কবিতা অভিভাষণ। এই বিষয়টি আমার কাছে নতুন। বেশ কয়েকটি কারণে। প্রথমত বাংলাদেশে নব্বই এর দশকে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠ চর্চা শুরু হলেও এর জনপ্রিয়তা সকল সময়ই বই মেলার বই এর সাথে বোনাস আইটেম অথবা জনপ্রিয় আবৃত্তিকারদের এ্যলবামে সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই কবিতা পাঠ এই প্রজন্মের কাছে একটা সেকেলে বিষয়, বড়দের বিষয় বুড়োদের বিষয় হয়ে রইলো। কারণ একটাই, এই ফর্মের সাথে সরাসরি নাটকের মিল এবং অমিলের জায়গাটা পারফর্মেন্স নির্ভর। আর তাই কখনো কখনো রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কবিতা পাঠ আমাদের কাছে বোরিং লাগে আবার কখনো কখনো জীবনানন্দ দাশের কবিতা উৎসব প্রাণের কাছে চলে আসে।
কবিতা এবং নাটক এই দুইয়ের বন্ধুত্ব চিরকালের। নাটকে কবিতার ব্যবহার প্রাচীন। কবিতার ছন্দে কাব্য নাট্য আমাদের অহংকার। সব্যসাচী নাট্যকার সৈয়দ হক এ ধারায় আমাদের আধুনিক রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিতা আবৃত্তি, কাব্যনাট্য আর কবিতা অভিভাষণ কি এক?
এক যে নয়, আবার সরাসরি অভিন্নও যে নয় তার উজ্জ্বল উদাহরণ প্রবাসী মার্টিনদ্বয়ের এই চমৎকার প্রযোজনা - “আপনারা আমার বাবাকে ক্ষমা করবেন”।
প্রবাসের মাটিতে বসে শিল্পের এমন একটি ফর্মকে (কবিতা) ধারণ করে তার মধ্যদিয়ে আমাদের রাজনীতির ভেতরে মনুষ্যত্ব-বোধের জাগরণ তৈরিতে একটি অসাধারণ সৃষ্টি। একক নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠন এর পর থেকে ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে রাজনীতি ইতিহাস আর বর্তমান বাস্তবতার একটা দ্বান্দিক লড়াই চলছে। একদিকে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে সাথে করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অন্য দিকে ইতিহাসের বিভিন্ন ফিউশন আর কনফিউশনের একটি নতুন প্রজন্মর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানেই কিছু পুরনো বকবকানি।
এর মধ্যে “জাতী - জননী - পিতা” বাঙ্গালীর হাজার বছরের অনুভূতির এই জায়গাগুলো যখন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভেতরেই খুব নড়বড়ে– - তখন কে শুনতে চায় পিতৃহীন কোন সন্তানের গল্প? দেশের ভেতরে বসে গত এক দশকে এমন অনুভূতি নিয়ে শৈল্পিক কাজ করেনি কেউ। কারণ প্রয়োজন পড়েনি। না চাইতেই আজকাল আমাদের এখানে অনেকে অনেক কিছু পাচ্ছেন। ভালবাসা, সুযোগ এমনকি সম্পদ।
পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েই অনেক বছর আগে জন মার্টিন দেশের মাটি ছেড়েছেন। হয়েছেন প্রবাসী মার্টিন। আজ এতদিন পর জমে থাকা অদম্য ভালবাসা, মমতা আর ফেলে আসা মঞ্চের স্মৃতি নিংড়ে বেড়িয়ে এসেছে “আপনারা আমার বাবাকে ক্ষমা করবেন”। সাহিত্যের বিচার করার যোগ্যতা আমার নেই, তবে ধারনায়নের জায়গা থেকে মনে করি যে, সার্বিক উপস্থাপনায়, আঙ্গিকে, বাচিকে এটি যদি পুরোপুরি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বলা হয় তাতে ক্ষতি কি? যার যা বলার ইচ্ছা তাতে বোধ করি প্রবাসী মার্টিনদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা যা বলতে চেয়েছেন, খুব শক্তিশালী ভাবেই তা বলতে পেরেছেন নান্দনিক ভাবে।
এবার শট বাই শট মূল্যায়ন করতে চাই কিছুটা। প্রথমত কবিতাটি একজন সন্তানের আত্মকথন। সেই আত্মকথন তার বাবার জন্যে সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যদিয়ে। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের যেকোনো ধর্মের রীতিতে আমরা যেমন দেখতে পাই পরিবারের ছেলে এই ক্ষমা প্রার্থনা করে তার বাবার হয়ে। যার ছেলে নেই সেই পরিবারে এই কাজটি কে করে? এই বাংলায় বাপের বেটা হয়, বাপের বেটি কি হয়? জেন্ডার সমতার এই বিশ্বে এই প্রযোজনাটি শুরুই হয়েছে সেই জায়গাটিকে সমান করার মধ্যদিয়ে। প্রথমে মনে হবে মৌসুমি তার নিজের বাবার কথা বলছেন। একান্তই ব্যক্তিগত। একান্তই মনের ভেতরের গহীনের শাণিত বোধ থেকে নিংড়ে আসা কিছু কথা। ক্ষমা চাইতে চাইতে কত কিছু বলে ফেলা যায় অনেক কিছু না বলেই। জন মার্টিন অত্যন্ত দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এই অনেক কিছু না বলে জাতির পিতাকে অসাধারণ থেকে খুব সাধারণ, অতি সাধারণ অনুভূতির জায়গায় নিয়ে আসার এই যাত্রাটিকে। যেখানে পিতা হয়ে উঠেছেন সবার পিতা। আর পিতৃহারা সন্তান হয়ে উঠেছেন দর্শক নিজেই। অসাধারণ !
প্রথমত কোন বড় সেট ব্যবহার না করে ঘরের ভেতরেই একটা নিউট্রাল জোন তৈরি করার চেষ্টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর মধ্যে কিছু ছবির ফ্রেম। আত্মকথন শুরু হওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই দর্শক মানুষটিকে দেখতে চাওয়ার একটা তাগিত অনুভব করতে থাকেন। এক মিনিটের মধ্যে এমন তাগিত তৈরি করতে পারা কঠিন। এবং শেষ দৃশ্য পর্যন্ত ছবি না দেখিয়ে থাকার বিষয়টি অসাধারণ! মানুষকে তাদের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গত চল্লিশ বছরে বঙ্গবন্ধুর হাজারো ছবি মনে করতে সাহায্য করে। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাইপ চশমার মতো পরিচিত নিত্যব্যবহার্য্য প্রপস দিয়ে মূল মানুষটির পরিচয় উন্মোচন একটি শক্তিশালী নির্দেশনা। ট্রলি শটটি শেষ হয়েছে নৌকার পাটাতনে, রাজনীতির বাইরে রাখতে চাননি বলেই হয়তো এই সিম্বলিক এটেনশন। সিঁড়ির দৃশ্যটিও একটি মনতাজের মতো। রক্তাক্ত সেই সিঁড়ির নীচে নিয়ে দর্শককে দাঁড় করায়। পেছনে লাল আলোর ব্যবহার বিষয়টিকে আরো স্পষ্ট করে তোলে।
ইতিমধ্যেই বলেছি। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বসে বাংলাদেশের এমন একটি অনুভূতির জায়গাকে স্পর্শ করার চেষ্টা সত্যিই একটা দু:সাহস। একটি শোবার ঘর আর সিঁড়ি দিয়ে কি সব শিল্প সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়? কিন্তু সাহস ছিলো শত সীমাবদ্ধতায় থেকেও সীমাকে অতিক্রম করার। তাই ছোটখাটো কিছু বিষয় ঠিক করার সুযোগ পায়নি প্রযোজনাটি। জিয়া আহমেদ কে আমি চিনি না। আগে তাঁর কাজ দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না। কিন্তু তাঁর এই কাজটি সত্যিই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে সীমাকে অতিক্রম করার একটি চেষ্টা। কস্টিউম আর মিউজিক আরো শক্তিশালী হতে পারতো। মৌসুমি যদি শুধু একটা সবুজ শাড়ি পড়তেন, সিঁড়ির দৃশ্যটা একটা বাংলাদেশ হয়ে উঠতো। আবহ সঙ্গীত আবেগকে তাড়িত করেনি একটুকুও, কিন্তু ডশ আশ্চর্য মনের ভেতরে প্রচণ্ড কোন অপরাধ বোধ তৈরি করেছে টপটপ করে ঝড়ে পড়া চোখের জল। আর সেই চোখে মুহূর্তেই দেখেছি প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাসের আগুন। যেন সেই ৭ই মার্চের ভাষণেরই একটি ছোট্ট ফুলকি উড়ে এসে বলছে - “আমি আমার বাপের বেটি।”
“সাবাশ বাপের বেটি”
টনি মাইকেল গমেজ, এম. এ ফিল্ম এন্ড মিডিয়া, নির্মাতা ও নাট্যজন, হেড অব কমিউনিকেশনস, প্লান ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ, Email: tonymgomes@gmail.com
Share on Facebook               Home Page             Published on: 23-Oct-2015