গল্প ফিরে পাওয়া / সুতপা বডুয়া
আগের অংশ
আব্বা বের হয়ে যেতেই আম্মাকে কাঁদতে কাঁদতে আবার জায়নামাজে বসে পড়তে দেখে কি যেন একটা বিষম ভয়ে বুকটা শুকিয়ে আসে বারবার। মীরাকেও দেখি মূর্তির মত বসে থাকতে। বেলা গড়িয়ে আব্বা যখন ফিরে আসেন, কিছুই বলেন না তিনি, কিন্তু তার মুখটা যেন ফেটে ফেটে পড়তে চাইছে আর চোখ দুটোতে দেখতে পাই এক নিষ্ফল আক্রোশ ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। রাতে শুনি তিনি আম্মাকে বলছেন পরদিনই আমাদের নিয়ে বের হয়ে যাবেন । আপাতত নানাবাড়ি, তারপর যা হয় দেখা যাবে।
কিসের থেকে কি হচ্ছে, চেয়ারম্যান চাচা আব্বাকে কি বলতে পারেন, এসব ভেবে ভেবে ঘুমাতে পারি না সে রাতে। ছটফট করতে করতে এক সময় চোখ লেগে এলেও ভোরের দিকেই ঠিক ঘুম ভেঙে যায়। দেখি মীরা আর আম্মা এরই মাঝে পথের জন্য কিছু গুড়, চিড়ে, এটা সেটা বাঁধাবাঁধি করছে আর আব্বা ফজরের নামাজ আদায় করছেন।
আজও চোখ বন্ধ করে আমি সেদিনের সেই মুহূর্তটা দেখতে পাই। এর কিছুক্ষণ পরেই মীরার সাথে আম্মাকেও তুলে নিয়ে যায় মিলিটারিরা। আমাদের বাড়িতে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল চেয়ারম্যান চাচাই। ওদের বাধা দেওয়ায় আর ছেলে ‘মুক্তি‘ হওয়ার অপরাধে যাওয়ার সময় বাবার বুকটাও ঝাঁঝরা করে দেয় কটা বুলেট। পুকুর পাড়ে থাকাতে, খড়ের গাদায় লুকিয়ে থেকে আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও, তখনো জানতাম না আমার পুরো পৃথিবীটাই যে চিরদিনের মত পাল্টে গেছে।
মিলিটারি চলে যাওয়ার আরো অনেকক্ষণ পর বের হয়ে উঠানে আব্বার লাশ পড়ে থাকতে দেখি। মুহূর্তে আমার মাথাটা ঘুরে ওঠে। তখনই মনে হয় আম্মার আর মীরার কিছু হয়নিতো? ঘরে ঢুকে কাউকেই পাই না। খালি ঘর আর রক্তাক্ত উঠান যেন গিলে খেতে আসে আমাকে। আমার চেনা পৃথিবী তার চিরচেনা রূপ রস রঙ নিয়ে আর কখনোই ধরা দেয় না আমাকে।
ন মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলেও ভাইয়া আর ফিরে আসেনা। আসেনি রঞ্জুদা বা তাদের বাড়ির কেউ। আম্মা আর মীরা দুজনেই বাড়ি ফেরে কিন্তু মীরা ততদিনে বদ্ধ উন্মাদ। ভাইয়ার না ফেরা, বাবার না থাকা, উপরন্তু তাদের ওপর হয়ে যাওয়া নারকীয় অত্যাচারে আম্মাও ভেঙে পড়েন একেবারে। তার পরও বছর খানেক বেঁচে ছিলেন আম্মা। তার মুখেই শুনি আব্বাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেদিন মীরাকে মিলিটারিদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল চেয়ারম্যান চাচা। আব্বা এই প্রস্তাবে রেগে যাওয়ায় আমাদের সবাইকে শেষ করে দেবে বলে শাসিয়েছিল পশুটা। পরের দিনই আব্বা আমাদেরকে নিয়ে বের হয়ে যাবেন বলে ভেবেছিলেন কিন্তু সেই সুযোগ আর পাইনি আমরা।
ফিরে আসার পর মীরার একটা জিনিস আমায় দিয়েছিলেন আম্মা, সেটা তার সেই ছোট্ট নাড়ুগোপালের মূর্তি। এই একটা জিনিসই সে সাথে করে নিয়ে এসেছিল ভাইয়ার সাথে ঘর ছাড়ার সময়। মারা যাওয়ার আগে আম্মা আমার হাত দুটো ধরে বলেছিলেন আমি যেন প্রাণ দিয়ে হলেও মীরাকে দেখে রাখি আর তার মনের তমসা কেটে গেলে তার গোপাল তাকে ফিরিয়ে দিই।
আজো সেই দিন আসেনি। আমার ছোটবেলার প্রিয় সখী মীরা আর সেই দুষ্টু বাচ্চার মূর্তি, এই দুই আমানত আগলে আজো বসে আছি। একজনের চোখের কান্না যেমন সইতে পারিনা, অন্যজনের মুখের হাসিও আমাকে স্বস্তি দেয় না।
আগের অংশ
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|