bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ছোটবেলার স্মৃতি (১ম পর্ব) / সুতপা বড়ুয়া



আগের অংশ


সারা বাড়িতে হৈ হৈ কাণ্ড, রৈ রৈ ব্যাপার! বাড়ির অল্পবয়সী মহিলারা সকাল থেকে সর হলুদ মেখে রিঠে* ভিজিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্নানে যাওয়ার, কারণ স্নানার্থীর তুলনায় স্নান-ঘরের সংখ্যা নেহাতই অপ্রতুল! (*রিঠে হচ্ছে শ্যাম্পুর বিকল্প ঘরোয়া এক ভেষজ যা একরকম বিচ্ছিরি চেহারার শুকনো একটা ফল, যেটাকে হালকা গরম জলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে হাত দিয়ে চটকালে প্রচুর ফেনা হয়, এবং যা দিয়ে তখন চুল ধোয়া হতো)। ওদিকে মাঝের কামরায় ঘটে চলেছে আরেক নীরব নাটিকা, বিয়েবাড়িতে পড়বেন বলে রুমালে বেঁধে যে গয়নার পুটলিটা এনেছিলেন রাঙা-মামী, তা কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! অনেক খোজার পরও কোথাও না পেয়ে মামী যখন হতবাক, তখনি কে যেন সিঁড়ির কোন ফেলে দেওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা ঘর ঝাঁট দেওয়া ময়লার মধ্যে আবিষ্কার করে সেই মহার্ঘ্য পুটুলি! কিছুই খোয়া যায় নি, সবই ঠিকঠাক, তবে কেমন করে সেটা ওখানে গেলো, সে প্রশ্ন আর কেউ তোলেনি, যাহোক, প্রাণ বাঁচলো রাঙা-মামীর আর মান বাঁচলো গৃহকর্তার!

সব দিক সামলে বিকেল থেকেই মা, মাসি, মামীরা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাড়িতে সাকুল্যে যে দু তিনটে ড্রেসিং টেবিল আছে, তাতে এর ঘাড়ের ওপর দিয়ে, কি তার কানের পাশ ঘেঁষে, নিজের চেহারাটা যতটা সম্ভব ‘বিয়েবাড়ি উপযুক্ত’ করে তুলতে। তার মধ্যেই অবশ্য একে অন্যকে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দেওয়া বা সেফটি পিন লাগিয়ে দেওয়ার মাঝেই লেটেস্ট PNPC (যা কিনা পর নিন্দা,পরচর্চার সাংকেতিক শব্দ) সমানে চলছে। সেটা কাউকে নিয়ে কানাকানি করার জন্য যতটা, তার চাইতেও বেশি ‘হালফিল’ (up to date) থাকার জন্য। সবকিছুরই কিন্তু ভারী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কোথাও কোনো রাগ,অভিমান, কান্নাকাটি নেই, সবাই হাসিমুখে একে অন্যকে সাহায্য করছে, আর তাতে ছোটরাও বাদ যাচ্ছে না। মাথার ফিতের ফুল বাঁধাটা মনমতো হচ্ছে না? কোই বাত নেহি, সোনালী মাসির কাছে চলে যাও, সবরকম আবদার মেটাতে তার কোনো জুড়ি মেলা ভার। একটুখানি লিপস্টিক দিতে ইচ্ছে করছে? মা’র কাছে গেলে বকা খাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি , তাই চুপি চুপি রাঙা মামীকে জানালেই হল, মা’র চোখ বাঁচিয়ে একটুখানি হালকা রঙের ছোঁয়া পাওয়া যাবেই! আমরা ঐটুকুতেই মহা খুশি।

ওদিকে ছেলেরাও কম যান না, দাদুরা যদিও ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরেই সন্তুষ্ট, যদিও তা যে হতো তরঙ্গের সবচে দামি শান্তিপুরী জরি পাড় ধুতিটাই, সেটা বলাই বাহুল্য, কিন্তু আসল পাঁয়তারা চলত মামা আর মেসোদের দিকে। সেখানে দেখতাম সবার পাঞ্জাবির হাত দুটোকে একরকম বাদামি রঙের শুকনো বিচি দিয়ে কি এক বিশেষ উপায়ে সেজ-মামা (ভুনটি) মিহি কুঁচি করে দিচ্ছেন! পরে জেনেছি সেটাকেই বোলত ‘গিলে করা। আর ধুতি পড়ানোয় ওস্তাদ মানা হত ফুল-মেসোকে, ফলে সে বেচারা সবার ধুতি ঠিক করতে করতে অনেক সময় নিজেরটাই যুতসই মত পড়তে পারতেন না। বলতে ভুলে গেছি বিয়ের দিন ভোরের আলো ফুটবার আগেই সবাইকে ঘুম ভাঙিয়ে হাজির করা হত ‘বড় ঘরে’, যেখানে হবু বর বা কনেকে দই, চিড়ে আর আরো কি কি সব সুস্বাদু জিনিস মেখে খাওয়ানো হত। বিয়ের আগে সারাদিন আর কিছুই খাওয়া যাবে না তাই এই ‘দধি মঙ্গল’ ছিল খুবই উপকারী এবং গুরুত্বপূর্ণ। সেই মনোলোভা বস্তুটির ভাগ আমরা ছোটরাও পেতাম এক গ্রাস এক গ্রাস আর সে জিনিস যে না খেয়েছে, তাকে বলে বোঝাতে পারব না এই মাটির পৃথিবীতে অমন স্বর্গীয় স্বাদ কিভাবে সম্ভব। একটা বিয়েকে ঘিরে আরো কত যে মেয়েলি আচার আছে, সে লিখতে গেলে আর শেষ হবে না , তাই ওদিকে আর যাচ্ছি না, তবে, বর বা কনে কে স্নান করানোর জন্য কোন একজোড়া সুখী দম্পতিকে আনতে হত পাঁচ পুকুরের জল, আর বেয়াই বাড়ি পাঠানোর তত্ব সাজাবার জন্য বিশেষ কদর ছিল পাড়ার বড় জেঠিমার। উনি যেভাবে মস্ত বড় একটা রুইমাছকে ‘সিঁদুর’ শাড়ি’ পরিয়ে ‘সুন্দরী’ করে তুলতেন, তাতে বলতেই হয় মহিলার ‘এলেম’ ছিল বৈকি!

এইসব দেখতে দেখতে সারাটা দিন টগবগ করে যেন ফুটতাম আর তারই ফলে আসল বিয়ের লগ্ন পর্যন্ত প্রায় কখনই জেগে থাকতে পারতাম না। জেগে উঠে দেখতাম, কাল সন্ধ্যে পর্যন্ত যে মাসিকে কনের সাজে রানীর মতো এঘর ওঘর করতে দেখেছি, আজ সারাবাড়ি খুঁজেও তাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না, অথবা প্রিয় ফুল-মামার পাশে পাশে দেখা যাচ্ছে আস্ত নতুন একজন ফুল-মামী! আবছা মনে পরে নতুন বৌ ঘরে ঢোকার আগে কয়লার উনুনে এমন ভাবে দুধের পাত্র জ্বাল দেওয়া হত যেন নতুন বৌ ঢোকার সাথে সাথে দুধ উথলে পড়ে। বৈঠকখানা ঘরের সদর দরজার থেকে ভেতরের দিকে লম্বা করে বিছানো হতো একটা সাদা চাদর আর বিরাট একটা পাথরের বরাতে দুধ আর আলতা মিশিয়ে রাখার হত দরজার কাছেই। নতুন বৌ সেই গোলাপি তরলে পা ডুবিয়ে তারপর সাদা চাদরে তার লক্ষ্মীমন্ত পায়ের ছাপ ফেলে নতুন সংসারে ঢুকতো। আরো মনে পড়ছে বাড়ির উঠোনে লাইট টাইট লাগিয়ে, আলপনা দিয়ে সুন্দর করে একটা জায়গা তৈরি করা হত, যেখানে আলপনা আঁকা পিঁড়িতে নতুন বৌকে দাঁড় করিয়ে মুখে আর কানে মধু দেওয়া হত আর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত বাজারের ব্যাগের একটা ক্ষুদে সংস্করণ, যা কিনা সালঙ্কারা নতুন বৌয়ের হাতে খুবই বেমানান লাগতো। পরে শুনে জেনেছি এসবের তাৎপর্য।

বৌ এর আগমনে দুধ উৎরানো মানে সংসার সবসময় ভর ভরন্ত, উপচে পড়বে, কোনো অভাব থাকবে না। দুধে আলতায় রাঙানো পায়ের ছাপ ছিল লক্ষ্মীর পায়ের চিহ্ন আর মুখে কানে মধু দেওয়া হত যাতে বৌ যা শোনে, যা বলে, তাই মধুর হয়! সবচে খারাপ লেগেছিলো জেনে যে হাতে যে ছোট বাজারের ব্যাগ টা ধরিয়ে দেওয়া হতো, তাতে থাকতো একটা ‘ভ্যাদা মাছ’ যাতে বউও অমন ভ্যাদা হয়েই থাকে! আজকাল women’s rights নিয়ে যারা মাথা ঘামান, তারা চাইলে এটা নিয়ে নি:সন্দেহে thesis লিখতে পারেন।
ফিরে আসি আবার আমার গল্পে। পাঠক যদি এতক্ষণে জানতে চান গল্পটা আসলে আমার মামার না মাসির বিয়ের? তাকে দোষ দেব না, শুধু বলব সেটা বড় কথা না, এক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রী মুখ্য নয়, মুখ্য হলো বিয়েকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা এবং আমার শিশু মনে তার পাকা ছাপ। মাসিদের বিয়েতে মনটা কিছুক্ষণ খারাপ থাকলেও মামাদের বিয়েতে এতরকম সব দারুণ দারুণ ঘটনার মাঝে উপরি পাওয়া নতুন মামীকে তখন চোখে হারাতাম। কিছুতেই বুঝতে চাইতাম না সারাদিন গায়ের সঙ্গে লেপটে থেকে, নতুন শাড়ি আর ‘কান্তা’ সেন্ট এর গন্ধ বুকভরে নিতে নিতে মামীর সব ফুটফরমাস খাটলেও রাতের বেলা কেন আমাকে কেউ মামীর সঙ্গে থাকতে দিত না! ভীষণ অভিমান আর চোখের জল চোখে নিয়েই ঘুমাতে যেতাম।

ঘুমের কথা থেকে আরেকটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল, যেটা দিয়ে আমার এবারের লেখাটা শেষ করতে চাই। বিয়ে চুকে বুকে যাওয়ার পর মা, মাসি, মামীরা একদিন নিজেরা নিজেরা সিনেমা দেখাত প্ল্যান করতে লাগলেন। ঘুমের কথা থেকে আরেকটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল, যেটা দিয়ে আমার এবারের লেখাটা শেষ করতে চাই। বিয়ে চুকে বুকে যাওয়ার পর মা, মাসি, মামীরা একদিন নিজেরা নিজেরা সিনেমা দেখাত প্ল্যান করতে লাগলেন। আমরা তো সেটা শুনে বেজায় খুশি, কারণ মা’রা না থাকলে আমরাও ইচ্ছেমতো দাপাদাপি করতে পারব। এছাড়া মামাত ভাই বাপ্পা চুপি চুপি এও জানিয়েছে যে ছাদে সেজদিদার আচারের বয়োমেরা সূর্যস্নান করছে! আমার ভাবছি, মা’রা গেলেই বাঁচি, তখন আর আমাদের পায় কে? কিন্তু মা’রা তো আর সেটা জানেন না, তারা চিন্তিত যে তাদের অভিসন্ধির কথা জেনে যদি আমরাও যেতে চাই, তাহলেই কম্ম কাবার। অবোধ মহিলারা কি করে বুঝবেন ৮-৯ বছরের শিশুদের কাছে উত্তম সুচিত্রার জুটির চাইতে তেঁতুল আর কুলের জুটি অনেক বেশি লোভনীয়।

যাহোক, ফুল-মাসি এসে গম্ভীর মুখে বলল, “এ কদিন অনেক অনিয়ম হয়েছে, আজ যদি সবাই লক্ষী হয়ে দুপুরে ঘুমায় তাহলে বিকেলে পার্ক এর মাঠে খেলতে যাবার সময় আলু-কাবলি খাবার জন্য প্রত্যেকে পাবে আলাদা পয়সা!” পার্কের মাঠের জহরলাল দার আলু কাবলি ছিল আমাদের ছোটদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ, তাই আমাদের আনন্দ আর ধরে না। আমরা হিসেবে কষছি মা’রা বেরিয়ে গেলে হুটোপুটো + আচার চুরি + সন্ধ্যে বেলা আলুকাবলি! উফফ, এযে মেঘ না চাইতেই জল! মহিলারা যায় না কেন?? অবশেষে জোর করে সব কটাকে ফুল মামার শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া নতুন পালঙ্কে গাদাগাদি করে শোয়ানো হল আর মা, মাসিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আমরা ঘুমিয়ে কাদা হবে আর ওরাও নিশ্চিন্তে সিনেমা দেখতে বেরোতে পারবে।

ওদিকে পরবর্তী আকর্ষণের কল্পনায় ঘুম তো তখন দূরে কোথায় বেপাত্তা! মটকা মেরে পড়ে রয়েছি সব কটা বিচ্ছু আর মনে মনে প্রার্থনা করছি আমাদের ঘুমের অভিনয়টা যেন উৎরে যায়। এই যখন অবস্থা, রুপু মাসিকে ঘরে ঢুকে বলতে শুনলাম, “দূর, একটাও ঘুমায় নি। ঘুমালে তো পা নড়তো!” হায়রে অবোধ বালিকা, কি করে বুঝবো যে মাসি চালাকি করে বুঝতে চাচ্ছে আমরা সত্যিই ঘুমিয়েছি কিনা। সান্ত্বনা এটুকুই যে মাসির কথা শুনে আমিই কেবল চোখ বুজে প্রাণপণে বোকার মত পা নাড়াইনি, আমার আরো কয়েকজন ‘তুতো’ ভাইবোন ও পা নাড়িয়ে আমার মত একই ভাবে বোঝাতে চেয়েছিল যে আমরা গভীর ঘুমে মগ্ন! পরবর্তী ঘটনা পাঠক কল্পনা করে নেবেন। এবারের মতো এখানেই আমার গল্প ফুরোল আর II নটে গাছটি মুড়োল II



সুতপা বড়ুয়া, সিডনী প্রবাসী ইংরেজি শিক্ষিকা (SWSI TAFE)
sutapa.barua@live.com



আগের অংশ


পরের পর্ব





Share on Facebook               Home Page             Published on: 2-Dec-2020

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far