bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













আমার প্রথম চাকরিজীবনের বৈচিত্র্যময় অস্থিরতা - ১
আবু এন. এম. ওয়াহিদ



আল-বেরুনী হল - বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে
আমার প্রিয় আবাসস্থল (১৯৭২-৭৮)



সময়টা উনিশ শ’ সত্তর দশকের শেষাংশ। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসের ছাত্র। চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার আগে, চাকরি-বাজারে যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য দু’টো উদ্যোগ নিলাম। দু’টোতেই সফল হই, কিন্তু একটি চাকরি ইচ্ছে করে নেইনি আরেকটি করেছি মাত্র এক মাস। তৃতীয় চাকরিতে দরখাস্ত লাগেনি, হয়েছিল মামার ধরাধরিতে। সে চাকরিও ছেড়ে দিলাম ৫ মাসের মাথায়। তারপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলাম এবং সেখানে পড়িয়েছি পুরো এক বছর। আমি এ চাকরি-প্রার্থী ছিলাম না এবং এতে কারো সুপারিশও লাগেনি। এ যেন আমার আবদার নয় - অর্জিত অধিকার, এ যেন আমার চাওয়া নয় - ন্যায্য পাওনা। আপনা-আপনি পেয়েছি, চাইতে হয়নি। সত্যি, দেশটা একদিন এরকমই ছিল! আজ দূষিত রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে থেঁতলে গেছে! দেশের দোষ নয়, দোষ মানুষের, সমষ্টিগতভাবে আপনার আমার সবার, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বোধ হয় এ অভিযোগ থেকে একটুখানি খালাস চাইতেই পারি, কারণ বাংলাদেশে আমার গোটা চাকরিজীবন সাকুল্যে দেড় বছর। এর মাঝে ঘন ঘন চাকরি বদল আমার জন্য ধাপে ধাপে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা তো নয়ই, এমন কি সমতল জমিনে বহমান নদীর মতন ঘন ঘন বাঁক বদলও নয়। এ ছিল আমার সেই সময়ের মনের অস্থিরতা এবং তারুণ্যের চঞ্চলতা ও উচ্ছলতারই বহিঃপ্রকাশ!

যদ্দূর মনে পড়ে, সাতাত্তর সালের কোনো এক সময় তখনকার বিজেএমসি (বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন) পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিলো - ‘ট্রেইনি অফিসার’ পদে লোক নেবে। দরখাস্তকারীদের নূন্যতম যোগ্যতা, স্নাতক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ থাকা চাই। কাগজপত্র জমা দিলাম, যাচাই-বাছাইয়ের পর কর্তৃপক্ষের নোটিশ পেলাম, কোনো এক সপ্তাহান্তে রোববারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-তে গিয়ে লিখিত পরীক্ষাও দিয়ে এলাম। প্রশ্নপত্রের যেটুকু আজ মনে পড়ে, সঙ্গত কারণেই পাটের ওপর একটি রচনা লিখতে বলা হয়েছিল এবং সাধারণ জ্ঞানের অনেকগুলোর মধ্যে একটি মাত্র ‘কুইজ’ এখনও মনে আছে, 'A is the the father of B, but B is not a son of A. What is the relationship between A and B?' কপাল-গুণে, আগে থেকে না জেনেও আমি সহসা সঠিক উত্তরটি বের করতে পেরেছিলাম!

ওই পরীক্ষায় টিকে যাওয়ার পর মৌখিকের জন্য চিঠি পেলাম। চিঠি নিয়ে গেলাম আমার আরেক মামার কাছে। তিনি তখন অগ্রণী ব্যাঙ্কের হেড-অফিসে লোন অফিসার। মামা বললেন, ‘এটা খুব ভালো চাকরি, ছ’মাস ট্রেনিং-এর পর সরাসরি পদায়ন হবে মিলের ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে’। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি সবই ছিল সে সময়ের তুলনায় খুবই আকর্ষণীয়, তবে আমার কাছে যে বিষয়টি বড় হয়ে ধরা দিয়েছিল তা অন্য এক উত্তেজনাকর ভাবনা। শুরুতেই ‘ডেপুটি ম্যানেজার’, বাহ! কী মজা, কত বড় চাকরি, কত লোক আমার অধীনে কাজ করবে, সমীহ করবে, সকাল-বিকেল স্যার স্যার বলবে, মিলের সামনে এসে নামলেই পিওন-আর্দালিরা হাতের ব্রিফকেস নিয়ে টানাটানি করবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি! কিন্তু হায়! দু’-চার দিনের মাঝেই আমার এ সব আশা গুড়ে বালি করে দিলেন আমারই দুই বর্ষীয়ান মুরব্বি। কিভাবে, এবার শুনুন সেকথা।

মামা দেরি না করে আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর মামাশ্বশুর সিলেটের জনাব এমএ হকের বাসায়। ‘হক নানা’ সাবেক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, তখন তিনি ব্যক্তিখাতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। ঢাকার প্রথম প্রাইভেট হাসপাতালের তিনিই ছিলেন উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। এর নাম ছিল ‘আরোগ্য নিকেতন’। নানা তখন মগ বাজারে ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর উপরতলায়ই থাকতেন। পরে এরশাদ আমলে তিনি মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, তখন বিজেএমসি-র চেয়ারম্যান ছিলেন জনাব সালাহ উদ্দিন আহমেদ যিনি ‘হক’ নানার জুনিয়র হিসেবে এক সময় পুলিশ-বিভাগে কাজ করেছেন। মামার মামাশ্বশুরের সাথে অল্পক্ষণ কথা বলে বুঝলাম, চাকরি হয়তো আমি নিজ যোগ্যতায়ই পেয়ে যাব, আরও বুঝলাম, তিনি বিজেএমসি-তে আমার ক্যারিয়ারের ব্যাপারে একেবারেই উচ্ছ্বসিত নন। কারণ জানতে চাইলে ইংরেজিতে একটি মাত্র বাক্য বলেই ‘নানা’ প্রসঙ্গের ইতি টানলেন। “.....in this job, evil influence on your character will be too strong...!” ‘হক’ নানার এ কথায় আমি খুব একটা গা করিনি, বরং মনে মনে রঙ-বেরঙের স্বপ্ন বুনছি আর দিন গুনছি, কবে আমার নামের সাথে ‘ম্যানেজার’ নাম লাগাব।

তারপর মামা আমাকে নিয়ে গেলেন, আমার বড় ভাইয়ের সম্মুন্দি চাঁদপুরের জনাব এমজি মহিউদ্দিনের অফিসে। তিনি তখন বিজেএমসি-র প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা। তিনিও আমাকে এই চাকরি নিতে মানা করলেন, তবে অন্য কারণে। তাঁর কথা থেকে জানতে পারলাম, ‘ট্রেইনি অফিসার’-দের নিয়ে ‘বিজেএমসি’-র পরিকল্পনায় পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর সরাসরি মিলের ‘ডেপুটি ম্যানেজার’ হিসেবে পদায়ন হবে না। আমি যদি এখন জয়েন করি তাহলে জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) হতে কমসে কম ১৫ বছর লাগবে, কিন্তু পাঁচ বছর পর বিদেশ থেকে পিএইচডি করে এলে সরাসরি জিএম হিসেবে যোগ দেওয়া সম্ভব। পর পর দু’জনের নেতিবাচক পরামর্শে আমি চাকরিটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম, তবে যথারীতি মৌখিক পরীক্ষায় হাজির হলাম, দিলাম এবং চাকরিও পেলাম, কিন্তু কাজে যোগ দিলাম না। এত বছর পর ওই মৌখিক পরীক্ষার একটি প্রশ্ন আজও মনে আছে, ‘১৪০ কে চার ভাগ করলে কত হয়?’ আমি মনে মনে ১৪কে ৪ দিয়ে ভাগ করতে গিয়ে ভগ্নাংশের ফাঁদে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে কৌশল বদলালাম। প্রথম ১৪০কে দুই ভাগ করে বের করলাম ৭০ তার পর আবার ৭০ কে দু’ভাগ করে বলে দিলাম ৩৫ - ব্যাস হয়ে গেল। এ হিসেবগুলো আমাকে আট-দশ সেকেন্ডের মধ্যেই করতে হয়েছিল।

আমি এ জাতীয় প্রশ্নে খুব করিৎকর্মা নই, সেদিন নিতান্তই ভাগ্যগুণে ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেছি। কিন্তু আফসোস তো রয়েই গেল, পরীক্ষা ‘ম্যানেজ’ করলেই বা কি, ‘ম্যানেজার’ তো আর হতে পারলাম না! মহিউদ্দিন ভাইয়ের কথায় পিএইচডি করলাম ঠিকই, কিন্তু দেশে আর ফেরা হলো না, বিজেএমসি-তে চাকরি করার তো প্রশ্নই ওঠে না। লেখাপড়া সেরে মাস্টারি চাকরি নিলাম আমেরিকায়, যথাসময়ে প্রমোশনও পেলাম, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসার হলাম, প্রফেসার হলাম, একটি আন্তর্জাতিক জার্নালের এডিটর হলাম, কত দেশ-বিদেশ ঘুরলাম, কিন্তু আফসোস, জীবনে এক জন অধীনস্থ কর্মচারী পেলাম না, যে কিনা আমাকে মান্য করবে, সমীহ করবে। দু’হাজার সতেরো সালের আগস্টে চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসে টিএসইউ-র অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান হ’লাম। এত দিনে আমি একজন অধীনস্থ সেক্রেটারি পেলাম, কিন্তু হায়রে পোড়া কপাল, সেক্রেটারি আমার কথা শুনে না, আমাকে মানতে চায় না! কাজও ঠিকমত জানে না, হামেশা ভুল করে, উল্টাপাল্টা করে আমার কাজ বাড়ায়, তবু কিছু বলা যায় না! উল্টো তাকে আমার তোয়াজ করে চলতে হয়, হাতে পায়ে ধরে কাজ আদায় করে নিতে হয়! কোথায় যাব, দুঃখের কথা কাকে বলব! একদিন অভিযোগ নিয়ে গেলাম ডিনের কাছে, তলিয়ে দেখা গেল, আমার সেক্রেটারির বেসামাল আচরণের মূলেল খোদ ডিনের সেক্রেটারিরও আশকারা আছে, বিষয় বেগতিক বুঝতে পেরে আশকারাদানকারি মহিলা লাফ দিয়ে এসে হাউ মাউ করে কেঁদেকেটে অফিসকক্ষে এক লঙ্কাকাণ্ড - বাঁধিয়ে দিলো! আমি তো কোন স্যার, দেখলাম, ডিন এবং অ্যাসোসিয়েট ডিন, দু’জনই ভয়ে কম্পমান!

দ্বিতীয় দরখাস্তটি ছিল ‘ব্র্যাক’-এ। লিখিত পরীক্ষা পাস করার পর মৌখিক পরীক্ষার ডাক পেলাম, স্থান - সেই সময়ের মগবাজারস্থ ‘ব্র্যাক’ অফিস। গিয়ে দেখি, পরীক্ষা তো নয়, এ যেন দিনব্যাপী দলেবলে আলাপআলোচনা, গালগল্প ও চা-শিঙ্গাড়ার আড্ডা! গ্রুপ ডিসকাশন, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুক, বক্তৃতা, বিবৃতি ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে কর্তৃপক্ষ যোগ্য প্রার্থী বাছাই করার কোশেশ করছেন। এ-সব শেষ হলে একই দিন অথবা পরে কোনো এক দিন সবাইকে এক জন এক জন করে একটি ভাইভাবোর্ডের সামনে হাজির হতে হলো। সেখানে বসা ছিলেন অন্তত তিন চার জন, তবে এখন আমার মনে আছে মাত্র দু’জনের কথা। তাঁর প্রথম জন ‘ব্র্যাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা তখনকার Executive Director (ইডি) - খোদ ফজলে হাসান আবেদ (তখনও তিনি ‘দি আবেদ’ হননি, ‘স্যার’ উপাধিও পাননি), আর দ্বিতীয় জন ছিলেন, শুরু থেকে জনাব আবেদের দু’জন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর এক জন - তাঁর নাম কায়সার জামান। স্যার আবেদের অন্য সহযোগীর নাম ছিল জনাব ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী। ওই সময় চৌধুরী সাহেব দেশের বাইরে ছিলেন, এর পর তিনি আর কখনো ‘ব্র্যাক’-এ ফিরেছিলেন কিনা, সে কথা আমার জানা নেই। তাঁকে আমি কোনোদিন দেখিনি। এঁরা তিন জনই বৃহত্তর সিলেটের বাসিন্দা। তাঁরা ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে উপদ্রুত দ্বীপ মনপুরায় ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারই ধারাবাহিকতায় আনুষ্ঠানিকভাবে এনজিও হিসেবে ‘ব্র্যাক’-এর গোড়াপত্তন করেন। তখন কে জানত, এই ‘ব্র্যাক’-ই একদিন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এবং অত্যন্ত সুনামের অধিকারী একটি এনজিও হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুড়াবে। ওই ভাইবা পরীক্ষার এক পর্যায়ে একটি ঘটনাও ঘটেছিল যার সুদূর প্রসারী প্রভাব এখনও আমার জীবনে রয়ে গেছে।

আমি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলাম, আমার বায়োডাটার সূত্র ধরে ভাইভাবোর্ডের এক জন বিজ্ঞ পরীক্ষক আমার প্রতি একটি বিব্রতকর মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, “...First class from a second class university... !” কথাটি শোনামাত্র আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম! নিজেকে কিভাবে সামলে নিয়েছিলাম, মনে নেই, তবে ওই মুহূর্তে তাঁর মন্তব্যের ওজন, গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমি বুঝতে পারিনি। পারলে, অফিস কক্ষের পরিবেশই হয়ত বদলে যেত এবং আমার চাকরিও হতো না, কারণ নিজের অপমান আমি তোয়াক্কা করি না, তবে আমার প্রিয় ‘আলমা মেটার’-এর ঢালাও অবমূল্যায়নে আমি মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম! ঘটনাটি মনে হলে আজো আমি ব্যথিত হই। সেদিনকার ওই ইন্টারভিউতে অর্থনীতি, উন্নয়ন, সমাজ-বিবর্তন ও পরিবর্তন নিয়ে নানামুখী আলাপআলোচনা হয়েছে। তার মাঝে মাত্র দু’টো কথা আজও আমার ইয়াদ আছে। প্রথমত, গরিব স্বল্পোন্নত দেশের যতটা না মূলধনের অভাব তার চেয়ে বেশি ঘাটতি সৃষ্টিশীল প্রকল্প পরিকল্পনার। দ্বিতীয়ত, সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থাসমূহ কেবলই উন্নয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, প্রকৃত উন্নয়নের স্বতঃস্ফূর্ত চাবিকাঠি সাধারণ জনগণের হাতে। সেদিনকার মতো ঘটনা এখানেই শেষ। এর পর আমি আর ‘ব্র্যাক’-এর কোনো খোঁজখবর নেইনি। চলে গেছে বেশ কিছু দিন।

ইতিমধ্যে আমার এমএ পরীক্ষা শেষ। কী করব - ভাবছি, এমনি একদিন কী মনে করে হঠাৎ গিয়ে হাজির হলাম সেই ‘হক’ নানার অফিসে। তিনি তখন হাটখোলা রোডে তাঁর নিজের একটি একতলা বিল্ডিং-এ স্থাপিত তাঁরই অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান - ‘মেসার্স যোগানদার লি:’-এ বসতেন। তাঁর বড়ভাই - আব্দুর রাজ্জাক পাশের বাড়িতেই থাকতেন, ছোট ভাই - আব্দুল খালেক একই ফার্মে তাঁর পার্টনার হিসেবে কাজ করতেন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজো, কিন্তু ‘মেজো সাহেব’ অফিসে ঢুকলেই সবার কান খাড়া হয়ে যেত - ‘বড় সা’ব আসছেন, বড় সা’ব আসছেন, সাড়া পড়ে যেত!’ তাঁরা তিন ভাইয়ের বিদ্যা একই ছিল, কিন্তু বৈষয়িক সাফল্যে ও বুদ্ধিবিবেচনায় ‘হক’ নানা ছিলেন সবার বড়। তাঁর মনটাও ছিল তেমনি বড়, ওই বড় মনের ছোঁয়া একটুখানি হলেও আমি পেয়েছি। এক সাথে তিনি জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন, ডায়াবেটিক সোসাইটি, জাতীয় সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান ও আরও অনেক কিছুর সাথে যুক্ত ছিলেন। তখন মতিঝিলে সমবায়ের একটি বড় ন্যায্যমূল্যের দোকানও ছিল। আমি তাঁর অফিসে ঢুকে বললাম, নানা, আমাকে সমবায় সমিতিতে পারলে একটা চাকরি দেন না। এমএ পরীক্ষা দিয়ে এখন অবসর আছি। তিনি জানতে চাইলেন, পরীক্ষা কেমন হয়েছে। আমি জবাব দিলাম, হয়েছে ভালোই, ফার্স্ট ক্লাস পাব। ‘নানা’ তাজ্জব হয়ে আমার দিকে তর্জনী তুলে বললেন, “Look, the boy does not say, Inshallah!” কথাটা শুনেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠলো, ভীষণ লজ্জা পেলাম এবং চিন্তিত হয়ে গেলাম! যদি আল্লাহ্‌ নারাজ হয়ে যান এবং আমার ‘ফার্স্ট ক্লাস’ ফসকে যায়, তাহলে কী হবে!

আল্লাহর মেহেরবানিতে ‘ফার্স্ট ক্লাস’ হাত ছাড়া হয়নি। এখানে আমার একটি ব্যাখ্যা আছে, ‘ইনশাল্লাহ’, না বলাটা আমার ঔদ্ধত্য ছিল না, ছিল তরুণ বয়সের খামখেয়ালীপনা ও গাফলতি। সে যাই হোক, ‘নানা’ আমাকে চাকরি দিলেন। কোনো দরখাস্ত নেই, নিয়োগপত্র নেই, সই-সাক্ষরও নেই। মুখে মুখে চাকরি চাওয়া, মুখে মুখে পেয়ে যাওয়া। মজার ব্যাপার হলো, বেতনও ঠিক হলো না। আমিও জানতে চাইলাম না - তিনি আমাকে কত দেবেন। বললেন, ‘তুমি যদি কাউকে গিয়ে বলো, আমার সাথে কাজ করছ, তাহলে তিনি নির্দ্বিধায় বলবেন, “The boy is learning something.” কথাটা ষোল আনা সঠিক, তবে দুর্ভাগ্য, আমি এই গুণী মানুষটির কাছ থেকে বেশি কিছু শেখার সুযোগ পাইনি। শিখেছিলাম শুধু একটি বানান। তিনি আমাকে একদিন একটি ইংরেজি চিঠির dictation নিতে বললেন। তিনি বলে যাচ্ছেন, আমি লিখছি। এক জায়গায় এসে ‘মেইনটিন্যান্স’ শব্দটি লিখতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। আমি তো ‘মেইনটেইন’ বানান জানি, তার সাথে ‘এন্স’ যোগ করে দিলাম - “Maintainance” তিনি দেখে বললেন, ‘নাতি, হয়নি, ‘মেইনটেইন’ - এ ‘ai’, কিন্তু ‘মেইনটিন্যান্স’-এ শুধু ‘e’ - অর্থাৎ সঠিক বানান হবে - “Maintenance” এবার ভেবে দেখুন, শিক্ষার মান দিনে দিনে কিভাবে তলিয়ে যাচ্ছে! এমএ হক, ব্রিটিশ আমলের পাস কোর্সে বিএ পাশ, আর আমি বাংলাদেশ জমানায় অনার্স-এ ‘ফার্স্ট ক্লাস’, এমএ-তেও তাই, অথচ “Maintenance” বানান জানি না! প্রসঙ্গক্রমে ঔপনিবেশিক আমলের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক দিন সাবেক সচিব জনাব আসাফুদ্দৌলাকে বলতে শুনেছি, তিনি যখন ক্লাস সিক্সে পড়েন তখন ইংরেজিতে সম্রাট বাবরের ওপর ১৬ পৃষ্ঠার একটি রচনা লিখেছিলেন! আজকাল কি এমন কথা ভাবা যায়? সম্রাট বাবরের কথা না হয় বাদই দিলাম, এখনকার ক্লাস সিক্সের সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীকে যদি বলা হয় তার বাবার ওপর ৬ পৃষ্ঠার একটি বাংলা রচনা লিখতে, আমার তো মনে হয় তাতেও সে তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। (চলবে)





লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com








Share on Facebook               Home Page             Published on: 30-Mar-2019

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far