(অ) নিয়মিত কলাম The Placebo Effect সুতপা বড়ুয়া
অতীশের কাছে ওর চেম্বারে আসা রোগীদের নানান মজার মজার ঘটনা শুনতাম এক সময়ে, অবশ্যই তাদের নাম ধাম গোপন রেখেই। ওর চেম্বারটা যেহেতু চট্টগ্রাম বিমান বন্দরের কাছে পতেঙ্গা বলে একটা শহরতলিতে ছিল, তাই সেখানকার বেশির ভাগ রুগীই হয় নেভি, এয়ার ফোর্স, রিফাইনারি, CEPZ (Chittagong Export Processing Zone) এর কর্মী বা কর্মকর্তা অথবা স্থানীয় সাধারণ মানুষ, যাদের অনেকেরই পুঁথিগত বিদ্যের বা অর্থেরও অভাব ছিল। তেমনি এক রুগীকে অতীশ যখন কোনোরকম daignostic টেস্ট না লিখে, দামি দামি একগাদা ওষুধের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অল্প কিছু সাধারণ ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছিলো, সেই রুগী নাকি যারপরনাই হতাশ হয়ে ওকে বলছিলো, “আঁ-রে এক খান সুঁইও ন মারিবি না?” মানে 'আমাকে কি একটা ইনজেকশন ও দিবি না?' (বলা বাহুল্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় আপনি/আজ্ঞের চলন নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে তারা খুবই সাম্যবাদী, প্রায় সবাইকেই একাধারে তুই বা নেহাত চন্দ্রবিন্দু বসিয়ে কিছুটা সম্মান দেখিয়ে 'তুঁই’ বলতেই অভ্যস্ত)। অর্থাৎ আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে একটা ইনজেকশন ও না দিলে আর কেমন ডাক্তার, আর কিসেরই বা ছাই চিকিৎসা!
অশিক্ষিত এই সব সহজ সরল রুগীদের মনোভাব বুঝে অনেকেই গাদা গাদা ওষুধ আর দামী দামী টেস্ট লিখে দিতেন, তাতে রুগীও খুশি, ডাক্তার ও! তবে যেটা বলতে এই সাত কাহন লেখা, তা হল ওই অপ্রয়োজনীয় বা অনাবশ্যক ইনজেকশন বা ওষুধপত্র কিন্তু অনেক সময় ভালোই ফল দিতো, কারণ রোগী তাতে সন্তুষ্ট হতো যে ডাক্তার সাহেব তার অসুখটাকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাকে অনেক বড় বড় ওষুধ দিয়েছেন, অতএব ব্যারাম ভালো না হয়ে যাবে কৈ ?!?! কথায় বলে না, 'বিশ্বাসে মিলে বস্তু, তর্কে বহুদূর?' ডাক্তারের ব্যবহার, তার কথা-বার্তা, সব কিছুই কিন্তু রুগীর মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যেহেতু সে হয়তো শারীরিক ভাবে খুব নাজুক অবস্থায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়, তাই যখন কোনো ডাক্তার একটু সহমর্মিতার সঙ্গে তাঁর কথাগুলো শোনেন, বা পরামর্শ দেন, রোগী কিন্তু তাতেই অনেকটা ভালো বোধ করে।
এতক্ষণ যা বললাম, কোনোটাই আমাদের অজানা বা নতুন কথা নয়, তবে বেশ কয়েক বছর ধরে যে পাশ্চাত্যের ডাক্তারেরা 'placebo' নামক এক ধরণের 'মিছি মিছি' ওষুধ দিয়ে আশ্চর্য রকম সুফল পাচ্ছেন, তা জানেন কি? প্লাসিবো মানে এমন ওষুধ, যাতে ঔষধি কোনো গুন নেই, কিন্তু তা খেয়েও অনেক রুগীকে উপকার পেতে দেখা গেছে! এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে, এবং সবাইকে কিছুটা বিমূঢ় করে দিয়েই প্লাসিবো তার স্ব-মহিমায় ভাস্বর। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভালো ওষুধ মনে করে প্লাসিবো খেয়ে যেমন রুগীরা সুফল পাচ্ছেন, ঠিক তেমনি সত্যিকারের কোনো ভালো ওষুধ রুগীকে দিয়েও যদি তাকে তা না জানানো হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই রুগী তার সুফল টুকু লক্ষ্য করে না! শরীরের ওপর মনের যে প্রচণ্ড প্রভাব আছে, সেটা আমরা অনেকেই জানি, মানি। অনেকে হয়ত এও জানি যে শরীরের কোন কোন রোগের উৎপত্তি পুরোটাই মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেসব নিয়ে psycho somatic disorder বা মনো-দৈহিক বৈকল্য বলে আলাদা একটা বিষয়ই রয়েছে!
সঙ্গত ভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে মনের দরুন যদি শরীর রোগাক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে, তাহলে মনের প্রভাব খাটিয়ে শরীরকে রোগমুক্তই বা করা যাবে না কেন? সেই ভাবনা থেকেই placeboর উৎপত্তি আর তাই দিয়ে চিকিৎসাও চলছে এন্তার, তবে আমার জানা মতে এই ‘মিছি মিছি ওষুধ’ খোলা বাজারে বিক্রি হয় না, বরং trial চিকিৎসাতেই placebo ব্যবহার করার কথা শোনা গেছে। অতএব এখনই আপনার medicine cabinet এর নিরীহ ওষুধগুলোর দিকে অমন খুন খারাবী দৃষ্টি না দিলেও চলবে। এ বেচারারা এখনো খেটে খাওয়া, কর্মজীবী ওষুধ, যা আপনি খাসদিলে খেলে কাজ হবে বলেই মনে হয়!
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|