ছোটবেলার স্মৃতি (৪র্থ পর্ব) সুতপা বড়ুয়া
আগের পর্ব
এই পরিবারটির সঙ্গে আমরা তাদের বাড়িতে ছিলাম মাত্র কয়েক মাস বা বড় জোর হয়ত একটা বছর, কিন্তু মনের মণিকোঠায় তারা আমাদের অনেক কাছের মানুষ হয়ে আছে আজও । যতদিন আমরা ইন্ডিয়ায় ছিলাম, তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। শেষবার গিয়ে দেখি দাদুর টেবিল এর ওপর বুড়ো দার মস্ত বড় একটা ছবিতে মালা পরানো। শুনলাম, আমরা চলে যাওয়ার পর ওই mezzanine floor টাতে বুড়ো দা ঘাঁটি গেঁড়ে ছিল এবং একদিন ওই চার পাঁচটা মাত্র সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই পড়ে গিয়ে মাথায় চোট লাগে তার, শুনে মনে পড়ল, সন্ধ্যে বেলা যখন দাদুর কাছে পড়তে যেতাম, তখন দেখেছি বুড়ো দা কোনদিনই দু তিন সিঁড়ি না টপকে সিঁড়ি বাইত না আর এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই আর বুড়ো হওয়া হলো না কোনদিন বুড়ো দার। আজীবন সে চিরকিশোরই রয়ে গেল।
ইতিমধ্যে বাবার চা বাগানের সবচেয়ে কাছের শহর শিলচর এ হলি ক্রস নামে একটা Missionary স্কুল চালু হয়ে গেছে, আর তাই লেক গার্ডেন্স এর পাট চুকিয়ে মা'র সঙ্গে ফিরে এলাম West Jalinga Tea Estate এ, বাবার কাজের জায়গায়। আজ ভাবি, অতটুকু ওই পুঁচকে মেয়ের লেখাপড়ার জন্য কত কান্ডই না করেছিলেন আমার বাবা, মা। কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন ওঁরা। আর ওঁরা সেটা করেছিলেন বলেই আমি হয়ে উঠেছি এই আজকের 'আমি'। আমার মা, বাবার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।
যাক, লন্ডন এর হলি ট্রিনিটি, দার্জিলিং এর St Paul, চন্দন নগর এর St Joseph, কবিগুরুর শান্তিনিকেতন, কলকাতার সাউথ পয়েন্ট পেরিয়ে অবশেষে শিলচর এর হলি ক্রস এ যখন ভর্তি হতে গেলাম, বয়েস আমার আট আর নয় এর মাঝামাঝি। Principal ব্রাদার জেরার্ড খানিকক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বার্তা বলে সরাসরি ভর্তি করে নিলেন ক্লাস ফাইভে। মস্ত একটা সমস্যা কিন্তু তখনো রয়ে গেছে, চা বাগান থেকে স্কুলের দূরত্ব এবং যাতায়াতের অসুবিধের দরুন সেখান থেকে এসে যেয়ে স্কুল করা সম্ভব না। সেই সমস্যারও সমাধান বের হলো। অন্য আরেকটা চাবাগানের ম্যানেজার অশ্বিনী কুমার সেন তার কিছুদিন আগে অসুস্থ হয়ে চাকরী থেকে অবসর নিয়ে শিলচর এ তার ঘরে ফিরে গেছেন। আমার বাবা আর সেন দাদু ছাড়া সে সময় আর কোনো বাঙালি Tea Planter তখন আমার চোখে পড়ে নি, আর তাই ওনাদের সঙ্গে আমাদের খুব যাওয়া আসা ছিল। বাবা দাদুকে সাজেস্ট করেন আমি যেন পেয়িং গেস্ট এর মত তাঁর বাড়িতে থাকি, আর প্রতি weekend এ স্কুলের পর বাবা এসে আমাকে West Jalinga নিয়ে যাবেন।
এই প্রস্তাব দাদু সহজে মেনে নেন নি আমি নিশ্চিত। আমাদের সমাজে লেখাপড়া শেখার জন্য একটা ছোট শিশু তাঁদের বাড়িতে থাকবে, তার জন্যে টাকা নেওয়ার মত মানসিক দৈন্যও তাঁদের ছিল না, কিন্তু সাত জন ছেলে মেয়ে নিয়ে ওনার আর্থিক অবস্থাও নিশ্চই খুব সচ্ছল ছিল না। টাকা পয়সা দেওয়া নেওয়ার কি ব্যবস্থা হয়েছিল, তা আমার জানার মত বয়েস ছিল না, সেটা জানার প্রয়োজনও আমার হয় নি, কিন্তু মাঝখান থেকে একা ঘরের একেশ্বরী থেকে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, এক দঙ্গল মামা মাসির মাঝে আমি আবারো সবার আদরের ধন। সপ্তাহে পাঁচ টা দিন দাদু, দিদা, মামা মাসীদের সঙ্গে মহা আনন্দে কাটতো আমার। পাড়ায় বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধবও জুটে গেল। সে যে কি আনন্দের দিন।
ওই সময়ে দুটো বড় বড় ঘটনা প্রায় একই সময় ঘটে। একটা তো পুরো পৃথিবী কাঁপিয়ে ছিল। Apollo 11 চাঁদে প্রথম মানুষ নিয়ে নামলো July মাসে, আর তার দু মাস পরেই আমার একমাত্র ছোট বোন এর জন্ম হলো। আমার জন্যে সেটার গুরুত্ব প্রথম ঘটনার চাইতে কিছুমাত্র কম নয়। এতদিন একমাত্র সন্তান ছিলাম, এখন একটা ছোট বোন পেয়ে কি যে আনন্দ হলো, বলে বোঝাতে পারব না। আমাদের কোনো ভাই নেই. আমরা শুধুই দুটো বোন। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার মা'র মনে কিছুটা দুঃখ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বাবা সবসময় বলতেন, আমার দুটো মেয়ে, আমি তাতেই ভীষণ খুশি। 'আহা, আপনাদের ছেলে নেই! ' বলে কেউ সমবেদনা জানাতে চাইলে বলতেন, 'sons are liabilities, daughters are assets.' নিজের ছেলে নেই বলে 'আঙ্গুর ফল টক' জাতীয় কথাবার্তা সেটা ছিল না। বাবা আসলেই আমাদের assets মনে করতেন এবং সুযোগ পেলেই তাঁর দুই মেয়ের প্রশংসা করে আত্মীয় স্বজনদের কানের পোকা নাড়িয়ে দিতেন।
ক্রমশ:
সুতপা বড়ুয়া, সিডনী প্রবাসী ইংরেজি শিক্ষিকা (SWSI TAFE) sutapa.barua@live.com
আগের পর্ব
|