ছোটবেলার স্মৃতি (১ম পর্ব) সুতপা বড়ুয়া
শুনেছি বয়েস হলে পুরনো স্মৃতি বেশি মনে পড়ে। বয়েসের কথা বেশি না বলাই ভালো কিন্তু আমার ছোটবেলার স্মৃতি এটি ঘটনাবহুল, যে মনে হয় লিখলে মন্দ হতো না! হয়তোবা কারো ভালো লাগলেও লাগতে পারে।
মায়ের মুখে শোনা , আমার ছোট্টবেলায় যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, তার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের রাস্তায় কোনো ছোট বাচ্চা যেতে দেখলেই আমি নাকি আমার খেলনাগুলো ছুঁড়ে দিতাম। আমার মা’র ধারণা, আমি ওদের সঙ্গে খেলতে চাইতাম বলেই অমনটা করতাম। মা’কে সোনামুখ করে ও বলতে শুনেছি, “অন্য বাচ্চারা যেখানে নিজেদের খেলনা কাউকে দিতে চায়না, সেখানে আমার মেয়ে ওর খেলনা অন্যদেরকে বিলিয়ে দিতো!” হায়রে মায়ের মন! আসলে হয়তো সব ছোট বাচ্চাদের মতোই জানালা বা বারান্দা থেকে খেলনা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াটা আমারও একটা নির্দোষ দুষ্টুমিই ছিল, যা প্রায় সব ছোটরাই কোন না কোন সময় করে অনাবিল আনন্দ পেয়েছে! কিন্তু সব মায়েদের মতোই আমার মা’ও মনে করতে চেয়েছেন তার মেয়ে (বা ছেলে) অন্যদের মত নয়, সে আরো ভালো!! মায়েরা বড্ড একচোখা হয়, তাই না?
যাহোক, আরো দশটা কর্মজীবী মায়ের মতোই আমাকে বাপের বাড়িতে বোনের কাছে জিম্মা রেখে মা সরকারি চাকরি করতে যেতেন, আর দিনের শেষে আবার বুকের ধন করে নিয়ে ঘরে ফিরতেন। মা তো আছেই মায়ের জায়গায় কিন্তু আমার সেই মাসি আজও আমার সবচে’ প্রিয় আত্মীয় আর আমিও যেও অন্যসব ভাগ্নে ভাগ্নিদের মধ্যে একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলাম তার মনে। সেই স্নেহের বাঁধন আজ অটুট। আজকের দিনের কোনো চাইল্ড কেয়ারার বা Aunty সে জায়গা নিতে পারবে কিনা জানিনা।
কিছুদিন পরেই মা বাবার সঙ্গে বিলেত গিয়ে (তখন লন্ডন এর চাইতে বিলেত শব্দটাই বেশি চালু ছিল) সেরকমই এক আন্টির কাছে আমাকে রাখতে গেলে, শুরু শুরুতে কান্না কাটি তো করতামই, শুনেছি এমনকি সেই আন্টিকে বিস্তর চিমটি, খামচিও দিয়েছি! আবার সেরকমই আরেক আন্টির মেয়ে ‘জেনি’ ছিল আমার প্রথম প্রিয় বান্ধবী। মনে আছে আমি আর দশটা বাঙালি বাচ্চার মতো মুখ খুলে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছি দেখে আন্টি আমাকে কি করে মুখ বন্ধ করে চিবোতে হয়, দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আমিও মনোযোগী ছাত্রীর মতো চিবুচ্ছি। কিছুক্ষণ পর উনি খেয়াল করলেন যে সবার খাওয়া হয়ে গেলেও আমার প্লেটের খাবার নড়ছে না অথচ আমি খাচ্ছি বলেই মনে হচ্ছে! আরো কিছুক্ষণ খেয়াল করে উনি বুঝলেন যে আমি কেবল চিবোচ্ছি, কিন্তু গিলছি না কিছুই (কারণ উনি তো আমাকে গিলতে বলেন নি, আমিও তাই শুধু চিবোচ্ছি তো চিবোচ্ছিই :-) !
মা বাবার সঙ্গে ছোট্টবেলায় বিলেতে কাটিয়ে যখন আমরা ফিরে এলাম, তখনও আমি ছোটই। অত ছোট বাচ্চা কেমন অনায়াসে ইংরেজি বলতে পারে, সেটা আত্মীয় স্বজনদের দেখাবার জন্য মায়ের আমার চেষ্টার অন্ত ছিল না, কিন্তু যদিও আমি ইংরেজিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলাম, কোনো এক কারণে দেশে ফেরার পর আমি পারতপক্ষে ইংরেজি বলতে চাইতাম না। আসলে ওই বয়েসেই (তখন আমি কেবলই পাঁচ), ব্যাপারটার মধ্যে যে একটা অস্বাভাবিকতা আছে, সেটা আমি বোধয় বুঝতে পেরেছিলাম। এই রোগটা আমার বড় হয়েও সারে নি। দেশে থাকতেও লক্ষ করেছি এক ঘর বাঙালির মধ্যে, বিনা প্রয়োজনে, নিজেকে ‘স্মার্ট’ প্রতিপন্ন করার জন্য অনেকেই যেখানে ‘ইংলিশ’ বা ‘বাংলিশ’ (ইংরেজির আধিক্য সহকারে বাংলা বলা) বলতে পছন্দ করতেন, আমার কাছে তখনও এবং আজও ব্যাপারটা বেশ হাস্যকরই মনে হয়।
যাক সে কথা, ছোটবেলায় ফিরে আসি আবার। মামা মাসিদের মুখে গল্প শুনেছি প্রচণ্ড গরমে যখন আমার বেশ ঘাম হচ্ছিল, আমি আতংকিত মুখে দৌড়ে এসে সবার সামনে মা কে নাকি বলেছিলাম, “মামনি, আমার পিঠ গলে যাচ্ছে!” আর নতুন শোনা শব্দ ‘মশা’ ভুলে গিয়ে গায়ে চাক চাক হয়ে ফুলে ওঠা মশার কামড় দেখিয়ে তেমনি সিরিয়াসলি বলেছিলাম, “দেখোনা মামনি, আমায় কত্তগুলো ‘ফশা’ কামড়েছে!” ইংরেজিতে কথা বলছিনা কেন জিজ্ঞেস করায় গম্ভীর মুখে নাকি বলেছিলাম, “এখানে তো কেউ ইংলিশ বলছেনা , শুধু আমিই কেন বলব?” পাঠক বিবেচনা করুন, পাঁচ বছরের মেয়ের জন্য যুক্তিটা নেহাত মন্দ ছিল না, কি বলেন?
এই ইংরেজি বলতে পারার প্রতি মুগ্ধতা অনেক বাঙালি মায়ের মতোই, আমার মায়েরও কাটেনি বহু বছর। ছোট বেলা থেকেই আমাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোয়, অনেক বছর বরং বাংলাতেই আমি কাঁচা রয়ে যাই, যেটা অনেক যত্ন এবং চেষ্টা করে বেশ বড় হয়ে আমি শুধরেছি। বাবা গল্পের বই কিনে দিয়ে দিয়ে আমাকে বইয়ের পোকা করে দিয়েছিলেন, তবে প্রথমে পড়তাম সবই ইংরেজি বই। অমন মোটা মোটা ইংরেজি বই পড়তে দেখে আমার মায়ের নাকি মনে হতো আমি কিছুতেই সেগুলো সবটা বুঝে পড়ি না, নেহাতই সামনে ধরে বসে থাকি!! শেষে একদিন গল্পের বই পড়ে আমাকে কাঁদতে দেখে তবেই নাকি মা’র প্রত্যয় হয় যে, না, সত্যিই আমি বুঝে পড়ছি!
মা নিজে বিলেত ফেরত হওয়া স্বত্বেও, বহু বছর পর আমার মেজো ননদের দুই মেয়ে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে বেড়াতে আসলে, ওদের কথা শুনে আমার মা’কে মুগ্ধ কণ্ঠে বলতে শুনেছি, ‘ইসস! মেয়ে দুটো কি অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে!’!!!! আবার সেই ননদই মেয়েরা বিভ্রান্ত (confused) হবে ভেবে ঘরে তাদের সঙ্গে ইংরেজি বলায় তারা মোটেই বাংলা বলতে শেখে নি, আর তাই আমার মেয়ে পিয়াকে দুবছরের নিয়ে যখন একবার ওদের কাছে লন্ডনে বেড়াতে যাই, ওর (পিয়ার) পাকা পাকা কথা শুনে ওনাকেও (মেজদিকেও) ঠিক ততটাই মুগ্ধতা নিয়ে বলতে শুনলাম, “ইস! মেয়েটা কি সুন্দর বাংলা বলে!!” পাঠক, বুঝুন, বাঙালির ঘরের বাংলাদেশি মেয়ে বাংলায় কথা বলছে, সেটাও ক্ষেত্র বিশেষে তারিফ পায়। যাব্বাবা, হচ্ছিল আমার ছোটবেলার কথা এর মধ্যে কিভাবে যে আমার মেয়ের ছোটবেলার কথা ঢুকে গেলো, কে জানে! পাঠক,নিজ গুণে মাফ করে দেবেন।
তো যা বলছিলাম....সেই পূর্বোক্ত মামাবাড়ি ঘিরে আমার বিস্তর সুমধুর স্মৃতির কয়েকটা শুধু বলি: বাবা চা বাগানের ম্যানেজার হওয়ায় বিলেত থেকে ফিরে বাংলাদেশে আসার আগে আমার ছোটবেলাটা কেটেছে দার্জিলিং আর আসামের ছবির মতো সুন্দর কয়েকটা চা বাগানে, কিন্তু নিয়ম করে প্রত্যেক বছরই by air কলকাতায় মামাবাড়ি বেড়াতে আসতাম। আর সে কি জমজমাট ছিল সেসময়ের দমদমের 11/1 H.K.Seth Lane এর মামাবাড়িটা! মাকে দেখতাম বাগানের নারকেলের নাড়ু, নিজের গোয়ালের গরুর দুধের সর তোলা ঘি, ছানার কড়া পাকের সন্দেশ, টুকিটাকি আরো কত কি বোয়েম ভরে নিয়ে যেতে আর তেমনি ফেরার সময় দিদারা দিয়ে দিতেন ইলিশ মাছের সর্ষে পাতুরি, জামাইয়ের বিশেষ পছন্দের বড় এক বোয়েম লেবুর জারক, আর আমার জন্য আমার প্রিয় মাটির ভাঁড়ে জমানো মিষ্টি লাল দই, এটা সেটা,আরো কত কি।
জামাইয়ের জন্য শাড়ির পাড় থেকে সুতো তুলে নিখুঁত ছোট ছোট ফোঁড় তুলে নকশি কাঁথাও দিয়েছেন দিদারা, বা মামী মাসিদের সারা বছর পড়ন্ত দুপুরের রোদে পাটিতে বসে বোনা হাল ফ্যাশনের শাল (মা’র জন্য) আর আমার পুতুলের জন্য আমার সেই প্রিয় মাসির বানানো ছোট ছোট লেপ, বালিশ, এমনকি কোলবালিশ ও! কোনবার হয়তো দেখতাম এলুমিনিয়ামের হাড়ি কড়াই , হাতা খুন্তি। তার সঙ্গে একবার পেয়েছিলাম মাটির তৈরি একটা চুলা আর শীল পাটা পর্যন্ত!! ভালোবাসার ওম মাখানো সেই অনবদ্য উপহার পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, আর কিছুতেই তা পাওয়া যাবে না। সেই আদর আজও ভুলতে পারিনা। এখনো চোখ বুজলেই দেখতে পাই ছুটির শেষে ফিরে আসার সময় সদর দরজার বাইরে রোয়াকে সার বেঁধে দাঁড়ানো অনেকগুলো প্রিয় মুখের মাঝে ঘোমটা দেওয়া ‘ভালো মা’র সেই সোহাগ মাখা সজল চাউনি। আমার দিদাকে বাড়ির সবাই ‘ভালো মা’ ডাকতো, তবে আমি আমার পিঠোপিঠি মামাত ভাইয়ের দেখাদেখি ‘ঠামু’ ডাকতাম। কেন যেন কেউ সেটা শুধরে দেয়নি।
আবার কখনো এমনও হয়েছে, কোনো একজন মামা বা মাসির বিয়ে উপলক্ষে হাজির হওয়া এক পাল মামাত মাসতুত ভাই বোনের দঙ্গল সারা দুপুর ঝড়ের বেগে দুরদার করে একতলা, দোতলা, ঝুলবারান্দা, ছাদ, চিলেকোঠা চষে ফেলতাম আর বড়োরা সবাই বিয়েবাড়ির নানা কাজে বা আড্ডা মারায় এতই ব্যস্ত থাকত যে আমাদের নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথাই ছিল না। তারই মধ্যে ছাদে দোল দাদুর সযত্নে লালিত টবগুলোর দু একটা শহীদ হত (ছোটবেলায় আমাদের দোলাতেন বলে আমিই তার এই নামকরণ করেছিলাম, এছাড়াও ছিল উলুম মামু আর ‘ভুনটি’ ওঁরা দুজন আমাকে আদর করার সময় সম্ভবত ওই ধরণের আওয়াজ করতেন!) , চিমটি দাদুর চশমা পড়ে দেখতে গিয়ে তার ডাঁটি ভাঙা (accidentally, of course), আর বেওয়ারিশ পড়ে থাকা হোমিওপ্যাথিক ওষুধের বোতল থেকে ছোট ছোট মিষ্টি মিষ্টি গুল্লি চেখে দেখা, সবকিছুতেই যেন পেতাম দেড়শ মজা, যা কিনা চা বাগানের বড় বাংলোতে একা একা কল্পনা করাও দুষ্কর ছিল।
ওরই মধ্যে ঠিকই খাবার সময় মস্ত বড় এক কাঁসার থালায় গরম গরম ফেনা-ভাতের সঙ্গে, ঘি, আলু ভাতে আর ডিম সেদ্ধ মেখে ছোট দিদা সব্বাইকে গোল করে বসিয়ে গ্রাস করে করে খাইয়ে দিতেন, সে যেন অমৃতের মত লাগতো! বড় হয়ে অনেকবার সেটা replicate করার চেষ্টা করেছি, চেহারা একই রকম হলেও, স্বাদে বিস্তর ফারাক থেকে যেত। আসলে কোথায় পাবো তখন সেই অনাবিল শিশু মন আর কোথায় পাব প্রিয়জনদের সেই সঙ্গ-সুখ, যা সাধারণ ফেনা-ভাতকেও করে তুলত অমৃত!
এরই মধ্যে এসে যেত বিয়ের নিমন্ত্রণের মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ থেকে অন্তত অর্ধ শতাব্দী আগের কথা, মনে হলে আশ্চর্যই লাগে যে তখনো আমার দাদুদের মত কলকাতার এক মধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের গৃহকর্তাকে দেখেছি বিয়েবাড়ির সব নায়রি মহিলা এবং মেয়েদের খোঁপায়/চুলে জড়ানোর জন্য আলাদা আলাদা রজনীগন্ধা /গোলাপের মালা এবং দু এক বোতল Whitex এর যোগান দিতে। whitex টা ছিল শ্যামাঙ্গীদের কিছুটা ফর্সা দেখাবার কোনো একটা লোশন যেটার সমতুল্য বোধয় এখানকার make up foundation. এছাড়াও বরযাত্রীদের প্রত্যেকের জন্য থাকতো ঝাউপাতার সঙ্গে একটা করে গোলাপ কুড়িকে রুপোলী ফিতে দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা এবং পিছনদিকে ছোট্ট সোনালী সেফটি পিন লাগানো ফুলেল bomboniere আর গোলাপ জলের ঝারি। সেগুলো নিয়ে দাঁড়াবার দায়িত্ব আমাদের কখনোই দেওয়া হত না, কারণ বরযাত্রীদের সসম্মানে অভ্যর্থনা করার জন্য দায়িত্ববান কাউকেই সেই কাজটা করতে হত।
পরের অংশ
|