(অ) নিয়মিত কলাম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সুতপা বড়ুয়া
'আমাদের সময়টা কত ভাল ছিল! আমরা বড়দের মান্য করতাম, তাদের বেঁধে দেওয়া সময় সূচি ধরে খেলা ধুলো করেছি, ঘরে ফিরেছি, পড়তে বসেছি, আর এযুগে? এযুগের ছেলে মেয়েদের কথা না বলাই ভালো!'.... খুব পরিচিত মনে হচ্ছে না কথাগুলো? আসলে প্রত্যেক প্রজন্মই তার পরবর্তী প্রজন্ম কে এধরণেরই কিছু না কিছু বলে আসছে। আমাদের গুরুজনেরাও আমাদের বলেছেন, তাদেরকে বলেছেন তাদের মুরুব্বিরা, আবার আমরাও বলি আমাদের ছেলে মেয়েদের। এবং এই ব্যাপারটা চলতেই থাকবে কারণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে থেকে যায় Generation Gap!
তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে Generation Gap এর সবচেয়ে বড় দিক যেটা আমার চোখে পড়ছে, সেটা হচ্ছে তাদের প্রযুক্তি মুখিনতা। ২০১৫ এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীরা গড়ে প্রতিদিন ৮৫ বার তাদের মোবাইল ফোন চেক করে, আর অন্তত ৫ ঘণ্টা তাদের স্মার্টফোনে ব্যয় করে! এখন স্মার্ট ফোন আমাদের কতটুকু স্মার্ট করলো, নাকি এর পরিণামে আমরা শেষ পর্যন্ত বিবর্তনের ধারায় ছোট মাথা, বড় পেট এবং পা হীন, খাটো খাটো আঙ্গুল সর্বস্ব এক কিম্ভুত প্রাণীতে পরিণত হব, কে জানে? বিবর্তনের ধারায় গত ১৫০ বছরে আমাদের দৈর্ঘ্যে গড়ে ১০ সেন্টিমিটার যোগ হয়েছে, আর গত ৬৫ বছরেই আমাদের গড় আয়ু আগের চাইতে ২০ বছর বেড়েছে, এবং এ সবই হয়েছে প্রয়োজনের খাতিরে। তাই যদি হয়, তাহলে কিন্তু ভবিষ্যতের মনুষ্যরা দেখতে খুব একটা মনোহর হওয়ার কথা নয়! মাথার কাজ বেড়ে যাওয়ায় হয় তাদের মাথা আয়তনে বেড়ে নিদেন পক্ষে ফুটবলের মত তো হবেই, নয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌরাত্ম্যে সেটা সঙ্কুচিত হয়ে কমলা বা আপেলের মত হবে! হাটা চলার প্রয়োজন কমে যাওয়ায় পা খসে পরে গায়ের থেকে সরাসরি আঙ্গুল বের হয় যদি? মানে আজকাল তো বেশির ভাগ কাজ আঙুলে বোতাম চেপেই সেরে ফেলা যায়, তাই না?
যাক গে, ও যতদিন না হচ্ছে, আমি অন্তত বাপু সেজে গুঁজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার ছবি, ভিডিও, গান, কবিতা এসব দিতেই থাকব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে 'রসাতল বাদীরা' যদিও যথেষ্ট সরব, কিন্তু আমিও বাপের বেটি। বলুন কি বলবেন, আমিও তার জবাব দিতে প্রস্তুত! আচ্ছা, হাসি মস্করা বাদ দিয়ে যদি গভীর ভাবে চিন্তা করি, তবে সবকিছুর মতোই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও বেশ কিছু ভাল দিক আছে, আবার মন্দ দিকও আছে। আমাদের দেখতে হবে আমরা কিভাবে ব্যাপারটাকে ব্যবহার করছি। মনে পড়ছে দেশে থাকতে পাবলিক বাস এর ভেতর লেখা থাকতো 'ব্যবহারে বংশের পরিচয়'! সেই ব্যবহার আর এই ব্যবহার যদিও এক নয়, কিন্তু রোল মডেল হিসেবে আমাদের (মা বাবাদের) ও একটা মস্ত বড় দায়িত্ব আছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি। আর তাই আমরা নিজেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কিভাবে, কতক্ষণ ব্যবহার করছি এবং আমাদের সন্তানদেরই বা কতটুকু screen-time বা পর্দা-সময় ব্যবহারে অভ্যস্ত করে ফেলছি, সেগুলো অনেক সময় তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
একদম সাধারণ বুদ্ধিতেই তো বোঝা যায় যে অত্যধিক পর্দা-সময়ে অভ্যস্ত শিশু কিশোরের স্বাস্থ্যের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। সে হয়ে পড়বে মোটা, কারণ শৈশবের দৌরাত্ম্যের বদলে সে যে সারাক্ষণ এক জায়গায় স্থবির হয়ে বসে থাকতে থাকতে 'কাউচ পটেটো' হয়ে পড়ছে, আর ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে বের হওয়া blue light বা নীল আলো শুধুমাত্র তার ঘুমেরই ব্যাঘাত না, তাকে এমনকি পুরোপুরি দৃষ্টিহীন করে ফেলতে পারে। Why is blue light dangerous লিখে একটু গুগল সার্চ করলেই জেনে যাবেন বিস্তারিত। টিনএজারদের ওপরও এর প্রভাব কম নয়; দেখা গেছে এই অত্যধিক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র নির্ভরতা থেকে তারা বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন এর মতো কঠিন মনো-ব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে পারে! তাদের মানসিক বিকাশেও খারাপ প্রভাব প্রমাণিত, তবুও আমরা কি নির্বিচারে তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি তাদের নিজেদেরই অ-সুখের উপাদান!
এর সব কটাই আমাদের জন্যও প্রযোজ্য, যদিও শিশু কিশোরদের তুলনায় আমাদের ক্ষতিটা হবে দেরিতে, কিন্তু ক্ষতি হবেই। দিনে যেখানে আমরা অনেক বড়রাই কাজ এবং বিনোদনের জন্য গড়ে ১১ ঘণ্টা পর্দায় চোখ রেখে থাকি, শুধুমাত্র দৈনিক ২ ঘণ্টাই আমাদের ওজন বৃদ্ধি, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগ এর মত মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা যদি কিছুক্ষণ সরিয়েও রাখি, যে সময়টা আমরা অপচয় করছি রোজ, সেটাতো আর ফিরে পাবো না। ফেসবুকের মত যোগাযোগ মাধ্যমে যদিও সবাই শুধু সুখী, এবং ঝলমলে ছবিগুলোই আপলোড করি, কিন্তু এর থেকে পরোক্ষ ভাবে নিজের ওপর বিশ্বাসের ঘাটতি, হিংসা, সন্দেহ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর পরিণতি পর্যন্তও গড়াতে পারে।
অনেক নেগেটিভ কথাবার্তা তো হল, শেষ করার আগে কয়েকটা ভাল দিকের কথা বলি। সামাজিক মাধ্যমের বদৌলতে নি:সঙ্গ বয়স্করা, যারা দূরত্বে বা অন্যান্য কারণে আপনজনদের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তারা আবার আপনজনদের 'কাছাকাছি' আসতে পারছেন, হোক না তা ডিজিটালি। যেকোনো 'বার্তা' আজ মুহূর্তের মধ্যে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ইন্টারনেট, আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে আপৎকালীন সতর্কতামূলক বার্তাও খুব দ্রুততার সঙ্গে লক্ষ্য গোষ্ঠী বা টার্গেট গ্রুপের কাছে তা পৌঁছানো যায়। মানুষ সামাজিক প্রাণী। প্রবাস জীবনে বহু অভিবাসী নারী সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হন। তাদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ত্রাণকর্তার ভূমিকায় উত্তীর্ণ হতে পারে। এসব কারণেই মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে অনেক ইতিবাচক প্রভাব রাখার ক্ষমতা রাখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা যদি পরিমিতি বোধ বজায় রেখে, কাউকে আঘাত না করে এর ভালো দিকগুলো ব্যবহার করি, তবেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে আমাদের সার্থকতা! জয়তু মানুষ!
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|