সুরধ্বনি ক্যানবেরার অনুষ্ঠান তারিক জামান
প্রায় ১৮ মাস পর ক্যানবেরার সুরধ্বনি একাডেমী তাদের গানের বার্ষিক অনুষ্ঠান করলো। পারমিতা দে তার ছোট বড় শিক্ষার্থীদের দিয়ে যে ভাবে পারফরমেন্স করিয়ে নিলেন... এক কথায় অপূর্ ! আর পারমিতার কথা কি বলব- যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন পারমিতা কত বড় এবং উঁচু মাপের একজন গাইয়ে। বারো বছর গান শিখেছেন ২১ শে এবং অনেক পদক পাওয়া সিলেটের পণ্ডিত রাম কানাই দাসের কাছে। মাঝে বর্তমান সময়ের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লিজেন্ড পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছেও শিক্ষা নিয়েছেন। পারমিতার প্রতিভা নিশ্চয় পন্ডিতজীর নজর এড়িয়ে যায় নাই; তাই উনি গতবারের মত এবারেও skype এর মাধ্যমে পারমিতা, সুরধ্বনি এবং অনুষ্ঠানের জন্য আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন। (এর মাঝে বলে রাখি আমার খুব ইচ্ছে কোনো একদিন পন্ডিতজীর গান উনার সামনে বসে শুনব।
সুরধ্বনি প্রতিবারের মত এবারেও তাদের অনুষ্ঠান ঠিক সময়েই শুরু করেছে, মাঝে ৩০ মিনিটের বিরতি দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান- এক কথায় অনেক বড় প্রাপ্তি। ছোটদের গান দিয়ে শুরু... তারপর পারমিতার উচ্চাঙ্গ নির্ভর কয়টা একক, তার বয়স্ক শিক্ষার্থীদের একক এবং সমবেত পরিবেশনা। সবাইকে অবাক করেছেন আমাদের ইউসুফ ভাই- 'জীবনানন্দ হয়ে সংসারে আমি.....' গেয়ে। খুব ভালো গেয়েছেন এবং নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন, অতিরিক্ত কিছু করার চেষ্টা করেন নাই। এইটা একজন শিল্পীর অনেক বড় গুন। ইউসুফ ভাইকে ধন্যবাদ। অরুণের সম্পর্কে কিছু বলার নাই- এমনিতেই ভালো গায়, গতকালও ভালো গেয়েছে লাকি আকন্দের 'আগে যদি জানতাম....। ডা. রানা গতকাল তবলার বদলে কন্ঠ শিল্পী ছিলেন; ডা. রুম্মান দেখি ভালো কীবোর্ডও বজায়। ডাক্তারি বিদ্যার পাশে এতসব কেমনে শিখল আর এখনো তা ধরে আছে... অভিনন্দন।
পারমিতার কোন গান রেখে কোনটা বলব; আধুনিক, নজরুল, রবীন্দ্র, ভাওযাইয়া, মুর্শিদী, লালন, হাছন সব কিছুতেই শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দিয়েছেন। পরিচ্ছন্নতা এবং ভালো পরিকল্পনার ছাপ ছিল পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে। সব রকম শ্রোতার জন্যই গান ছিল। সামান্য সময়ের জন্যও শ্রোতারা বিরক্ত হয় নাই। বিরতির আগে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ৬৯ সাল থেকে ৯০ দশকের গানের 'কোলাজ' এবং 'ইবলিশ শয়তানে তার আশা পুরাইল... আমার বা তার বেশি বয়সীদেরকে তাদের ছাত্রজীবনে ফিরিয়ে নিয়ে গেছিল। 'কোলাজে'র প্রথম গান 'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে....পুরো অডিটরিয়াম নিস্তব্ধ করে দিয়েছিল। পারমিতা চমত্কার গেয়েছেন, সাথে তার ছাত্র-ছাত্রীগণও। বিরতির পর 'দিল কিয়া চিজ হে, আপ জান ভি লি জিয়ে... ' খুবই সুন্দর গেয়েছেন পারমিতা। গানের সাথে আমি ফিরে যাচ্ছিলাম ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ভারতীয় কালচারাল সেন্টারে, ১৯৮২ সালে প্রথমবারের মত উমরাওজান দেখি বড় ভাইয়ের সাথে, কারণ VCR তখনও অনেক দামী বস্তু। আমার দৃশ্যগুলো আবছা আবছা মনে পড়ছিলো : লাল ঘাগরা পড়া রেখার সেই সম্মোহনী নাচ (আচ্ছা অমন করে চোখ দিয়ে কেমনে এত কথা বলে!), সাম্পানে বসে ফারুখ শেখের মুচকি হাসি, নাসিরুদ্দিন শাহর জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখা, আরো কত কি ! আশা ভোসলের গাওয়া, শাহরিয়ার আর খৈয়ামের লেখা আর কম্পোজিশনে এমন গান আবার কবে হবে কে জানে!
একজনের কথা না বললে অন্যায় হবে: সে হচ্ছে তাপস। তবলায় তার হাত দুটি যা দেখালো! ঈর্শা করার মত তার হাত দুটো। পারমিতার গানের সাথে তাপসের তবলা - কোনটা শুনি কোনটা দেখি। ক'দিন আগে কথায় কথায় রসায়ন শাস্ত্র পাশ করা তাপসের সাথে কথা হচ্ছিল খুব কম অনুষ্ঠানে ওর তবলা বাজানো নিয়েI তাপস বলছিল যে সে চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে; আমার বিশ্বাস তাপস তা পেয়েছে। পারমিতার সাথে কিছুক্ষণ যুগলবন্দীতে যা দেখালো! হল জুড়ে শুধু তালি আর তালি! তাপসের তবলার বাদন দিনে দিনে আরো ভালো হোক কামনা করিI বাঙালি না হয়েও জর্জ আর রুবন- দুজনেই বাঙালিদের অনেক অনুষ্ঠানে কঙ্গো আর ড্রাম বজায়, খুবই চমত্কার! গতকালও ব্যতিক্রম ছিল না।
অনুষ্ঠানের আরো একটা দিক লক্ষণীয় ছিল: Master of Ceremony (MC) এর কথার কম অত্যাচার। যতটুকু বলার ঠিক তত টুকু। ভিনদেশীদের উপস্থিতির কথা ভেবে MC ইংরেজিতে বলেছেন, তবে পুরোটা ইংরেজি না বলে কিছু বাংলায় বললে আরো ভালো হত, কারণ ৯৫ ভাগ দর্শক ছিল বাঙালি। যাই হোক গান আমাদের সব ভুলিয়ে দিয়েছে। অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন একটা প্রাঞ্জল সন্ধ্যা ক্যানবেরা বাসীদের উপহার দেবার জন্য। ভাস্কর দা' .... আপনাকে কি আলাদা করে ধন্যবাদ দেব?
অনুষ্ঠানের টিকেট এবং অন্যান্য উৎস থেকে অর্জিত পুরো অর্থটাই চলে যাবে 'Let's work for Bangladesh' আর ভারতের 'সহয়া' নামের এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। সুরধ্বনির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক।
তারিক জামান, ক্যানবেরা
|