মাইকেলেঞ্জেলোর মহান সৃষ্টি পিয়েতা সুতপা বড়ুয়া
করোনা এসে পৃথিবীটা ওলট পালট করে ফেলার ঠিক আগে আগে, ২০১৯ এ আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম বেশ কয়েকটা দেশে। আজ লিখব শুধু পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশ ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় দেখা অসামান্য এক ভাস্কর্যের কথা।
সেই ভাস্কর্যটার নাম পিয়েতা বা Pity অর্থাৎ করুণা এবং এর ভাস্কর মাইকেলেঞ্জেলো। যীশুর মরদেহ কোলে মাতা মেরী, এটাই ভাস্কর্য, পিয়েতা।
অনেক জায়গাতেই গেছি, ঘুরেছি অনেকগুলো দেশ, তাই অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও কম পুষ্ট নয়, কিন্তু কখনো কখনো এমন কিছুর মুখোমুখি হয়েছি যা আগের সবকিছু ম্লান করে দিয়ে যেন হতবাক করে দেয়। পিয়েতা দেখে আমার তেমনি অবস্থা হয়। আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই।
পৃথিবী এই অতি-মারির হাত থেকে কবে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে জানি না, তবু বলছি, যদি কখনো সুযোগ হয়, সামনা সামনি দেখে নেবেন মাইকেলেঞ্জেলোর পিয়েতা। আহা! যেন পাথরে খোদাই করা কবিতা।
যীশুর নিষ্প্রাণ এলানো শরীর কোলে নিয়ে মাতা মেরীর মুখের যে অভিব্যক্তি ধরা পড়েছে, তা যে কোন শিল্পীর পক্ষে কাগজে ফুটিয়ে তোলাটাও যথেষ্ট দুঃসাধ্য। সেই কাজটাই কি নিপুণতার সঙ্গে পাথরে করেছেন ভাস্কর। তাই তো তিনি মাইকেলেঞ্জেলো। Il Divino বা The Divine One.
পুরো ভাস্কর্য জুড়েই রয়েছে তার অসামান্য সক্ষমতার প্রমাণ। মানুষের শরীরের সঠিক গঠন এবং সহজাত ভঙ্গিমাই শুধু নয়, মাইকেলেঞ্জেলোর পিয়েতায় মেরী এবং যীশুর কাপড়ের ভাঁজগুলো পর্যন্ত কি নিখুঁত।
মাইকেলেঞ্জেলো কিন্তু শুধুমাত্র ভাস্কর ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন শিল্পী, স্থপতি এবং একজন কবিও, আর তাই তো পূর্ণবয়স্ক যীশুকে কোলে রাখা মেরীকে তিনি ইচ্ছে করেই larger than life করেছিলেন, যাতে মায়ের কোলে যীশুকে দেখে মায়ের কোলই যে শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়, সেটা ফুটে ওঠে। মেরী তাই মাতৃত্বের মূর্ত রূপ আর যীশু যেন চির-শিশু।
পিয়েতা দেখে আমার মনে হয়েছে পুরোটা না করে মাইকেলেঞ্জেলো যদি শুধু মাত্র মাতা মেরীর মুখটুকুও করতেন, তাও বোধহয় তিনি আজীবন শিল্পবোদ্ধাদের নমস্য হতেন। কি গভীর বিষাদ সেই মুখে। কি অপার করুণা।
আরো খুঁটিয়ে দেখলে যীশুর মর্মরে তৈরি হাতের চামড়ার তলায় শিরা উপশিরা গুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়! তার হাতের তালুতে পেরেকের ক্ষতটাও কি বাঙ্ময়! এসব সম্ভব করতে মাইকেলেঞ্জেলোকে অনেক সময় তার নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্রপাতি নিজেকেই বানিয়ে নিতে হয়েছে। সঠিক মর্মরের খোঁজে খনিতে শ্রমিকদের সঙ্গীও হয়েছেন।
এত মমতায় যে ভাস্কর্য তৈরি করছিলেন তিনি, সেই পিয়েতাই তার একমাত্র কাজ যাতে নিজের স্বাক্ষর করেছিলেন শিল্পী, অথচ সেই পিয়েতাকেই ১৯৭২ সালে এক বদ্ধ উন্মাদ হাতুড়ি দিয়ে ১২বার আঘাত করে। একমাত্র মানসিক স্থিতি-হীন কারো পক্ষেই এমন অকল্পনীয় কিছু করা সম্ভব, সেই যুক্তিতে লাজিও টথ নামের সেই লোকের কোন সাজাও হয়নি, কিন্তু অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়ে গেছে পিয়েতার। তবু যা আছে তাই আমার চেতনাকে নাড়া দিয়ে গেছে।
প্যারিসে দেখেছিলাম আরেক পাথরে লেখা কবিতা, রোঁদার চুম্বন, আর দেখেছি মাইকেলের করুণা। হয়ত এমন আরো কিছু রয়ে গেছে যা দেখা হয়নি বা হবেও না কখনো, কিন্তু যা দেখেছি, তাতেই আমার জীবন পাত্র উছলে উঠেছে! ধন্য আমি।
 সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|