bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













আমি ও আমার বই পড়া - ১
আবু এন. এম. ওয়াহিদ



অতি সম্প্রতি আমার জনৈক সতীর্থ বন্ধুর একটি পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে আমার কিছু অভিজ্ঞতা ও মতামত আপনাদের সঙ্গে আজ শেয়ার করতে চাই। জানি না, এতে কারো বিরক্তির উদ্রেক হবে কি না। কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই বন্ধুটি আমাকে মওলানা আবুল কালাম আজাদের `India Wins Freedom’ বইটি পড়তে বলেছে। মূল ইংরেজি কেতাবখানা সব জায়গায়ই পাওয়া যায়। অনুরোধ করায় সে আমাকে ওই বইয়ের বাংলা পিডিএফ ফাইলটিও পাঠিয়ে দেয়। হাতের কাছে ইংরেজি থাকতে অনুবাদ কেন চাইলাম, যদি লিখতে পারি, সে প্রশ্নের উত্তর আশা করি পরের কিস্তিতে পেয়ে যাবেন। বন্ধুর এই বদান্যতার ফলে মওলানা সা’বকে পড়া আমার জন্য তো এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পড়ি কী করে, পড়তে যে আমার সমস্যা, পড়তে যে আমার দারুণ অনীহা! প্রিয় বন্ধুটি তো তা জানে না। আপনাদের যদি খুলে বলি, কারো কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে, কেউ আবার হাসবেন, না কাঁদবেন - বুঝে উঠতে পারবেন না। আমি কোনো কালেই পড়ুয়া ছিলাম না, এখন তো নয়-ই। যে কেউ বলতে পারেন, না পড়ে পড়ে এত ডিগ্রী হাসিল করলেন কী করে? আর চাকরিজীবনে এত দূর এলেনই বা কোন তরিকায়? আপনাদের সওয়াল যত কঠিনই হোক না কেন, জওয়াব আমার তৈয়ার আছে। যা না পড়লেই না, তার ওপর ভর করেই আমি এ পর্যন্ত এতটা পথ হেঁটে এসেছি। বলবেন, আনন্দ উপভোগের জন্য কি কখনো বই পড়েননি? মোটা দাগে এরও উত্তর - না। তবে সামান্য দু’একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে বৈকি। সে কথায়ও আসব পরে।

যখন হাই স্কুলে গিয়েছি তখন শরৎ বাবুর ‘দত্তা’, ‘পথের দাবী’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ ‘দেবদাস’, ইত্যাদি নাড়াচাড়া করেছি, পাতা উল্টিয়েছি, চোখ বুলিয়েছি, কিন্তু কোনোটিই সমাপ্ত করা হয়নি। এ ছাড়াও বড় ভাইয়ের দেখাদেখি জওহরলাল নেহেরু ‘ভারত সন্ধানে’, বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘একক দশক শতক’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, বিভূতি ভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, তারা শঙ্করের ‘গণদেবতা’, পার্ল এস বাকের ‘দ্যা গুড আর্থ’-এর অনুবাদ ইত্যাদি অসংখ্য বই আমি পড়তে চেয়েছি, শুরুও করেছি, তবে ইতি টানা হয়নি কোনোটারই। বাড়িতে ছোট চাচার আরেক জগৎ ছিল। তিনি পড়তেন শুধু ‘ডিটেকটিভ’ উপন্যাস। আমাকে পড়ে পড়ে শোনাতেন, অনেক সময় শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। তাঁর অনুসরণে কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘কুয়াশা’, রোমেনা আফাজ এর ‘দস্যু বনহুর’ ইত্যাদি বই আমি পড়ার কোশেশ করেছি, কিন্তু ফলাফল ওই একই। কাভার খোলা এবং পাতা উল্টানো পর্যন্তই ছিল আমার দৌড়। ছাত্রজীবনে কেন এমন ছিল আমার স্বভাব? ভেবেচিন্তে বই পড়ায় আমার এই অরুচির তিনটি কারণ আমি সনাক্ত করেছি। প্রথমত, পুস্তক পাঠে বলতে গেলে আমি কখনও আনন্দ পাই না, দ্বিতীয়ত, বই আমাকে ধরে রাখতে পারে না বলেই এ কাজে অতি সহজেই আমি আগ্রহ এবং ধৈর্যহারা হয়ে যাই, এবং সব শেষে বলব, যা-ই পড়ি না কেন, কিছুই আমার মনে থাকে না। মাত্র কয়েকদিনের মাথায় নাম-ধাম, দিন-তারিখ, ঘটনা-পরম্পরা ইত্যাদি প্রায় সব এলেমই আমার মাথা থেকে গায়েব হয়ে যায়। ইদানীং ইন্টারনেট ও গুগল এর বদৌলতে বই হাতড়ানোর প্রয়োজন একেবারেই কমে গেছে। নিত্য দিনের দরকারি তথ্য-উপাত্ত মাউস ক্লিক করলেই টেনে বের করে আনা যায়। বই কিনতে হয় না, পাঠাগারে যেতে হয় না, পড়তেও হয় না। বাহ! কী মজা! ছাত্রজীবন যদি এ ভাবে কাটাতে পারতাম!

বই নিয়ে আমার স্বভাবে একটা অদ্ভুত বৈপরীত্যও আছে বটে। না পড়লেও কিন্তু আমি বই কিনতাম। বিশেষ করে যখন কলেজে পড়ি তখন আমি প্রচুর বই কিনেছি। টাকা কিভাবে জোগাড় হতো, আল্লাহ-ই মালুম। নতুন নতুন বই কিনতাম, পাতা উল্টাতাম, কিছুদূর পড়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখতাম। বন্ধুরা চাইলে ধার দিতাম। ঘর থেকে বই এক বার বেরিয়ে গেলে কদাচিৎ আবার ফিরে আসত। এভাবে আমার অনেক বই ‘সকালের ফুলের মতো’ অকালে হারিয়ে গেছে। পড়ায় যখন নজর নাই তখন বই আমি কেন কিনতাম? এই প্রশ্নের উত্তর যদি শুনেন, নিশ্চয়ই আপনারা হাসবেন। কলেজ জীবনে আমার দু’জন ‘রোল মডেল’ ছিল। এক, বন্ধু সহপাঠী মাহবুব যাকে আপনারা অনেকেই চেনেন। দুই, আব্বার বন্ধু ডা. শুকুর চাচার ছেলে আতাউল। এদের দু’জনেরই বাবার টাকা ছিল যথেষ্ট। তারাও ছিল ভীষণ পড়ুয়া। এদের উভয়ই বেশুমার বই কিনত এবং পড়ত। তাদেরকে অন্ধ অনুসরণ করেই আমার বই কেনার বদ-অভ্যাস। তারা তো পড়ার জন্য, অজানাকে জানার জন্য বই কিনত। যদি বলেন, আমি কেন কিনতাম? সত্যি বলতে কি, এ প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে নেই। এ মনস্তত্ত্বের কোনো ব্যাখ্যাও আমি আজ অবধি জানি না। ভাগ্যিস এ বদ-অভ্যাস আমার বেশি দিন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মাহবুব-আতাউলের ছায়া আমার উপর থেকে অনেকটা সরে যায়। আমার মতন এমন আজব স্বভাবের অন্য কোনো মানুষকে কি আপনারা চেনেন বা জানেন? নিশ্চয়ই না।

আমার এলোমেলো জীবনে এমন গহিন অন্ধকার অধ্যায়ের পরও বলব, পড়াপড়ি নিয়ে সামান্য হলেও একটু আলোক-রেখার ছোঁয়াও আমি পেয়েছি। এবার শোনাব দু’একটি ব্যতিক্রমের কথা। তখন আমি হাই স্কুলে পড়ি - কোন শ্রেণীতে সঠিক বলতে পারব না। এক দিনের কথা। সে দিন ছুটির দিন। আকাশ ঘন কালো অন্ধকার মেঘে ছেয়ে গেছে, সারাদিন ধরে ধুন্ধুমার বৃষ্টি হচ্ছে - ঝরছে তো ঝরছেই, বড় বড় ফোঁটার বর্ষণ বিরামহীন ভাবে পড়ছে টিনের চালায়। বুঝলাম, কানে সঙ্গীতের মতন আওয়াজ উঠছে, শরীরে চঞ্চলতা! মনে ঘন গাঢ় এক অজানা অস্থিরতা এসে ভর করছে! কী করব কী করব, কিছু ভেবে পাচ্ছি না। কী ভেবে সাহস করে প্রথম বারের মতো আব্বার বালিশের পাশ থেকে চুরি করে নিয়ে পড়তে লাগলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘শহর থেকে দূরে’ বইটি। জীবনে প্রথম একটি বই আমি একটানে পুরোটাই শেষ করলাম। পড়তে গিয়ে বুঝলাম, দেহ-মনে এক ধরনের পুলকানুভূতি ও উত্তেজনা আমাকে মাদকাসক্তের মতন কাবু করে ফেলছে! কী এই সুখানুভূতির নাম, কেন এই নতুন অভিনব অভিজ্ঞতা? তার কিছুই জানতাম না! আমার বছর খানেক বড় এক বন্ধু তুতো ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, আমি এখন আর নিছক বালক নই, বরং বালেগ হয়ে গেছি। আরো বুঝলাম, ‘উপন্যাস’ কাকে বলে এবং ‘উপন্যাস’ পড়তে আব্বার কেন এতো মানা। এ হলো আমার জীবনের প্রথম পূর্ণ একটি বই পড়ার কাহিনী।

যখন কলেজে গেলাম, তখন আরো একটি বই আমার আনন্দ-মন্দিরে এসে আসন গ্রহণ করল। এ পুস্তকটিও আমি আগাসে গোড়া শেষ করি, এক বৈঠকেই। বইটি আমি নিজে কিনেছিলাম। কেন, সে সব কথা আজ আর মনে নেই। এটি ছিল, ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজার্ব্ল’- এর বাংলা অনুবাদ। বইয়ের প্রধান চরিত্র ‘জা ভালজা’ গোড়া থেকে আমাকে এমনভাবে আঠার মতো ধরে রেখেছিল - অস্থির হয়ে হুড়োহুড়ি করে পড়ছি আর ভাবছি - তারপর কী, তারপর কী! এক সময় এসে দেখলাম বইটি শেষ হয়ে গেছে। এই শেষ হওয়াটা আমি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারিনি, আজও না। ভিক্টর হুগোর উপর আমার তখন অনেক রাগ হয়েছিল এই ভেবে যে, লেখক এতো কৃপণ হবে কেন? আরও লম্বা করলে কী অসুবিধা ছিল?

সব শেষে এসে যা বলব, তা ভিন্ন এক নতুন অভিজ্ঞতা। বুড়ো বয়সে মুহাম্মদ আসাদের ‘রোড টু মেক্কা’ পুরোটা পড়েছি। তবে এক টানে নয়, পড়েছি বেশ কয়েক দিনে। এই বই থেকে আমি যতটা জ্ঞান আহরণ করেছি ততটা আনন্দও উপভোগ করেছি। জ্ঞানের কথা কিছুই এখন মাথায় অবশিষ্ট নেই, আনন্দের রেশ এখনো কিছুটা আছে। থাকবে বহুদিন। সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পাবার মত একটা বই। এই হলো আমার বই পড়ার ইতিহাস, আনন্দ-বেদনা, অভিজ্ঞতা ও কৃপণতার একটি আংশিক চিত্র।





লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ Email: awahid2569@gmail.com








Share on Facebook               Home Page             Published on: 23-Apr-2021

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far