দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে সুতপা বড়ুয়া
অস্ট্রেলিয়ায় আন ডো (Anh Do) নামে একজন সফল মানুষ আছেন যিনি মঞ্চে কথা বলে লোক হাসান (Stand Up Comedian)। এই ছোট্ট খাট্ট ভদ্রলোকটির দেশ ভিয়েতনাম। তিনি অত্যন্ত সুরসিক এবং বাকপটু তো বটেই, তার আরেকটি আশ্চর্য হওয়ার মত গুণ হলো তার ছবি আঁকার হাত। সাধারণত: মানুষের মুখচ্ছবি (portrait) আঁকেন তিনি।
নিজের দেশের বৈরী পরিবেশ এড়াতে বাবা মা ভাই বোনের সঙ্গে নৌকোয় চেপে প্রাণ হাতে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী হয়েছিলেন এই হাসিখুশি মানুষটি। তার কৌতুক যেমন সমৃদ্ধ করেছে অস্ট্রেলিয়ার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে, তেমনি এই সমাজকে আরো অনেক কিছুই দিয়ে যাচ্ছেন এই নিরহংকার মানুষটি।
চিরাচরিত তুলির পরিবর্তে হাতা (spatula) আর মোটা মোটা ব্রাশ এর সাহায্যে কি অবলীলায় যে তিনি এঁকে ফেলেন তার সামনে বসা মানুষদের ছবি! আর শুধু আঁকেনই না, যার ছবি আঁকছেন তার সাথে আলাপও করেন আন্তরিক ভাবে। কথোপকথনের মাঝেই তিনি তাঁদের মজার মজার কথায় হাসেন আবার তাদের দুঃখে দুঃখী হয়ে চোখের জল ও মোছেন। পোর্ট্রেট আঁকার জন্য শিল্পীর সামনে বসে থাকা খুব যন্ত্রণাকর শুনেছি। চিত্রকরের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি দিনের পর দিন একই ভঙ্গিমায় নট নড়ন চরণ হয়ে ঠায় বসে থাকতে হয়। আন ডো এর বেলায় দেখলাম এর এক্কেবারে উল্টো চিত্র! সে আর তার সাবজেক্ট যেন মশগুল হয়ে আড্ডা মারছেন এবং সেই আড্ডার সূত্রেই কিন্তু তিনি জেনে নিচ্ছেন তার সাবজেক্টের চারিত্রিক সবলতা এবং দুর্বলতাগুলো। কথা বলতে বলতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূর্ণ করে ফেলেন তার আঁকা ছবিটা। আর সেই ছবিতে মূর্ত হয়ে ওঠে আসল মানুষটি!
এবিসি টিভি তে আন ডো এর Brush With Fame নামের সিরিজের দুএকটা পর্ব দেখেছি এবং তার কাজ দেখে চমৎকৃত হয়েছি, কিন্তু এই কিছুদিন আগে যার ছবি আঁকলেন আন ডো, তিনি হলেন ২০০৫ সালে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় দু' পা হারানো অস্ট্রেলিয়ান তরুণী জিল হিক্স (Gill Hicks ). যারা এই পর্বটি দেখেন নি, আমি অনুরোধ করব সুযোগ হলে একবার দেখে নেবেন। আমি পর্বটির একটা লিংক দিয়ে দিচ্ছি www.enhancetv.com.au/video/anh-s-brush-with-fame-gill-hicks/52300
জিল হিকস এর মেধা এবং অধ্যবসায় তাকে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার এডেলাইড থেকে লন্ডন নিয়ে যায় ১৯৯২ সালে এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পৌঁছে যান অকল্পনীয় উচ্চতায়। সেসব আপনারা উইকিপিডিয়া ঘাঁটলেই পেয়ে যাবেন, বা আন ডো এর পর্বটি দেখলেও জানতে পারবেন, কিন্তু বোমা হামলার সেই নিয়তি-নির্দিষ্ট দিনে অল্পের জন্য রোজকার ট্রেন ধরতে পারেন নি জিল। দেরি করে ফেলায় পরের ট্রেনে, অনেক লোকজন ডিঙিয়ে অনেকটা মরীয়া হয়েই উঠে পড়েছিলেন জিল। সেই ট্রেনেই পাতা ছিল ঘাতক বোমা যাতে তার কামরাতেই মারা যান ২৬ জন। জিল ছিলেন সর্বশেষ জীবিত ব্যক্তি, যাকে উদ্ধার-কর্মীরা বের করে এনেছিলেন। হাঁটুর নিচ থেকে দুটো পা ই শুধু বিচ্ছিন্ন হয়নি তার, অন্যান্য আঘাতও এতটাই গুরুতর ছিল যে তিনি যে প্রাণে বাঁচবেন তা ভাবাই যায়নি। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় সম্ভবতঃ মহিলা রুগী হিসেবে!
মোট ৭২ জন প্রাণ হারিয়েছিল সেই বোমা হামলায় কিন্তু এর জন্য এতোটুকু তিক্ততা ধরা পড়লোনা জিল এর গলায়। যার জন্য আজ তার এই দশা, তাকে দোষ না দিয়ে, তার সামনে দাঁড়ানো যে অজ্ঞাত ব্যক্তির প্রাণের বিনিময়ে বেঁচে যান তিনি, তার জন্য এবং আরো যারা প্রাণ হারিয়েছিল সেদিন, তাদের সবার কথা বলতে গিয়ে বার বার জলে ভরে উঠছিলো জিল এবং আন এর চোখ।
বার বার শুধু আফসোস করছিলেন সামনে দাঁড়ানো লোকটির চেহারাটাও একবার দেখেন নি বলে, অথচ তার শরীরটা বর্ম হয়ে জিল কে ঢেকে ছিল বলেই প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। জিল বার বার বলছিলেন, আমরা কেউ জানিনা কোন ক্রান্তিকালে, কে কার ত্রাণকর্তা হয়ে উঠবে, তাই আমাদের সবার উচিত সবসময়ই অন্য সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করা।
আজকের জিল অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া সম্মানে ভূষিত। তিনি ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান অব দ্যা ইয়ার ছাড়াও আরো অনেক অনেক সম্মানে সম্মানিতা। তিনি একাধারে একজন লেখিকা, বহু সাংস্কৃতিক সংগঠনের ট্রাস্টি এবং আরো অনেক কিছু। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন Motivational Speaker বা অনুপ্রেরণা-দায়ী বক্তা এবং তার বক্তব্য সবসময়ই শান্তির পক্ষে কথা বলে।
পরিশেষে জিল এর বলিষ্ঠ ইতিবাচক মানসিকতার একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। পা হারাবার আগে জিল এর উচ্চতা ছিলো টেনে টুনে পাঁচ ফুট। যখন তিনি নকল পা (prosthetic limb) এর জন্য ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন তখন তিনি আর্জি করেছিলেন যেন তার উচ্চতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ডাক্তারেরা যদিও বলেছিলেন নতুন করে হাঁটা শেখার সুবিধার জন্য তাঁরা সাধারণত আসল উচ্চতা থেকে বরং কিছুটা কমিয়েই দেন, কিন্তু জিলের আবদারের কাছে তারা নতি স্বীকার করেন। জিলের যুক্তি ছিল, খাটো পা নিয়েও নতুন করে হাঁটা শিখতে হবে, লম্বা পা নিয়েও তাই, আপনারা আমায় লম্বাই করে দিন। এই শোকাবহ ঘটনা থেকে কিছু তো লাভ হোক আমার। শেষ পর্যন্ত জিলের ইচ্ছে অনুযায়ী তার নকল পা লাগাবার পর তার উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ফুট ৮ইঞ্চি
শ্রদ্ধা জানাই জিল হিকস এর মত একজন দৃঢ় চিত্তের মানুষকে যিনি ব্যক্তিগত একটা দুঃখজনক ঘটনার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার নিজের মত করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের এই পৃথিবীটাকে আরেকটু বাসযোগ্য করতে। জিল এর মত দ্বিতীয় সুযোগ তো সবাই পাবে না; আর এই পৃথিবীতে কে কতদিনের ভিসা নিয়ে এসেছি, তাও যখন জানিনা, তখন প্রতিটা দিনকেই কেন কাজে লাগাই না সুন্দরের পক্ষে, শান্তির পক্ষে? চেষ্টা করে দেখতে তো অন্তত কোন দোষ থাকতে পারেনা। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|