আলীর কথা আবু এন এম ওয়াহিদ
বিয়ের পর নববধূকে ঘরে তুলে আনার আগে প্রথম যেদিন আমি আমার শ্বশুর বাড়ি গেলাম সেদিন সেখানে বেশিক্ষণ ছিলাম না। যেটুকু সময়-ই বা ওই বাড়িতে কাটিয়েছিলাম তাতেও নতুন জামাই হিসেবে যেটুকু আবেগ ও উত্তেজনা মনের মাঝে শুরুতে এসে বাসা বেঁধেছিল, বোধ করি ক্ষণিকের মধ্যে তাও ঢেকে গিয়েছিল অকস্মাৎ অস্বস্তির এক পাতলা চাদরে। খানিকটা ক্লান্তি, খানিকটা লজ্জাবোধ ও আমার স্বভাবসুলভ অজ্ঞতা এবং বোকামিই ছিল ওই অস্বস্তির মূল কারণ। শ্বশুরের বড় বাড়ি, সামনের খোলা আঙ্গিনা, সাজানো ফুলের বাগান, আম-নারিকেল-লিচু-কাঁঠালের সারি, ঘরের ভেতরের আসবাবপত্র ও সাজসজ্জা একেবারে আহামরি না হলেও আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণরূপে নতুন এক অভিজ্ঞতা! এমনি এক পরিবেশে নিজেকে সহজভাবে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা যে হচ্ছিল, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম! আরো খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে, আমার জড়তা দেখে বাড়ির সবাই বুঝি বিব্রত বোধ করছেন!
কিভাবে বসব, কিভাবে কথা বলব, প্রথম দর্শনে শ্বশুর-শাশুড়িকে কী বলে সম্বোধন করব, কী বলতে কী বলে ফেলি, বেআদবি হয়ে যায় কিনা, এ নিয়ে ভীষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে বুকটা দুরু দুরু করছিল! খাওয়ার টেবিলে কাঁটাচামচ কেমন করে ধরব, যদি বা হাত থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায় তাহলে তো মহা-বিড়ম্বনা! দুশ্চিন্তার এ-ও একটা অনুষঙ্গ ছিল বটে! এমন বিচলিত ও সন্ত্রস্ত অবস্থার মাঝেও শ্যালিকাদের বুদ্ধিদীপ্ত ধারালো প্রশ্নাবলী এবং রসালো মন্তব্য আমি বেশ উপভোগ করছিলাম। দ্বিমুখী মনের এই টানাপোড়নে আমি যখন একেবারে অস্থির, তখন ওই বাড়িতে যে মানুষটি আমাকে একটু সাহস ও শক্তি যোগাতে পারত সে আমার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখনও তার সাথে আমার দেখা হয়নি, পরিচয় হয়নি, বেচারা আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াবেই বা কেমন করে!
খাওয়াদাওয়ার পর্বটা কোনো রকম অঘটন ছাড়াই পার করতে পেরেছিলাম বলে মনে হলেও, শহুরে সংস্কৃতির মাঝে অসাবধানতা বশতঃ আমার গেঁয়ো স্বভাবের কিঞ্চিৎ কোনো আলামত সে দিন ধরা পড়েছিল কি না সে ব্যাপারে আজও আমি ষোল আনা নিশ্চিত নই। শ্বশুর বাড়িতে খাওয়ার সময় প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকলেও, সেটা হয়তো বা সম্ভব হয়েছিল সেই আসরে আমার স্ত্রীর উপস্থিতির কারণে। ওই অবস্থায় অব্যক্ত এক ইশারায় সামান্য হলেও নিজের মনে ক্ষুদ্র এক টুকরো আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল এবং টেবিলে শ্যালিকাদের আচরণও ছিল একটু সংযত, দয়াপরবশ ও সহজিয়া। তাদের করুণা যতটা না ছিল আমার প্রতি, বলাই বাহুল্য, তার চেয়ে বেশি ছিল সহোদরার সহধর্মীর মান বাঁচাবার সহৃদয় সাবধানী প্রচেষ্টা।
খাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ স্ত্রীকে পাশে পেয়েছিলাম। প্রথম দিন শ্বশুর বাড়িতে প্রথম বারের মত স্ত্রীকে নিয়ে এক সাথে বসার সময়টা বিদ্যুৎ গতিতে কেটে গেলেও, অবশিষ্ট ক্ষণগুলো কিভাবে পার করেছিলাম তার বিবরণ কেবলমাত্র আইনস্টাইনের ‘থিওরি অফ রিলেটিভিটি’তে-ই বুঝি পাওয়া যায়। নতুন আত্মীয়-বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর বুঝতে পেরেছিলাম, সে-রাতে ও-বাড়ির হালচাল আমি কিছুই ঠাহর করতে পারিনি। আর এই না পারাটাই ছিল আমার কাছে একটি বিশাল প্রাপ্তি! সেই প্রাপ্তির তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী তাৎপর্য কি আমি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম? তার গভীরতা কি আমি স্পর্শ করতে পেরেছিলাম? পরবর্তীকালে আমি কি আমার জীবনে তাকে সঠিকভাবে ধারণ ও লালন করতে পেরেছি? ঘুরেফিরে এই প্রশ্নগুলো বার বার আমাকে নাড়া দেয়, তাড়া করে, যন্ত্রণা দেয়! কেন দেয়? সে অনেক কথা, অনেক লম্বা কাহিনী! সে গল্প হবে না হয় আরেক দিন, অন্য প্রসঙ্গে। আজ যার কথা বলব বলে লিখতে বসেছি তাকে সেদিন দেখিওনি, চিনিওনি।
রসুমাত এবং ছোট্ট ওয়ালিমা অনুষ্ঠানের পর মামার বাসা থেকে স্ত্রীকে নিয়ে ফের যখন শ্বশুর বাড়ি থাকতে গেলাম তখন সে-বাড়ির উন্নত সংস্কৃতি ও রুচিশীলতা আস্তে আস্তে আমার সামনে উন্মোচিত হতে লাগল। সেই সময় আমার শ্বশুর বাড়িতে গাড়ির ড্রাইভারসহ নারী-পুরুষ মিলে চার-পাঁচ জন কাজের লোক ছিল এবং যতদূর মনে পড়ে ‘আলী’ও সেদিন বাড়িতেই ছিল। এদের মাঝে সবার আগে এই ‘আলী’ই আমার নজর কাড়ে। ‘আলী’-র প্রতি আমার প্রথম আকর্ষণেরও একটি বিশেষ কারণ ছিল। ছোটবেলা পলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে সে তার একটি পা হারায়, ফলে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। এতে প্রথম সাক্ষাতেই তার প্রতি আমার একটি সহানুভূতি ও মায়া জেগে ওঠে। পরবর্তীকালে তার কাজের দক্ষতা ও চরিত্রের সরলতা দিয়ে সে আমাকে পুরোপুরি জয় করে নেয়। আমি যখন প্রথম তাকে দেখি তখন তার বয়স হয় চল্লিশের মাঝামাঝি অথবা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। তার জন্মস্থান রংপুরের এক গ্রামীণ জনপদ - কে জানে, হয়তো বা মিঠাপুকুর, নয়তো রৌমারীর কোনো এক নিরিবিলি পল্লীগ্রাম।
উনিশ শ’ পঞ্চাশ দশকের শেষ অথবা ষাটের শুরুতে আমার শ্বশুর পূর্ব পাকিস্তান সড়ক ও জনপথ বিভাগের সিনিয়র প্রকৌশলী হিসেবে রংপুরে কর্মরত ছিলেন। সম্ভবত তখনই ‘আলী’ এসে যোগ দেয় তাঁদের পরিবারে এবং কালের আবর্তে সে হয়ে ওঠে এই পরিবারের একজন স্থায়ী সদস্য। সেই থেকেই সুখে-দুঃখে সব সময়ই ‘আলী’ ছিল আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে। দীর্ঘ দিন তাদের সংসারে থেকে ‘আলী’ অনেক ধরনের বাহারি কাজকর্ম শিখে গিয়েছিল। শুধু ‘শিখে গিয়েছিল’ বললে একটু কমই বলা হয়, যা-ই সে শিখেছিল, তার সবই ছিল নিখুঁত, নিপুণ এবং নির্ভেজাল! এ ব্যাপারে যতটা না কৃতিত্ব ‘আলী’-র তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল আরেক জন মানুষের, আর তিনি হলেন আমার শাশুড়ি-আম্মা। আমার শাশুড়ি অতি যত্ন করে নিজ হাতে ধরে ধরে ‘আলী’কে সব জাতের রান্না শিখিয়েছিলেন। রন্ধনশিল্পের এমন কিছু ছিল না, যা কি না ‘আলী’-র অজানা।
ভাত-তরকারি, কোর্মা-পোলাও, পরোটা, মোগলাই পরোটা, রেজালা, বিরিয়ানি, মোরগ-পোলাও, ইলিশ-পোলাও, ইলিশের দোপেয়াজা, গোশত ভুনা, ভুনা খিচুড়ি, মুরগীর রোষ্ট ও মোসাল্লাম, মাছ ও গোশতের কালিয়া-কোফতা, বিভিন্ন জাতের কাবাব, চিকেন ও শ্রিম্প কাটলেট, শিঙ্গাড়া, সমুসা, আলুর চপ, আলু পুরি, ডাল পুরি, চটপটি, ইত্যাদি সব কিছু রান্না করা সে শিখেছিল এবং শিখেছিল সঠিক তরিকায়, সঠিকভাবে। আম থেকে নিয়ে আমলকী ও কাঁচা মরিচ থেকে নিয়ে রসুন পর্যন্ত সব কিছুর আচার এবং আমসত্ত্ব ও আমশি, ইত্যাদিও ‘আলী’ বানাতে পারত। মিষ্টিদ্রব্যের হাঁড়িপাতিলেও ছিল তার সমান ও স্বচ্ছন্দ নাড়াচাড়া। পুডিং থেকে শুরু করে ময়দার হালুয়া, ডিমের হালুয়া, সুজির হালুয়া, বুটের ডালের হালুয়া, নেশেস্তা, সেমাই, পায়েশ, ফিরনি, বুন্দিয়া, রসগোল্লা, জিলাপি, দৈ, সন্দেশ, ক্ষীর, চমচম, কুমড়ার মোরব্বা, নারকেলের বরফি, ইত্যাদি তৈরিতেও সে ছিল সিদ্ধহস্ত। এ তো গেল সব খান্দানি খাবারদাবারের কথা। অতি সাধারণ রান্না - অর্থাৎ ‘আলী’-র হাতের ডাল ও আলুভর্তা যে একবার খেয়েছে, বাকি জীবনভর তার মনে থাকবে। এ কথা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি।
লেখাপড়া না জানলেও রান্নার ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের মাপজোখে ‘আলী’-র কোনো ভুলভ্রান্তি হত না। তার পাকা হাতের শৈল্পিক ছেয়ায় নিখুঁতভাবে তৈরি হত একেকটি আইটেম। ‘আলী’-র হাতের রান্না শুধু সুস্বাদুই ছিল না, তার খাদ্য তৈরি ও পরিবেশনা ছিল অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, রুচিসম্মত ও শিল্প-মণ্ডিত। বটিতে বসে সে ভাজির জন্য আলু, পেঁপে, সিম ইত্যাদি এত মিহি করে এত সমানভাবে কাটতে পারত যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মত নয়! ‘আলী’-র কাটাকাটি সহজেই যেন মেশিনকে হার মানিয়ে দেয়!
পরিষ্কার-পচ্ছিন্নতা ‘আলী’-র ঈমানেরই অঙ্গ ছিল। সে প্রায় প্রতিদিন সাবান মেখে গোসল করত, তাই তার গা থেকে কখনো অন্যান্য কাজের লোকদের মত ঘামের গন্ধ বেরুত না। সে কাপড়চোপড় যাই পরত, তার সবই ছিল ঝকঝকে তকতকে, ছিমছাম, ফিটফাট। ‘আলী’ নিজে ভালো থাকত, সুন্দর থাকত, ঘরবাড়িকে সুন্দর করে রাখত, সবাইকে সুন্দর থাকতে সাহায্য করত। বাড়ির ছোট বড় সবার সাথে তার আচারব্যবহার ছিল মাপমতো, মার্জিত এবং সর্বোপরি সুন্দর ও ভদ্রজনোচিত। ‘আলী’-র ব্যবহারে কোনো দিন আমি রূঢ়তা কিংবা বেআদবির লেশমাত্রও খুঁজে পাইনি। এ জন্য সে বাড়ির সবার কাছে ছিল একজন অতি প্রিয়পাত্র। সুন্দর ব্যবহার দিয়ে পর হয়েও সে সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। দীর্ঘ দিন ওই বাড়িতে থাকার কারণে সে আমার শ্বশুর-শাশুড়ির আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব সবাইকে চিনে গিয়েছিল। ‘আলী’ আমার শ্বশুর সাহেবকে স্যার ডাকত, কখনও কখনও সাহেবও বলত। শাশুড়িকে ডাকত বেগম সাহেব, আমার স্ত্রী ও শালীদের বড়, মেজ ও ছোট আপা বলে সম্বোধন করত। শালাকে ডাকত ভাইয়া, আমাকে দুলাভাই, আমার শিশু-ছেলে ছিল তার প্রিয় ‘আসাদ মামা’।
উনিশ শ’ তিরাশি সালে আমরা আমেরিকা থেকে প্রথম যখন দেশে যাই তখন আসাদের বয়স মাত্র দু’মাস। ছোট্ট শিশুর পাসপোর্ট দেখে তো আলী বিস্ময়ে হতবাক! সে তো ভাবতেই পারে না, কী করে দু’মাসের একটি বাচ্চার পাসপোর্ট হয়, কী করে সে ভিসা লাগিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে বেড়াতে আসে! ‘আলী’-র সে বিস্ময় কী করে দূর করব, তার কোনো হদিস আমার জানা ছিল না। এক ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে বেচারা খেল আরেক ধাক্কা। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘দুলাভাই, আমেরিকা দেশটা কেমন?’ আমি বললাম, সে দেশটাও মাটির, সোনা-রূপা দিয়ে মোড়ানো নয়। আলী ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল! তার প্রশ্নের এমন উত্তর সে আমার কাছে আশা করেনি। আমি আরো যোগ করেছিলাম, সে দেশের মাটি দিয়ে আল্লাহ্ আমাদের দেশের মানুষ বানিয়েছেন এবং আমাদের দেশের মাটি দিয়ে বানিয়েছেন আমেরিকার মানুষ। ‘ওরে আল্লাহ্, এ আবার কেমন কথা!’ কথাগুলো দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এলো ‘আলী’র মুখ থেকে! আমি আমার কথার ব্যাখ্যা দিলাম এই বলে, আল্লাহ্ আমাদের দেশের সাদা ও লাল মাটি দিয়ে আমেরিকান সাহেব ও মেম সাহেবদের তৈরি করেছেন বলেই তাদের গায়ের রঙ দুধে আলতা, আর সে দেশের উর্বর কালো ও ধূসর মাটি দিয়ে বানিয়েছেন আমাদের দেশের অগণিত নারী-পুরুষকে, তাই তো আমরা শ্যামবরণ। এবার ‘আলী’-র মনে কিছুটা স্বস্তি এলো।
আমার কথায় ‘আলী’ বিস্মিত হয়েছে, আবার তার কাজ দিয়ে সে আমাকে বিস্মিত করেছে! রান্নায় যেমন তার জুড়ি ছিল না, তেমনি সেলাই-ফোঁড়াইতেও। সে খুব ভালো ‘এমব্রয়ডারি’-র কাজ জানত। আমার শাশুড়ি সেই প্রশিক্ষণও তাকে দিয়েছিলেন। একদিন বিকেল বেলা রোদ পড়লে আমি ছাদের ওপর হাঁটতে গিয়ে দেখি ‘আলী’ বসে বসে সুতোর কাজ করছে। আমাকে দেখে বলল, ‘দুলাভাই, বলতে পারেন, এই সেলাইটার নাম কী?’ আমি বললাম, না, আমি তো জানি না, তুমি বল দেখি। সে অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ের সাথে গর্বভরে আমাকে তার হাতের কাজ দেখিয়ে শিখিয়ে দিলো, ‘এটাকে বলে ‘হেরিং বুরিং’ সেলাই!’ আমি কাছে গিয়ে ভালো করে চেয়ে দেখলাম, সত্যিই সেলাইটা ‘হেরিং বোন’-এর আকৃতির। বস্টনে আমি জীবনে প্রথম বারের মত হেরিং মাছ খেয়েছি, কাটাকাটি করতে গিয়ে হেরিং-এর শিরদাঁড়া দেখেছি। তাই ‘আলী’-র সেলাই চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি। ‘আলী’ যে সেলাই দেশে থেকে ঢাকায় বসে চিনেছে, সেটা চিনতে আমাকে যেতে হয়েছে সুদূর বস্টন শহরে। তারও অনেক পরে যখন প্যারিসের ‘সা’জ-এ-লিজ’-এ বোলেভার্ড দেখেছি তখন দ্বিতীয়বারের মত চিনেছি ‘হেরিং বোন’ কাকে বলে। যারা প্যারিসের ওই বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট-এ গেছেন তাঁরা জানেন, দু’দিক থেকে পাকা গলিপথগুলো ‘সা’জ-এ-লিজ’-এর চওড়া রাস্তার সাথে এসে মিশেছে ‘হেরিং বোন’-এর আকৃতি ধরে।
কাজের লোক হলেও আমার শ্বশুর বাড়িতে ‘আলী’-র অবস্থান নিছক এক জন ‘কাজের লোক’-এর মতন ছিল না। সে কি শুধু ওই পরিবারের এক জন সদস্যই ছিল? না, তার চেয়েও বেশি! ‘আলী’-র থাকার ঘর, রান্নাঘর, প্যান্ট্রি, ইস্ত্রিঘর, ইত্যাদি জায়গা ছিল তার একান্তই নিজস্ব ভুবন, তার আপন সাম্রাজ্য। ছাদের ওপরও এক চিলতে জায়গা ছিল ‘আলী’-র রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এর এক পাশে সে বিকেলবেলা আম গাছের ছায়ায় বসে একা একা এক মনে কাজ করত, আরেক পাশে পানির কলের তলে ছিল তার কাপড় কাচার স্থান। ওই সব জায়গায় ‘আলী’ ছাড়া আর কারো দোহাই চলত না। কেউ কিছু ওলটপালট করলে সে ছাড়ও দিত না। সবাইকে দাবড়াত, তবে এ ব্যাপারে গৃহকর্তা ও কর্ত্রী ছিলেন ব্যতিক্রম। ভিখেরি কিংবা তার অধীনস্থ নতুন কাজের লোকদের খাবার পাতে ভাত তরকারি বেড়ে দেওয়ার সময় ‘আলী’ তার স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করত, তবে এ সুযোগে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করত বলে তেমন অভিযোগ শোনা যায়নি। যে যাই বলুক, বাড়ির কাজের লোক হলে কী হবে, ‘আলী’-র সাম্রাজ্যে ‘আলী’-ই ছিল সম্রাট, সে ছিল তার রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, ‘রাজাধিরাজ’ - ‘আলীরাজা’!
আপন রাজ্যের রাজা ছিল বলেই ‘আলী’-র মনটা ছিল রাজারই মতন। আমার স্ত্রীর কাছে শুনেছি, আপনজন বলতে তার এক ভাগ্নে ছিল। নিজ রোজগারের টাকা দিয়ে সে তার ভাগ্নে কে বিএ পাশ করিয়েছিল। ওই ভাগ্নেই লায়েক হওয়ার পর বুড়ো মামার সাথে সু-ব্যবহার করেনি। তথাপি ভাগ্নে র বিরুদ্ধে ‘আলী’-র তেমন গুরুতর অভিযোগ ছিল না, কারণ ‘আলী’-র চিন্তাধারা ও কথাবার্তা ছিল নিষ্পাপ শিশুর মতন সহজসরল। মন ছিল আকাশের মত উদার ও উন্মুক্ত। আমি একদিন আলীকে বলেছিলাম, আলী, তুমি আমেরিকা যাবা? চল না আমাদের সঙ্গে। ‘না দুলাভাই, আমেরিকা - সে তো অনেক দূর! এত দূর আমি যাই কেমনে’? উত্তর দিলো ‘আলী’। আমি বললাম, দূর হোক না, তাতে কী? তুমি তো আর হেঁটে যাবা না, তুমি যাবা এরোপ্লেনে চড়ে, আকাশে উড়ে। ‘না দুলাভাই, এত দূর আমি যামু না’, ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল ‘আলী’। যেন আমেরিকা যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘দূরত্ব’টাই তার কাছে সবচেয়ে বড় বাধা, সবচেয়ে বড় ভয়! আধুনিক জমানায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া-আসার বেলা পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস, ভরণপোষণ, সিকিউরিটি ক্লিয়ার্যা ন্স ইত্যাদির মত কঠিন ও জটিল সমস্যার ‘আলী’-র কী সহজসরল বিশ্লেষণ! ‘বিদেশ - সে তো দূর, অনেক দূর! আমি এত দূরে যাব না!’ এত বড় একটি সমস্যার এমন সহজ সরলীকরণ! এটা কেবল ‘আলী’-র পক্ষেই সম্ভব! দুনিয়ার দেশে দেশে যত রাজা-বাদশাহ, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ আছে - তারা যদি তাদের রাজ্যশাসনে চিরাচরিত কাঠিন্য ও কুটিলতা পরিহার করে ‘আলী’-র মতন সকল সমস্যার সহজসরল সমাধান খুঁজত তাহলে কেমন হত?
(ন্যাশভিল, সেপ্টেম্বর, ২০১৭) The Author is an Economics Professor and an Academic Journal Editor in the U.S. Email: wahid2569@gmail.com
|