ছোটবেলার স্মৃতি (৩য় পর্ব) সুতপা বড়ুয়া
আগের পর্ব পরের পর্ব
যদিও ছোটবেলাতেই মা বাবার সঙ্গে UK তে কয়েক বছর থেকে, সেখান থেকে জাহাজে করে ফিরে এসে ৫ বছর বয়সেই আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ পুষ্ট, তবু, বন্ধু বান্ধব, ভাই বোন ছাড়া চা বাগানের দিন গুলো বড্ড নি:সঙ্গতায় ভরা ছিল। সেই একাকীত্ব কাটাতে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতাম, অজস্র গল্পের বই পড়তাম আর আমার মা'র সবজি বাগানের মালীদের মাঝে ঘুরে ঘুরে নিজেকে প্রিন্সেস আর ওদেরকে আমার প্রজা ভেবে ভেবে গল্প বানাতাম। এর ভেতরেই কলকাতার নামকরা South Point স্কুলেও একবার ভর্তি করা হয়েছিল আমাকে এবং এবার আমার লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে আর হোস্টেল এর negative অভিজ্ঞতার দরুন, মাকেও এবার আমার সঙ্গে কলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। আমার বড় পিসী প্রজ্ঞা পারমিতা বড়ুয়ার বাড়ির কাছেই Lake Gardens এ Justice লোধ এর বাড়ির Mezzanine ফ্লোর এ আমাদের স্থিতু করে দিয়ে গেলেন বাবা।
নামকরা স্কুল, তাই লেখাপড়া নিশ্চয়ই কিছু শিখছিলাম, কিন্তু আমার কেবল মনে পড়ে ওই স্কুলে আমাদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ, গান, artcrafts ও করানো হত আর ঋতু-পল্লব বলে একটি ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। নামটা এত সুন্দর যে এত বছর পরেও, তার আর কিছুই মনে না পড়লেও, নামটা ভুলিনি।
যে বাড়িতে আমরা থাকতাম, সেটা ছিল BBC তে বাংলা খবর পাঠক শ্যামল লোধ দের বাড়ি। পুরনো দিনের লোকজনের নিশ্চয়ই শ্যামল লোধের কথা মনে আছে? সে যাই হোক, সে বাড়ির প্রতিটি সদস্য কে নিয়ে আলাদা আলাদা ছোট গল্প লেখা যায়, এতটাই মজার মানুষ ছিলেন তারা সবাই। আপাতত সেখানে থাকতেন বাড়ির মালিক, শ্যামল লোধের বাবা Justice লোধ, ওনার স্ত্রী আর তাদের দুই মেয়ে মনা, বুলা আর ছোট ছেলে 'বুড়ো'
বয়েসে অনেক ছোট হলেও আমার মার সঙ্গে মনা, বুলাদি'র ভীষণ ভাব হয়ে গেল আর দাদু দিদার চোখের মণি হলাম আমি। সেকারণেই বুড়ো দা আমায় দু চক্ষে দেখতে পারত না। এখন ভাবি, মনা বুলাদি সম্ভবত মাকে বৌদি ডাকত, তাহলে আমার ওদেরকে পিসী ডাকা উচিত ছিল, তবেই ওদের মা বাবাকে দাদু, দিদা ডাকা যায়, কিন্তু for some reason, I skipped a generation and no one corrected me.
বেশির ভাগ দিন ই আমার আর মার নিজের জন্য বেশি কিছু রাঁধতে ইচ্ছে করত না আর করার দরকারও বিশেষ হত না, কারণ ওপরতলা থেকে অবধারিতভাবেই নানারকম সুস্বাদু খাবার দাবার চলে আসতো। আমার দৈনন্দিন পড়াশোনার ভার সন্ধেবেলা বুড়ো দা'র ওপর দিয়ে মা বেশ জমিয়ে মনা, বুলাদিদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। আমি বেচারা দাদুর কড়া নজরদারিতে আর বুড়ো দা'র খবরদারিতে জেরবার হতাম। মন পরে থাকত পাশের ঘরে, যেখান থেকে মজার মজার কথা আর হাসাহাসি ভেসে আসতো।
সিনেমার বাইরে ওই বাড়িতেই প্রথম দেখেছি বাঙালি ঘরের কোনো মেয়ে কে piano শিখতে/বাজাতে বা miniatures collect করতে। খাঁচার পোষা ময়না (অথবা টিয়া?)র মুখে literally 'রাধে কৃষ্ণ' বুলি ও ওখানেই শুনেছি, আর অবাক হয়ে দেখেছি, কত যত্নে খাঁচার পাখিটাকে নাওয়াতেন খাওয়াতেন দিদা। নিজের পোড়া কপালের ভোগান্তির কথা শোনার সমব্যাথিও ছিল ওই পাখিই।
দিদা ছিলেন কোনো সম্ভ্রান্ত ঘটি ঘরের মেয়ে আর দাদু ছিলেন এক্কেবারে বাঙ্গাল। দিদা যে এককালে ডাকসাইটে রূপবতী ছিলেন সেটা তার তখনকার পৃথুলা শরীরের ওপর সদা বিরক্ত মুখ খানা দেখলে তখনো বোঝা যেত। গায়ের রং মাখনের মত, হাত ভর্তি শাখা, পলা আর গোছা গোছা সোনার চুরি, বড় পাড়ের শাড়ি একপেচে করে পরা, কিন্তু মাথায় সারাক্ষণ একটা গামছা কষে বাধা! চব্বিশ ঘণ্টাই মাথা ব্যথায় ভুগতেন, তাই অমন বেমানান এক খানা ব্যাপার। সারাদিনই দিদার নিজের রুমের পালঙ্কের ওপর পা ছড়িয়ে বসে বসেই সংসার চালাতে দেখতাম আর মুখে সারাক্ষণই দাদুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ওনার বাবা, মা ওনার কি সর্বনাশটাই না করেছেন, সেই ফিরিস্তি। পাশে রাখা পানের বাটা থেকে অনবরত পান খাচ্ছেন আর পিকদানিতে পিক ফেলছেন.... আপনারা একবার চিন্তা করে দেখুন, আমার কাছে সে এক মজার জগৎ।
দাদু এক কালে কলকাতা হাই কোর্টের জাস্টিস ছিলেন এবং সেই সুবাদেই সম্ভবত: অমন সম্ভ্রান্ত ঘরের রূপবতীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, নয়তো তাঁর যা চেহারা ছিল, তা একমাত্র নিজের মা ছাড়া আর কারো পছন্দ হবার মত ছিল না। গায়ের রং মিশমিশে কালো, গলায় একটা তুলসীর মালা পেঁচানো, সাদা চুলগুলো অযত্ন অবহেলার প্রতিবাদে সটান খাড়া খাড়া, হাঁটুর ওপর আট হাতি একটা ধুতি আর সুতির একটা হাতকাটা ফতুয়া, এই ছিল তার সব সময়ের পোশাক। ততদিনে তিনি retire করেছেন, তাই দিনের বেশির ভাগ সময় তার বাগানেই কাটে। এমনই একদিন বুড়োদা আর তার দলবল কাছেই ফুটবল খেলতে খেলতে বল গড়িয়ে এসে পড়ে দাদুর বাগানে, বুড়োদা কিছু বলতে পারার আগেই এক ছেলে এসে হাঁক পেরেছে, এই মালী, বলটা একটু দাও তো!! দাদুর মুখ থেকে তখন যা সব বাছাই করা শব্দ বেরিয়েছিল, তা আর লিখলাম না।
রইলো বাকি মনা, বুলাদি। দুজনেই শ্যামলা, মার মত টকটকে গায়ের রং তাদের ছিল না বটে, কিন্তু মনাদি যে কি অপরূপ মায়াবতী দেখতে! Very feminine, elegant and stylish. আর বুলাদি এক্কেবারে তার উল্টো। বেশ লম্বা চওড়া, বিশাল বড় একটা নাক, অবাধ্য ঝাঁকড়া চুলে সারাক্ষণই হা হা হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে আর মনে যা আসছে তাই বলছে। ক্লাসের দিদিমণিদের নকল করায় তার জুরি মেলা ভার ছিল। দুজনের কাছেই আমি অনেক আদর পেয়েছি।
ক্রমশ:
সুতপা বড়ুয়া, সিডনী প্রবাসী ইংরেজি শিক্ষিকা (SWSI TAFE) sutapa.barua@live.com
আগের পর্ব পরের পর্ব
|