গল্প সমালোচনা একজোড়া চিচিঙ্গা এবং নস্টালজিক বৈশাখ স্বপন নাথ
মূল লেখাটি পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মানুষ মূলতঃ ত্রিবর্ণ-দর্শী ইংরেজিতে trichromatic। লাল, হলুদ, নীল - এই তিনের মিল। মানুষের বর্ণ দৃশ্যমানতা এই তিনটি রঙের মিলনে সীমাবদ্ধ অথবা উন্মুক্ত। সীমাবদ্ধ এজন্যে যে মানুষ যা-ই দেখে তা কোন না কোন ভাবে এই তিনটি রঙেরই সমন্বয় বা যোগফল। উন্মুক্ত এজন্যে যে এই তিনটি রঙ সীমাহীন মাধ্যমিক অথবা ঐচ্ছিক রঙ তৈরি করতে পারে।
মৌলিক রঙগুলিকে নিয়ে খেলেন একজন চিত্রশিল্পী, যেখানে দুটো পদ্ধতিতে (সংযোজন, বিয়োজন) তাঁরা ব্যবহার করেন মৌলিক রঙগুলিকে। শিল্পীর এই খেলায় তাঁর মৌলিক রঙগুলি হয় হালকা। লালের জায়গায় ম্যাজেন্টা/আবীর, নীলের বদলে সাইয়্যান/সবুজাভ নীল। ঐচ্ছিক রঙ সৃষ্টিতে হালকা রঙকে পুঁজি করে এভাবেই শিল্পী আবিষ্কার ও ব্যবহার করেন তাঁর কল্পনার, অনুভূতির রঙ। প্রায়শই একটি রঙ অন্য একটি রঙকে ছাপিয়ে বা অতিক্রম করে যায় যা তৈরি করে নতুন আর একটি রঙ।শিল্পীর ছবি এই রঙের খেলা। অনুভূতির অনুলিখন।শিল্পী আঁকেন তাঁর রঙ-তুলিতে কল্পনা আর অনুভবের রঙে, দর্শক তা প্রত্যক্ষ করেন তাঁর নিজের দৃষ্টি দিয়ে আর উপভোগ করেন নিজের দেখাকে আপন অনুভূতি, আবেগ আর অভিজ্ঞতার রঙে মিলিয়ে। দর্শক আর শিল্পীর দেখা বা দর্শনে যখন একটি মেলবন্ধন তৈরি হয়, শিল্পী তখন হন আশ্বস্ত, তৃপ্ত অথবা আপন বৈশিষ্ট্যে নির্লিপ্ত; আর দর্শক হন পুলকিত, উজ্জীবিত অথবা আবেগে আপ্লুত। স্মৃতি বিস্মৃতি আর বর্তমানের হালকা আর গাঢ় রঙে রঙ মিলিয়ে আসাদ শামস এঁকেছেন তাঁর নস্টালজিয়া আর বৈশাখ।একবার তাঁর রঙের আভা ছড়িয়ে গেছে স্মৃতির দূর সীমানায় আবার তা ফিরে এসেছে বর্তমানের ঔজ্জ্বল্যে।শিল্পীর ইজেলে কখনো রাখা রঙ পরিশীলিত বাঙালি রমণীর অন্তরের আর বাহিরের; কখনো সে রঙ প্রতিষ্ঠিত অথবা সংগ্রামী অভিবাসীর জীবন-আলেখ্যের। আর এই দুয়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে ত্রিবর্ণ-দর্শী মানবের সম্মুখে সীমাহীন বর্ণচ্ছটায় আলোকিত ক্যানভাস - "একজোড়া চিচিঙ্গা এবং নস্টালজিক বৈশাখ" (সংক্ষেপে এচিএনবৈ)।
বিখ্যাত La Parure (The Necklace) গল্পটা লিখতে গিয়ে এর প্রথম প্যারায় "elle" (she/সে) ফ্রেঞ্চ শব্দটা পাঁচবারেরও বেশিবার লিখেছেন মোপাসাঁ। আমার ক্লাসের ক্রিয়েটিভ পার্টে আমার শিক্ষার্থীদের শিখাই একই শব্দ বা শব্দ-গুচ্ছ উপর্যুপরি একাধিক বাক্যে ব্যবহার না করতে। আবার ইচ্ছাকৃত পুনরাবৃত্তির সদুদ্দেশ্য কী হতে পারে সেটিও তাদের শেখাতে চেষ্টা করি। মোপাসাঁর "elle" পাঠককে মনে রাখতে বাধ্য করেছে - এই "elle" বা "she" বা "সে"-ই গল্পের উপজীব্য। ঠিক একই শব্দ/শব্দ-গুচ্ছের পুনরাবৃত্তি না হলেও চেতন বা লেখকের স্বভাবজাত অবচেতনে বাঙালির এক ডজনেরও বেশি প্রিয় খাবারের লিস্ট ব্যবহার করেছেন লেখক আসাদ শামস। একটির পর একটি। এতে ডাইনিং টেবিলটা ভরেছে কি ভরে নি, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পাঠকের মনে অব্যর্থ ভাবে স্থাপিত হওয়া বাঙালির শাশ্বত জীবনাচরণ। যদিও এর আবেদন একজন অভিবাসীর জীবনে যতটা সহজে লভ্য, একজন স্বদেশবাসীর কাছে ঠিক ততটা সহজ না-ও হতে পারে। কেননা, খাবার টেবিলে এই রেসিপি/রন্ধন-শৈলীগুলির আবির্ভাব একজন স্বদেশবাসীর জীবনে যতটা সহজে মুহুর্মুহু, অভিবাসীর জীবনে ততটা নয়; ফলে এসবের এমনকি সামান্যতম উপস্থিতি অভিবাসীর মনকে তোলপাড় করে। তাই স্বদেশবাসীর কথা ভেবে একটু গার্নিশিং প্রয়োজন ছিল কিনা ভাবা যেতে পারে। গার্নিশিং লেখনীর, অর্থাৎ বর্ণনা-বিস্তৃতির কিঞ্চিৎ সীমানা-বৃদ্ধি। আবার সিডনীর বাস্তবতায় একজন অভিবাসী যতটা স্বচ্ছন্দে সামান্য টীকাটিপ্পনী-তেই তার সিডনীবাসকে প্রত্যক্ষ বা অনুভব করতে সক্ষম, স্বদেশবাসীর জন্যে তা ঠিক ততটা সহজ নয়। যদিও বিশ্বায়ন আর ইন্টারনেটের আশীর্বাদ-পুষ্ট এই যুগে সশরীরে অবস্থান ছাড়াও অনেক জ্ঞানই অর্জন সম্ভব। তথাপি স্থান, কাল, পাত্রের রঙ আরেকটু বেশী যদি নেয়া হত তুলিতে, ক্যানভাসের আয়তন খুব কি বেশি বাদ সাধত? আমারও জানা নেই। আমি যা জানি তা হল, "Anyone can be a critic. Writers are priceless." নন্দিত লেখক ফ্লবেয়ার (Floubert)-এর উপন্যাস "LEducation Centimentale" সম্পর্কে হেনরি জেমস বলেছিলেন, "masticating ashes and sawdust" অর্থাৎ চর্বিতচর্বণ; অথচ উপন্যাসটি বিশ্বজুড়ে তুলেছিল ব্যাপক সাড়া। তথাপি আসাদ শামসের পরবর্তী সৃষ্টিতে এটি ভাববার অন্ততঃ অবকাশ থাকল।
আবার বড় ক্যানভাস না নেওয়া তো গল্পের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের "শেষ হয়ে হইল না শেষ" ছাড়াও লেখকের চেতন বা অবচেতনে এডগার এ্যালান পো-র "The Raven" এর single sitting rule এর প্রয়োগও এচিএনবৈ-তে লক্ষণীয়। পো বলেছিলেন, "If any literary work is too long to be read at one sitting,
. Forces the reader to take a break and the affairs of the world interfere and break the spell." মানে গল্প হবে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার জিনিস। হয়েছে; তবে কিছু প্রক্ষেপ অথবা "info dumping" (দুটো এক জিনিস নয়) ক্ষেত্র-বিশেষে হাস্যরস বা প্রসঙ্গের অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে এলেও কোথাও অন্ধকারে কালো বেড়াল হাতড়ানো হল কিনা, যেটি সেখানে নেই বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। তবে পো-র মতই আসাদ বিমূর্ত থেকে সরেছেন মূর্ততায়, পো-র ভাষায়, "choosing characters as mouthpieces of ideas" অর্থাৎ চরিত্রগুলোকেই ইমেজ বা ধারণার মুখপাত্র করে। আর এভাবেই লেখক এচিএনবৈ-তে সর্বত্র বিরাজমান অথচ কোথাও নন দৃশ্যমান।
উপন্যাস বলে, "এসো, একটু থাকো এখানে, এই চরিত্রগুলোকে জান, এদের ভালোবাসো, এবার দেখো কিভাবে এরা বদলায়
"। কিন্তু একটা গল্প ঠিক ততটা অতিথিপরায়ণ নয়। কারণ সে সাধারণতঃ inherently transgressive (শুরু হল আমার অনুবাদ/পারিভাষিক যন্ত্রণা) যাকে বলা যেতে পারে (পরিভাষা লভ্য নয় সাধারণ অভিধানে) মজ্জাগত-ভাবে নিয়ম-ভঙ্গকারী (হাস্যকর অনুবাদ)। আর এই transgression আবাহন করে অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাহুতকে; যেই অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাহুতের জটাজাল ছাড়াতে গিয়ে পাঠক ক্রমাগত নিবিষ্ট হতে থাকে গল্পের গভীর থেকে গভীরে।কিন্তু আসাদ শামসের "একজোড়া চিচিঙ্গা এবং নস্টালজিক বৈশাখ" সে পথে এগোয় নি। আবাহন করে নি অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাহুতকে। বরং চিরায়ত, চিরপরিচিতকে ডালিতে সাজিয়ে হাজির করেছে পাঠকের সামনে।"পটল ভাজি, কুচো চিংড়ি দিয়ে লাল শাকের চচ্চড়ি, পুঁইশাক আর ইলিশের চচ্চড়ি
"! পরিচিত-এর পরিবেশনে পটু লেখক পরিচিত-কে নবায়ন করেন বর্ণনা-বিস্তৃতির নিরীক্ষায়। যেখানে কাঁঠালের বিচি আর গরুর গোস্ত ভুনা হয়ে ওঠে শুকনো কাঁঠালের বিচি আর গরুর গোস্ত দিয়ে ঝাল ভুনা, কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি হয়ে ওঠে কচুর লতি দিয়ে ঝাল চিংড়ি, পালঙ শাক আর চাপিলা মাছের চচ্চড়ি হয়ে ওঠে পালঙ শাক আর চাপিলা মাছের পোড়া পোড়া চচ্চড়ি। পরিবেশনের এই আয়োজনে পাঠক ততক্ষণে আর দর্শক নন, বরং স্থাপিত, নিমগ্ন এই পরিবেশনে। একইভাবে, প্যারামাটা নদী-পাড়ের বৈশাখী মেলাও আমাদের সামনে হাজির করে প্রায় দুকুড়ি নামের এক ফর্দ। আতিক, মাসুম, আকরাম, মাজু, থেকে শুরু করে জিকু, আজিজ, কামাল ভাই পর্যন্ত। তারপরও পরিচিত-এর বর্ণনা-বিস্তৃতি "সব্বাই এসেছে" (জিকু, আজিজ, কামাল ভাই সব্বাই এসেছে)। এখানেই থামেনি তা। বরং এরপর এলো রাশেদ শুভর পরিচয়, মেলাতে তার ভূমিকা, ত্রিমূর্তির গান করা, শাড়ী পড়া, মুসা ভাইয়ের শারীরিক গড়ন, অভিব্যক্তি, ব্যস্ত-নির্লিপ্ত পেশাদারিত্ব, ঢাকা সিডনীর দূরত্বহীনতা, শেকড় আর শাখার একত্বের টানে ৩৬৫-কে অরুণিমা দত্তের নমাস-তিনমাসের বিভাজন, সর্বোপরি এই বিস্তৃতির ভেলায় ভর করেই আধুনিক, সচেতন লেখক সুযোগ পেয়ে গেলেন, আসলে তো সুযোগ তৈরিই করে নিলেন অধুনা বিশ্বের জটিলতম সঙ্কটের মেসেজ-এর প্রতীক কবি শাহাদ মান্নানকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার। তবে হ্যাঁ, তালিকা অতিদীর্ঘ হলে পাঠক predictious হয়ে ওঠার ভয় থাকে অর্থাৎ পাঠকের কাছে পূর্বাভাস মিলে যাবার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু বর্ণনা-বিস্তৃতির আরোহী স্টাইল লেখককে তা থেকে নিরাপদ রেখেছে। প্রশ্ন হতে পারে, লেখক যদি পরিচিত প্রেক্ষাপট নিয়েই কথা বলেন, তবে তাঁর কি দায়িত্ব সেটা নিয়ে নতুন কিছু বলা? নাকি এটা যা, Emile Zola-র naturalism-কে ভিত্তি করে perfectly তাকেই চিত্রিত করতে চেষ্টা করা? ডিম আগে না মুরগী আগে-র যতি-হীন বিতর্ক। আমি এ প্রসঙ্গে শতভাগ লেখকের পক্ষ। কার কথা মনে নেই "Just see what the writer does and how he does." তাছাড়া, এটি যদি একটি দর্পণও হয় আর তা যদি হুবহু আমাকেই প্রতিবিম্বিত করে, সেই বিম্ব যতই কুৎসিত আর নগণ্যই হোক, আমি বারবার ফিরে যাব সে দর্পণের সম্মুখে নগণ্যের দর্পিত আকর্ষণে।
সাহিত্যের কিছু স্বতঃসিদ্ধের মধ্যে একটি এরকম "If the theme is familiar, the writer refreshes them with a cast of appealingly crazy characters." আর তাই এচিএনবৈ-তে যখন যেখানেই পর্দা উঠেছে, আমরা জেগে উঠেছি পরবর্তী সচেতনতার ডাকে, তা-ও আবার রুকু, এক নারী চরিত্রের ডাকে; যেখানে লেখক হয়ে ওঠেন একটু বিশেষ রকমই মানবিক যদিও সরাসরি বলতে চাই না ফেমিনিস্ট। তবে লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতা আমাদেরকে শরীরের উষ্ণতা আর ঘামের গন্ধ দুটোতেই ঋদ্ধ করে। - An implicitly political writing where the writer guides the reader towards nonpolitical paradoxically. রাজনীতি আর রাজনীতি-হীনতার প্যারাডক্স, রুকুর কলেজ জীবন, প্রেম, বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের নস্টালজিয়াকে করেছে মূর্ত বর্তমান, যে বর্তমানের মাথায় হাত রেখে আমরা যেন বলে উঠি "কেমন আছো তুমি?"
আসাদ শামস সিদ্ধ লেখক। বাক-চতুরতায় গল্পের সর্বত্র বিরাজমান তিনি, অথচ দৃশ্যতঃ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত পরিপক্বতার চিহ্নস্বরূপ। আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটি, চলি, কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে চলেন না বরং তাঁর বয়ান চলে আমাদের সঙ্গে যা পদে পদে সৃষ্টি করে চলে জিগ-স-পাজেল-এর এক একটি রঙিন স্লাইড, যেগুলোকে মেলানোর আনন্দে ভাসি আমরা- পাঠক। আর এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি এক ব্রিটিশ লেখিকার কথায় প্রতিধ্বনিত: "Technique holds a reader from sentence to sentence but only content will stay in mind." তাছাড়া, একজন অভ্যস্ত, বিদগ্ধ পাঠক কখনোই একজন লেখকের অঙ্কিত অক্ষরগুলিকে পাঠ করেন না; বরং ওই অক্ষরগুলির মধ্যে দিয়ে লেখকের অন্তর্জগতের সঙ্গে একটি সম্পর্ক স্থাপন করেন। আর এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই পাঠক অর্থাৎ আমরা রুকু, জিল্লুর, তবিবুল সাদেক চাচার নিউরনে লাল, হলুদ, নীল বৈদ্যুতিক আর রাসায়নিক সঙ্কেতগুলির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াই প্যারামাটা থেকে পদ্মা, ইতিহাস থেকে বর্তমান, ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতা, স্বপ্ন থেকে অতীত, সেখান থেকে বাস্তব, বাস্তব থেকে বর্তমান - যেখানে অবস্থান করে অস্তিত্ব। লাল, হলুদ, নীল - এই তিনের মিল। আমরা হই ত্রিবর্ণ-দর্শী ইংরেজিতে trichromatic। অস্তিত্বের এই সদর্প উচ্চারণই "একজোড়া চিচিঙ্গা এবং নস্টালজিক বৈশাখ"।
জয়তু চিচিঙ্গা, জয়তু বৈশাখ, জয়তু আসাদ শামস!!
স্বপন নাথ, বাংলাদেশ
|