অপত্য সুতপা বড়ুয়া
নয় মাসের পোয়াতি বৌটার দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই কেঁপে ওঠে সাবেত। ডাক্তার আপা আল্ট্রাসনো করে রহিমা কে জানিয়েছেন এবারো একটা ছেলে বাচ্চাই হবে তার। শারীরিক ভাবে প্রচণ্ড দুর্বল হলেও সাবেতকে বলার সময় রহিমার মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি ছড়িয়ে থাকে। তা দেখে তার মুখেও একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠেই মিইয়ে যায়। এর আগেও একবার পেটে বাচ্চা এসেছিল বৌটার, রাখতে পারেনি। আল্লার রহমতে আরেকবার কোল ভরে ওঠার স্বপ্নে বিভোর মেয়েটা। আর চোখের মণি ছোটু মিঞা তো আছেই। এই চির দুঃখী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড ময় হয় সাবেতের। কিছুতেই তাকে বলতে পারেনা কি ভয়ঙ্কর একটা কাজ আজ তাকে আবারো করতে হবে।
সাবেত ছিল তার মায়ের শেষ কালের ছাওয়াল। মিঞা ভাই এর পর সাত সাতটা বোন। তার পরে সে। শুনেছে আব্বা ছিলেন বেজায় বদরাগী, তবে তার জন্মের পর পরই তিনি নাকি রহস্যজনক ভাবে মারা যান, আর মা ও মারা যান তার ছ সাত বছর বয়েসেই, তাই তখন থেকেই সে তার ভাই ভাবীর কাছে মানুষ। জন্মসূত্রেই বোধয় বাপের বদমেজাজটা পেয়েছিলো মিঞা ভাই, আর ভাবীরও কোনো সাহস ছিল না স্বামীর কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার। এতিম সাবেত মায়া মহব্বত কি জিনিস সেটা প্রথম বোঝে রহিমার সঙ্গে তার বিয়ে হওয়ার পরেই। এর আগের জীবনটার কথা ভাবতেই ভাল লাগে না তার। সে সব বড় কষ্টের দিন, বড় অপমানের সময়। আশ্রয়দাতা, অন্নদাতা মিঞা ভাই বাসেত মিয়ার সব অপকর্মের দোসর সে। কত নিরীহ লোকের যে সর্বনাশ করেছে তারা দু ভাই মিলে! হেন কুকাজ নেই যা তাকে দিয়ে করায় নি তার ভাই। এক সময় কিছুই মনে হয় নি তার, কিন্তু এখন সে আর আগের মত নেই মোটেও। রহিমা তার নিজের মত করেই কখন যেন বদলে দিয়েছে তার চিন্তা ভাবনাগুলো। আজ নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে শিউরে ওঠে সে।
পর পর অনেক গুলো বাচ্চা হওয়ায়, কোলের ছেলেটা হওয়ার সময় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল ভাবী। তখনি গ্রামের হত দরিদ্র চাষা অমানুল্লার মেয়ে রহিমা কে আনা হয়েছিল ভাবীর খেদমত করার জন্য। রাত বিরেতে মিঞা ভাইয়ের সঙ্গে কাজ সেরে ফিরলে রহিমাই উঠে ভাত তরকারি বেড়ে দিত তাদের। রহিমাকে পেয়ে ভাবীরও আরাম হয়েছিল অনেক আর তাই হয়তো দেওরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে রেখে দিতে চেয়েছিল মেয়েটাকে। সেই যে নিজের একটা মানুষ পেলো সাবেত, সে যেন তার সব অপূর্ণতা ভরে দিলো। এতো ভালোবাসা এই ছোটোখাটো একটা একরত্তি মেয়ের বুকে জমানো ছিল, আগে বোঝে নি সে। রহিমার ভালোবাসায় তারও বড় সাধ হয় ভালো মানুষ হতে, কিন্তু পেটের দায় বড় দায়। যখন একা ছিল সাবেত, তখন এই বোধটা আসে নি তার, আর এখন আসন্ন প্রসবা স্ত্রী, অনাগত সন্তানের কথা ভেবে মাথা আর কাজ করে না ওর। নিজের জন্য ভাবে না সে মোটেও, কিন্তু বৌ বাচ্চার কথা ভেবেই এতদিন চুপ করে ছিল সে, কিন্তু আর নয়। এবার একটা হেস্ত নেস্ত করতেই হবে তাকে, তবে তার আগে বাচ্চাটা হয়ে যাক। একবার রহিমা কোলে ভালোয় ভালোয় তাদের বাবুটা এসে যাক, সে বৌ বাচ্চা নিয়ে পালাবে।
অপুষ্টি আর অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে প্রথমবারের বাচ্চাটা হারায় রহিমা। আর তখন থেকেই যেন ভাবির ছোট ছেলেটাকে আরো বেশি আঁকড়ে ধরে সে। এমনিতেই জন্মের পর থেকে রহিমার কাছেই বলতে গেলে মানুষ হচ্ছে ছোটু মিঞা, তাছাড়া এক ঘর ভাই বোনের সংসারে ছোট চাচা চাচির কাছে আদর পেয়ে ছোটু মিঞাও তাদের সঙ্গেই লেগে লেগে থাকে সারাক্ষণ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক পিচ্চি ছাগলের বাচ্চা। বড় ভাবীর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল রহিমা ওই বাচ্চাটা। কোনোদিন কোন শখ আহ্লাদ করেনি মেয়েটা, আর তাই কি ভেবে যেন ভাবিও মানা করে নি। অবোধ প্রাণীও ভালোবাসার ভাষা বোঝে ঠিকই আর তাই কাজের মাঝে পুকুর ঘাট কি সবজি বাগান, যেখানেই যাক রহিমা, তার পিছু পিছু থাকে ছোটু মিঞা আর তাদের ছাগল ছানা।
সেই ছাগল ছানাটাকেও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি রহিমা। এক ঝড় তুফানের রাতে মিঞা ভাইয়ের মেহমান আজমল শেখকে খাওয়ানোর জন্য সে সময় ঘরে আর কিছু না থাকায় রহিমার আর ছোটুর আদরের ছানাটার দিকে নজর যায় বাসেত মিঞার। ভাবি ভয়ে ভয়ে একবার বলেছিল স্বামীকে আর ছোটু মিঞাও টের পেয়ে কান্না কাটি জুড়ে দিয়েছিলো। সেই কান্নার জবাবে এমন এক থাপ্পড় মেরেছিল মিঞা ভাই, যে ছেলেটা উড়ে গিয়ে পড়ে রহিমার কাছে। রহিমা তখন পাথর। কি হতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। চাচির কোনো সাড়া না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছোট চাচার কাছে নালিশ নিয়ে যায় ছোটু। তাই দেখে ছোটুর আসল বাপ সে নিজে না সাবেত, এরকম বিশ্রী উক্তি করতেও বাধে না বাসেতের।
মনটা বিদ্রোহ করলেও ভাইয়ের ভয়ে নিজের হাতেই ছানাটাকে জবাই করে সাবেত, তবে কি ভেবে সেরাতে রহিমাকে আর রান্নার কাজে ডাকে নি ভাবি। সে রাতের পর থেকেই নিজেকে নিয়ে বোঝাপড়া শুরু বাসেতের। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা রহিমার মাথায় হাত দিয়ে ওয়াদা করেছিল সাবেত, খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাবে তাদের নিয়ে। দূরে কোথাও গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করবে তারা, শুধু আর ক'টা দিন। ডাক্তার আপা বলেছেন সময় হয়ে গেছে, এখন যে কোনো দিন ব্যথা উঠলেই যেন বৌ কে নিয়ে আসে সাবেত তাদের উপজেলা হাসপাতালে। এরই মধ্যে মিঞা ভাই আর আজমল শেখের মধ্যে লেগে যায় ফ্যাসাদ। বহুদিন থেকেই চোরা নদীর মতো ভেতরে ভেতরে শত্রুতা থাকলেও এবার মিঞা ভাই কে ফাঁসানোর জন্য আটঘাট বেঁধেই নেমেছে শেখ। আর তাই তাকে আটকানোর জন্য তারই চালে তাকে মাত করার সিদ্ধান্ত নেয় বাসেত। মিঞা ভাই যখন তাকে বলে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রাতের বেলা বাড়ির পিছনের পুকুর ঘাটে আসতে, আকারে ইঙ্গিতে বোঝে সাবেত আবারো তাকে ভাইয়ের কথামত কাউকে শেষ করে দিতে হবে, আর সেই দোষ কোনোভাবে ফেলা হবে আজমল শেখের ওপর। তাহলেই একমাত্র চিরদিনের মতো পথের কাঁটা দুর হবে।
যে বাচ্চাটা বাঁচাতে পারে নি তারা, তাদের ছোটু মিঞা, রহিমার পেটের ছাওয়ালটা, এমনকি নিজের হাতে জবাই করা ছানাটার কথাও ভিড় করে আসে তার মনে। একবার ভাবে পারবে না সে আর কিছুতেই, আজ রাতেই বৌ কে নিয়ে পালাবে সে। কিন্তু বৌটা যে একেবারেই নেতিয়ে পড়েছে, ভাবে সাবেত। একটু পরেই মিঞা ভাইয়ের ডাকে কাচারি ঘরে গিয়ে ঢোকে সে। আজ তাকে প্রচুর নেশা করাবে বাসেত মিঞা। শালা, হারামজাদা! নিজের তো দোজখেও ঠাঁই হবে না, সাথে তার জীবনটাও ফানা ফানা হয়ে গেলো। আকণ্ঠ বাংলা মদ গিলে রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়ে সাবেত, কিন্তু ঘুমাতে পারে না কিছুতেই। কাজ সেরে ঘুমাতে আসা বৌটার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন পাগল পাগল লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে তার। মনে হয় কতদিন যেন খোলা বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া হয় নি। এইসব উল্টো পাল্টা ভাবতে ভাবতে কখন যেন একটু ঝিমুনি ধরে গিয়েছিলো, হঠাৎ ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সে। নিশিতে পাওয়া মানুষের মত বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে নিতে আবারো নিজেকে বোঝায় সে, এই শেষবার, আর একাজ করবে না সে। বের হওয়ার আগে আর পিছন ফিরে তাকায় না সাবেত।
টলতে টলতে পুকুর পাড়ে পৌঁছে সাবেতের কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। হাতের লন্ঠনটা তুলে কোথাও কাউকে দেখতে পায় না সে। কাছেই কোথাও বিশ্রী করে একটা কুকুর কেঁদে যাচ্ছে। একবার ভাবে যা থাকে কপালে, বাড়ি ফিরে গিয়ে মিয়াঁ ভাইয়ের কাছে মাফ চেয়ে নেবে, কিন্তু কয়েক পা যেতেই বাড়ির দিক থেকে তার দিকে আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা এক ছায়ামূর্তিকে হেঁটে আসতে দেখে বোঝে বড্ড দেরী করে ফেলেছে সে। আর কয়েক পা আসতেই সে বোঝে ভাইয়ের কাঁধে নেতিয়ে পড়া আরেকজন কেউ আছে চাদরের ভেতর। তবে কি নিজেই কাজ শেষ করে ফেলেছে মিঞা ভাই? কিন্তু ইশারায় তাকে সঙ্গে থাকতে বলে ঝোপ ঝাড়ের পিছনে গিয়ে যাকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরে ভাই, তাকে লন্ঠনটা আলোয় দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না সাবেতের। আজমল শেখকে খুনের দায়ে ফাঁসানোর জন্য নিজের ছোট ছেলেকেই জবাই করতে নিয়ে এসেছে পিশাচটা। সদ্য ঘুম ভাঙা ছোটু মিয়ার বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকাতে পারেনা সাবেত। এক হাতে তার মুখটা চেপে ধরে সাবেতকে তাড়াতাড়ি কাজ সারতে বলে বাসেত। এক মূহুর্তে মন ঠিক করে ফেলে সে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুরিটা চালিয়ে দেয় সে বাসেতের পেটে, তারপর দু হাত দিয়ে জোরে ঠেলে দেয় ওপরের দিকে।
পিছনে পড়ে থাকে বড় ভাইয়ের নিথর, রক্তাক্ত দেহটা। ছোটুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় সাবেত। এখনো অনেক কাজ বাকি তার। ভাবীর কাছে ছোটুকে বুঝিয়ে দিয়ে রহিমার কাছে মাফ চেয়ে বিদায় নিতে হবে, আর সকাল হলে থানায় গিয়ে দারোগা সাহেবের কাছে সব স্বীকার করবে সে। তারপর যা হওয়ার হবে। আর ভাবতে চায় না সে। তবে থানায় যাওয়ার আগে রহিমাকে বলে এক থালা গরম ভাত খেয়ে একটা ঘুম দেবে সে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে তার।
পাদটিকাঃ গতমাসের মাঝামাঝি সুনামগঞ্জর দিরাই উপজেলায় পাঁচ বছরের তুহিন মিয়াকে তারই বাবার কথামত বাবার কোলে ঘুমন্ত অবস্থায় বীভৎস ভাবে হত্যা করে তারই চাচা এবং চাচাত ভাই।
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|