গল্প ফিরে পাওয়া সুতপা বডুয়া
ছোট করে ছাঁটা চুল গুলো প্রাণপণে খামচে ধরার চেষ্টা করছে মীরা। চোখে মুখে এক অবর্ণনীয় ত্রাস। মাঝে মাঝে দুর্বোধ্য কিছু শব্দ বের হয়ে আসছে তার গলা থেকে। গায়ের ম্যাক্সিটা যে হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে, সেদিকেও খেয়াল নেই তার। ভীষণ কষ্ট হয় যখন ভাবি এতো ভাল একটা মেয়ের এমন করুন পরিণতির জন্য পরোক্ষ ভাবে হলেও আমি দায়ী। আমি মোহাম্মদ শাহীন আর আমার সামনে বসে থাকা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা মেয়েটা আমারই ছোটবেলার খেলার সাথী মীরা বসাক।
অনেক চেষ্টা করেছি মীরার মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনতে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে বহুদিন ধরে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু লাভ তেমন কিছুই হয়নি। একটা ব্যাপারে অবশ্য ডাক্তার আপার কথায় সুফল পেয়েছি। যখনই মীরার চোখের দৃষ্টি অস্বচ্ছ হয়ে যায় আর তার পাগলামি চূড়ান্ত রকমের বেড়ে যায়, উনি বলেছিলেন মীরাকে যদি এমন কিছু দিতে বা দেখাতে পারি, যার সঙ্গে তার কোনো সুন্দর সময়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে, তাহলে সে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ওই সময়টাতে ফিরে যাবে।
আজও যেই তার জামাটা টেনে নামিয়ে দিতে যাই, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গোঙাতে থাকে মীরা। দু’হাত দিয়ে নিজের হাঁটু দুটো জোরে জাপটে ধরে দুলতে থাকে প্রথমে, তারপর আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে আর এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। কিছু না করলে এই অবস্থা ক্রমশঃ আরো খারাপ হতে থাকবে, তাই ওকে শান্ত করতে বরাবরের মতোই পেতলের ছোট্ট মূর্তিটা এনে ওর হাতে দেই, আর কি আশ্চর্য! মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায় মীরা।
ছিপছিপে মীরা, ওর বড় ভাই রন্জুদা, আমি শাহীন আর আমার বড় ভাই সজল। আমরা ছিলাম এক জান এক প্রাণ। সারাদিনে যতটা সম্ভব আমরা একসাথেই কাটাতাম। ইস্কুলেও মীরা আর আমি একই ক্লাসে পড়তাম, তাই আমার ছোটবেলার মধুর স্মৃতিগুলোর প্রায় সবগুলোতেই মীরার আনাগোনা। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। রঞ্জুদা, মীরা, আমি আর ভাইয়া মিলে কতরকমের দুষ্টুমিই না করতাম।
আমাদের বাড়িতে আমরা শুধু চারজন। আম্মা, আব্বা আর আমরা দু’ভাই। শুনেছি ভাইয়ার বড় একজন বোন ছিল আমাদের, কিন্তু ছোট্ট থাকতেই সে পুকুরে ডুবে মারা যায়। ওদিকে মীরাদের বাড়িতে ঘর ভরা মানুষ। রঞ্জুদা আর মীরার মা বাবা ছাড়াও এক ঠাকুমা ছিলেন, পরে অবশ্য উনি মারা যান। আরো ছিল শম্ভু কাকা, নতুন কাকী আর ঊমা পিসি। মাঝে মধ্যে নতুন কাকী আর পিসীও আমাদের সঙ্গে লুডো খেলায় যোগ দিত, কিন্তু আমাদের আসল দলটা ছিল চারজনের। ভাইয়া, রঞ্জুদা, মীরা আর আমি। ভাইয়া আর রঞ্জুদা সমবয়সী হলেও মীরা আমার চেয়ে একটু বড়োই হবে হয়তো, তবে আমি ছোটবেলা থেকেই ভেবে রেখেছিলাম, বড় হয়ে আমি ওকেই বিয়ে করব।
আরো ছোট থাকতে মীরাদের পূজোর ঘরটা আমায় খুব টানতো। কত সন্ধ্যায় মীরার দেওয়া নকুলদানা আর বাতাসা মুখে পুরে হেসে একজনের গায়ে আরেকজন গড়িয়ে পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। সবচে' পছন্দ ছিল নাড়ুগোপালের মূর্তিটা। কি সুন্দর ছোট্ট একটা হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চা, একহাতে একটা নাড়ু ধরে রেখেছে। মীরার সাথে ছোটবেলায় ঢুকে আরো অনেক ছবি আর মূর্তি দেখেছি সেই ঘরে, কিন্তু পছন্দ ছিল ঐটাই। হয়ত নিজেও তখন ছোট ছিলাম বলেই।
টুপটাপ শিশির ঝরা সকালে রোজ জ্যেঠিমা‘র জন্য মীরা তার নারকেলের শলার তৈরি ছোট্ট সাঁজিটা নিয়ে ফুল তুলতো। আমিও কতদিন আমাদের বার উঠানের রক্ত জবা গাছের ক‘টা ফুল টুপ করে ওর সাঁজিতে ফেলে দিয়েছি। রোজ সকালে আমি আরও একটা কাজ করতাম। এক টুকরো কাঠকয়লা নিয়ে দাঁত মেজে, কালো কালো দাঁত বের করে মীরাকে ভেংচি কাটাটাও আমার রোজ সকালের অবশ্য কর্তব্য ছিল। মীরাটাও কি কম দুষ্টু ছিল? ওর হাতে সেই তখন থেকেই আমার কিল ঘুষি খাওয়া শুরু। তবে ঠাকুমা, জ্যেঠিমা যখনই কোনো মুখরোচক খাওয়ার বানাতেন, মীরা সেটা আমাদের না দিয়ে কক্ষনো খেতো না।
দু’বাড়ির বড়দের মধ্যেও ছিল প্রাণের টান। আব্বাকে যেমন দেখেছি যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জ্যাঠামশাইর সঙ্গে আলাপ করে নিতে, আম্মা আর জ্যেঠিমাকেও দেখেছি দুই বোনের মতো। ভাইয়া না থাকলে, দরকারে যে কোনো কাজে শম্ভুকাকাকে ডেকে পাঠাতেন আব্বা। নিজের মেয়ের শোক আম্মা অনেকটাই ভুলেছিলেন মীরা হওয়ার পর। যেন এক পরিবারের মতোই ছিলাম আমরা। এরই মাঝে ভাইয়ার মনেও যে মীরা একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে, সেটা তখন বুঝিইনি আমি। একই ক্লাসে পড়ি আর একই সঙ্গে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাই বলে, ভাবতাম ওর ওপর আমার অধিকারটাই সবচে' বেশি।
এরই মধ্যে বুঝতে পারি চারিদিকে কিসের যেন একটা অস্থিরতা, বড়দের সবার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ভাইয়ার মুখেই প্রথম শুনি স্বাধিকার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়তে নেমেছে এদেশের সাধারণ মানুষ। ঢাকায় ২৫শে মার্চে মারা হয়েছে অগণিত নিরীহ মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে লাশের স্তুপ, রাস্তায় ঘাটে পরে রয়েছে শ'য়ে শ'য়ে মৃতদেহ। এর প্রতিবাদ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অনেকে। ভাইয়া'র ইচ্ছে সেও যোগ দেবে এই 'মুক্তি'র যুদ্ধে। রঞ্জুদা নাকি আরো খোঁজ খবর নিয়ে তাকে জানাবে বলেছে। আব্বা আর জ্যাঠামশাইকে দেখি সময় পেলেই নিচু ভলিউমে রেডিও শুনতে আর কথাবার্তা বলতে।
ধীরে ধীরে দেশের অবস্থা আরো ঘোরতর হয়ে যেতে থাকে। শুনি কাছাকাছি পৌঁছে গেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা এবং রোজই খবর পাই তাদের নারকীয় তাণ্ডবের। আম্মা আর জ্যেঠিমাকে দেখি প্রচণ্ড রকম আতঙ্কিত, চিন্তিত। উমাপিসিকে আর নতুন কাকীকে প্রায় দেখাই যায়না, তবে মীরা এখনো আসে মাঝে মধ্যে। হঠাৎ একদিন ভাইয়ার মুখে শুনি রঞ্জুদা চলে গেছে যুদ্ধ করতে কিন্তু আব্বা এক কথায় মানা করে দিয়েছে তাকে। সে আরো বলে, আব্বা মানা করলেও যুদ্ধে সে যাবেই।
এসব শুনে আমারও মনটা দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকে, কিন্তু এরই মধ্যে যখন হঠাৎ একদিন মীরার মুখে শুনি, দুদিন পরেই তারা সবাই ইন্ডিয়ায় চলে যাবে, তখন আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। এ দেশে থাকা নাকি তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। জ্যেঠিমা‘র কাছে শুনে এসে আম্মা যখন চোখের জল মোছেন, আমার বুকটাও যে ভেঙে খান খান হয়ে যায়, সেটা কেউ বোঝে না।
হতে পারে মীরা আমার চেয়ে একটু বড়, কিন্তু আমি আরেকটু বড় হলেই ওকে যেতে দিতাম না। কিছুতেই না। দরকার হলে বিয়ে করেই রেখে দিতাম ওকে। এখন ভাবি কি যে নাদান ছিলাম! সে যখন আঁচলে ঢেকে ছোট্ট রেকাবিতে করে জ্যেঠিমা‘র হাতের পিঠে পুলি, নাড়ু , সন্দেশ এনে বলত, 'তোর ভাইয়াকেও দিস একটু', তখনো কিন্তু একবারও মনে হয়নি ওগুলো সে আসলে ভাইয়ার জন্যই আনতো!
কি করব বুঝতে পারিনা। ওকে কি গিয়ে বলব, 'তুই যাস না মীরা'? কিন্তু আমার কথা কি কেউ শুনবে? তার চেয়ে ভাইয়াকে গিয়ে বলি মীরাদের চলে যাওয়ার খবর। আরো বলি ওরা চলে যাওয়ার আগেই সে যেন মীরাকে নিয়ে কোথাও লুকিয়ে থাকে কয়েক দিনের জন্য। কোনোমতেই যেন জ্যাঠামশাইরা চলে যাওয়ার আগে ফিরে না আসে। ভাইয়া আমার চেয়ে খুব বেশি বড় না হলেও, আমার কোন কথাকেই সে কখনো গুরুত্ব দেয়নি, তাই আমার কথাটা যে সে শুনবে, তেমনটাও ঠিক ভাবিনি। তবু মীরাকে হারাবার ভয়ে ওটাই তখন একমাত্র উপায় মনে হয়েছিল।
মীরারা চলে যাওয়ার আগের দিন সকালে উঠে শুনি মীরাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইয়াকে এর পর আরো কিছুক্ষণ দেখা গেলেও এক সময় বুঝলাম সেও নেই। যুদ্ধে যাওয়ার কথা আগে থেকেই সে আম্মাকে বলে রেখেছিল, তাই মীরা আর ভাইয়া যে একসাথেই নিখোঁজ সেটা কারো মাথায় আসে না। আব্বা, জ্যাঠামশাই, শম্ভুকাকা চারিদিকে খোঁজ করেও কোনো খবর পান না। জ্যেঠিমা, আম্মা আমাকেও অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেন আমি কিছু জানি কিনা, কিন্তু আমিও তখন পুরোপুরি বিভ্রান্ত। নিজেই বুঝতে পারিনা ভাইয়া কি আমার কথামতোই মীরাকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, নাকি অন্য কিছু!
দু’বাড়িতেই তখন কান্নার রোল উঠলো। জ্যেঠিমা ঘন ঘন অজ্ঞান হচ্ছেন আর আম্মাও খাওয়া দাওয়া ছেড়ে জায়নামাজে বসে কাঁদছেন। তার তখনো ধারণা ভাইয়া কাউকে কিছু না বলে যুদ্ধে চলে গেছে। ধীরে ধীরে রাত নামলো, দু’বাড়িতে কারো চোখেই ঘুম নেই, কিন্তু শুনলাম আব্বা জ্যাঠামশাইকে বলছেন রঞ্জুদার যুদ্ধে যাওয়া নিয়ে গ্রামের চেয়ারম্যান চৌধুরী সাহেব খুবই নাখোশ, তাই পরদিনই ইন্ডিয়া চলে যাওয়াই ভাল হবে। মীরার খোঁজ তিনিও নেবেন আর পাওয়া গেলে তার কাছে মেয়ের মতোই থাকবে সে, যতদিন তাকে তার মা বাবার হাতে তিনি তুলে দিতে না পারেন।
একদিকে যুদ্ধের তাণ্ডব, ঘর বাড়ির পোড়া গন্ধ, অন্যদিকে মিলিটারি কাছেই ঘাঁটি গেড়ে নানারকম কুকীর্তি করতে শুরু করেছে। জ্যেঠিমা‘রা অনেক চেষ্টা করেও মীরার কোন হদিস পেলেন না। বাধ্য হয়েই তাকে ছাড়াই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জ্যাঠামশাই। চোখের জলে ভেসে সে রাতে যাত্রা করেন তারা। বড় সহজ ছিল না মেয়েকে ওভাবে ফেলে চলে যাওয়া, কিন্তু উঠতি বয়েসের ভাইয়ের বৌ আর বোনের কথা ভেবেই হয়ত আর থাকতে সাহস করেননি ওরা। যাওয়ার সময় জ্যেঠিমা কান্নার দমকে ভাল করে কিছুই বলতে পারেন না, শুধু আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলে যান ‘মেয়েটা ফিরে আসলে ওকে আগলে রেখো কুলসুম, আর পারলে আমাকে একটা খবর দিও‘।
এরপর সবকিছু বড্ড দ্রুত ঘটে যায়। ওরা চলে যাওয়ার চারদিন পরে ভাইয়া মীরাকে নিয়ে ফিরে এলো। আম্মা তাকে বুকে টেনে নিয়ে কেঁদে বুক ভাসালেন! আব্বা যখন শোনেন ভাইয়াই মীরাকে নিয়ে গিয়েছিল, তখন প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়েন তিনি, ভাইয়াকে বলেন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে। আম্মার শত অনুনয় আর চোখের পানিও সে আদেশ টলাতে পারে না। ভাইয়া চলে যাওয়ার সময় তার আর মীরার চোখের ভাষা পড়তে এবার আমার আর কোন ভুল হয়না আর তাই হঠাৎ কোত্থেকে যেন একরাশ অভিমান এসে ভর করে আমায়। মনে হয় যেন সারা পৃথিবী আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মীরার সাথে আর আগের মত মিশতে পারি না। সেও কেমন যেন গুটিয়ে রাখে নিজেকে। ছেলেমানুষির খেয়ালে নেওয়া হঠকারী সিদ্ধান্তটা যে এভাবে তাকে নি:স্ব করে দেবে তা আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।
আম্মার সাথেই সারাদিন ঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকত মীরা। দিনটা কাজে কর্মে কাটলেও সন্ধ্যা গড়াতেই দক্ষিণের ঘরের জানালা দিয়ে নিজেদের পরিত্যক্ত ভিটের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত শুধু। ওর কান্না শুনে বুকটা ফেটে যেত আমার, কিন্তু ওর চারপাশের অদৃশ্য দেওয়ালটা ভেঙে কিছুতেই আর আগের মত ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারতাম না। আব্বা চেষ্টা করছিলেন কিভাবে জ্যাঠামশাইকে মীরার খবরটা দেওয়া যায়, এরই মাঝে একদিন আব্বাকে গ্রামের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ডেকে পাঠায়...
পরের অংশ
|