে এ পর্যন্ত বহুদূর চলে এসেছি। এখন আমি দু’টো বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবি। প্রথমত, সেই শুকনো সড়কের ধরনধারণ ও বৈশিষ্ট্য কী? দ্বিতীয়ত, আমার তরুণ মনে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের এমন নিশ্চিত নিশ্চয়তা কে আমাকে দিয়েছিল? এখন আর বুঝতে বাকি নেই যে, শুকনো সড়কে উঠেছি ঠিকই, কিন্তু সেটি এক দিকে যেমন সরলরৈখিক নয়, তেমনি অন্য দিকে এর বাঁকে বাঁকে অসংখ্য পাথর বিছানো! এ ছাড়া আজ আমি এ-ও অনুভব করি, দ্বিতীয় বিষয়-রহস্যও আস্তে আস্তে আমার সামনে খোলাসা হয়ে উঠছে!
এবার আসি ‘ব্র্যাক’জীবনে আমার দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জের কথায়। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা বিভাগে তিন অথবা চারটি ছোট্ট ‘সেল’ ছিল। আমাকে যে ‘সেল’-এ যুক্ত করা হলো তার নেত্রী ছিলেন স্বয়ং ‘ইডি’-র স্ত্রী - মিসেস আয়েশা হাসান আবেদ ওরফে বাহার। শুরু থেকে ‘ব্র্যাক’-এর সংস্কৃতি এমনভাবে গড়ে ওঠে যে, ‘ইডি’-কে কেউই স্যার বলতেন না, সবাই ‘আবেদ ভাই’ বলে ডাকতেন, আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন সবার ‘ভাবী’। গ্রামদেশে একটা কথা আছে না, ‘গরিবের বউ সবার ‘ভাবী’’, না সে অর্থে নয়, আমাদের ‘ভাবী’ গরিবের ‘বউ’ ছিলেন না, ছিলেন ধনীর ‘দুলালী’। কমনওয়েলথ প্রধান মহারানী এলিজাবেথ আবেদ ভাইকে ‘স্যার’ উপাধি দিয়েছেন। এখন আমার জানতে খুব ইচ্ছে করে, ‘ব্র্যাক’-এর লোকজন তাঁদের প্রতিষ্ঠাতাকে কী বলে ডাকেন। আবেদ ভাই এবং ভাবী - তাঁরা দু’জনই বৃহত্তর সিলেটের দু’টি খান্দানি পরিবারে প্রাচুর্যের মাঝে জমিদারি পরিবেশে বড় হয়েছেন। ভাবীর বাবার নাম ছিল ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী। তিনি ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় তখনকার সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার এসডিও ছিলেন, একই সময়ে মৌলভীবাজারের সৈয়দ মোস্তফা আলী ( সৈয়দ মুজতবা আলীর বড় ভাই) ছিলেন সেই মহকুমার ম্যাজিট্র্রেট। এ কারণে তাঁদের নির্দেশে ১৪-ই আগস্ট করিমগঞ্জে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। যে সময় পিতার হাতে দেশের ইতিহাস নির্মিত হচ্ছে সে সময়েই ‘বাহার’ ভাবীর বেড়ে ওঠা। বড়লোকের সন্তান হিসেবে, আমার ধারণা, ছোটবেলা তিনি কনভেন্ট স্কুলে পড়েছেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ ডিগ্রী নিয়েছেন, তাই তাঁর ভাষা ও সাহিত্যজ্ঞান ছিল খুব তরতাজা। ইংরেজি গ্রামার কিংবা ভক্যাবিউলারির জন্য আমাদেরকে ডিকশনারি এস্তেমাল করতে হতো না। আমরা সরজমিন তাঁর কাছ থেকে ইংরেজি বানান ও ব্যাকরণের যাবতীয় সমস্যার তড়িৎ সমাধান পেয়ে যেতাম।
আমি যে সময় কাজে যোগ দিলাম তখন ‘ব্র্যাক’-এ একটি বড় সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণা প্রকল্পের ফিল্ড-ওয়ার্ক শেষে তথ্য বিশ্লেষণের কাজ চলছিল। আমাদের টিমের ফিল্ড এরিয়া ছিল ময়মনসিং এর ‘বলাইরচর’ নামে একটি জায়গায়। দু’এক দিন যেতে না যেতে দেখলাম, এই প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য শ্রীলঙ্কা থেকে একজন কনসালট্যান্ট আনা হলো। তাঁর নাম ছিল ফার্নান্ডেস সেনোরত্ন। তিনি অঙ্কের পিএইচডি হলেও, তাঁর পেশা ছিল, Consultant Sociologist. এ কথা আমি জেনেছি তাঁর পাসপোর্ট দেখে। ড. সেনোরত্নের পাসপের্টাখানা কিভাবে আমার হাতে এসেছিল, সে কথা আজ আর স্মরণে নেই। আমাদের সেদিনকার কনসালট্যান্ট এর পাণ্ডিত্যের ব্যাপ্তি ও গভীরতা ছিল অসাধারণ! সেই সময়েই থাকা-খাওয়া বাদে তাঁকে দিনে ১০০ ডলার করে কনসাল্ট্যাশন ফি দেওয়া হতো। তিনি আবেদ ভাইদের বাসায়ই থাকতেন। যত অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী হোন না কেন, ড. সেনোরত্ন আবার একজন অত্যন্ত সাদামাটা মজার মানুষ ছিলেন। তাঁর চলাফেরা ও বেশভূষা ছিল অতি সাধারণ। তিনি সব সময় প্যান্টের সাথে ঢোলা-লম্বা কুর্তা পরতেন। (চলবে)
লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com
|