ডেনমার্ক এর সাইকেল প্রীতি সুতপা বড়ুয়া
কিছুদিন আগে গেছিলাম নরওয়ে আর ডেনমার্ক। এর আগের বার গেছি প্রায় এক যুগ আগে, তাই বেশ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়লো যেগুলো নিয়েই আজকের এই লেখার অবতারণা। নরওয়ে থেকে জলপথে একরাতের দূরত্বেই এবারের গন্তব্য ছিল ডেনমার্ক। গতবার নরওয়ের আরেক প্রতিবেশী সুইডেন দেখারও সৌভাগ্য হয়েছিল। এই তিনটি দেশকেই সম্মিলিত ভাবে স্ক্যান্ডিনেভিয়া বলা হয়, এবং জাতিগত ভাবে এদেরকে নর্ডিক বলা হয়।এরা এক সময় একই ইউনিয়নের অংশ ছিল, যার ফলে ভাষা এবং মন মানসিকতায় প্রচুর মিলও রয়েছে।
আমি অবশ্য আজ কোনো বিস্তারিত ভ্রমণ কাহিনী লিখতে বসিনি, বরং শুধু ডেনিশদের সাইক্লিং কৃষ্টি এবং তাদের পরিতুষ্ট মানসিকতার নিয়েই আমার আজকের এই লেখা। ডেনমার্কে লোকেরা সব ধরণের আবহাওয়ায় এবং দিনের যেকোনো সময়েই সাইকেল চালায়। ডেনিসরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে, জিনিস আনা নেওয়া করতে, পরিবারের সবাই মিলে ছুটি কাটাতে বা নিছক আনন্দের জন্যেও সাইকেল চালাতে পছন্দ করে।
রাজধানী কোপেনহেগেনের মতো অন্যান্য বড় শহরেও গাড়ির চাইতে বাইকে চলাচল করা সহজ। পুরো ডেনমার্কে কোনো পাহাড় না থাকায়, সাইকেল আরোহীদের চড়াই উৎরাই এর কোনো সমস্যা নেই, আর নিজের সু-স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ দূষণ সমস্যার সমাধানের জন্যেও তাই হয়ত তারা গোটা জাতীই সাইকেল প্রিয়। ওদেশের প্রতি দশ জনের মধ্যে নয় জনেরই এক বা একাধিক সাইকেল আছে। গড়ে তারা দিনে অন্তত দু তিন মাইল সাইকেল চালায় এবং সাইকেলকে ডেনিশরা তাদের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মানে!
ডেনিস বাচ্চারা ছোট থাকতেই তাদের সাইকেল চালাতে শেখানো হয়, এবং স্কুলের পাঠ্যসূচীতেও তাদের রাস্তার নিয়ম কানুন, মাথায় কেন অবশ্যই হেলমেট পড়া উচিত, এসব শেখানো হয়।যতদিন পর্যন্ত তারা সাইকেল চালাতে না শেখে, ততদিন পর্যন্ত তারা তাদের বাবা-মায়ের সাইকেলের সাথে লাগানো ছোট সিটে ঘুরে বেড়ায়। এমন পরিবারের জন্য ডেনিসদের উদ্ভাবিত আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা হলো কার্গো-বাইক, বা সামনের দিকে একটি বড় বাক্স লাগানো এক ধরণের বড়-সরো তিন চাকার সাইকেল যার নকশা ডেনিসদের পুরস্কার পাইয়ে তো দিয়েছেই, উপরন্তু রপ্তানি করেও সাফল্য মিলেছে!
ডেনমার্কের এই সাইক্লিং কৃষ্টি কিন্তু নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ১৮৮০ তে সাইকেল প্রথম ডেনমার্কে এলেও, ১৯২০ এবং ৩০এর দুই দশকে সাইকেল হয়ে উঠেছিল সাম্য এবং স্বাধীনতার প্রতীক। সমস্ত সামাজিক শ্রেণীর মানুষ পাশাপাশি সাইকেল চালাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সচ্ছলতার সাথে সাথে মানুষজন মোপেড এবং গাড়ির দিকে ঝুঁকলেও ১৯৭০ এর জ্বালানি সংকট তাদের আবারও নিজেদের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনে। কোপেনহেগেনে “গাড়ি বিহীন রবিবার” প্রবর্তিত হয় এবং সেই ১৯৬২ সাল থেকেই রাজধানীর সব চাইতে ব্যস্ত রাস্তা স্ট্রোগেট শুধুমাত্র পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত! ধীরে ধীরে বায়ু দূষণ নিয়ে উদ্বেগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ডেস্ক-আবদ্ধ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ব্যায়াম পেতে ডেনিশরা সাইকেল চালানোকে মুশকিল আসান বলে মেনে নেয়। পেট্রোল এবং অটোমোবাইলের উপর ডেনমার্কের ভারী করও একটি কারণ, তবে হ্যাঁ, এসবই সে দেশের নাগরিকদের এবং সরকারের যৌথ ইচ্ছের প্রতিফলন।
সব মিলিয়েই বলা যায়, যে ডেনিসরা পৃথিবীর আবহাওয়ার সাথে সাথে নিজেদের শারীরিক সু-স্বাস্থ্যই শুধু নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্যেরও চমৎকার খেয়াল রাখছে, এবং এগুলো করতে তাদের সাহায্য করছে তাদেরই প্রিয় সহচর সাইকেল! ডেনমার্ক ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে। তবে শুধু ডেনমার্কই নয়, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, এই পুরো নর্ডিক অঞ্চলের পরিতুষ্ট মানসিকতার পিছনে রয়েছে বেশ কিছু কারণ: তা শুধুমাত্র তাদের অবিশ্বাস্য মাথাপিছু আয়ের জন্যই নয়, বরং এদের জীবনযাত্রার কম খরচ, চমৎকার সরকারী সহায়তা এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্যও উল্লেখযোগ্য। নর্ডিকরা তাদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, তাদের সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের ওপরেও রয়েছে অগাধ বিশ্বাস, এছাড়াও রয়েছে ব্যাপক সরকারি ওয়েলফেয়ার সুবিধা, এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক সমতা।
সবশেষে বলবো ডেনিসদের একটা অনানুষ্ঠানিক বিধি, স্থানীয় ভাষায় যার নাম “Janteloven”. এর মানে “কেউ অন্য আরেকজনের চাইতে ভালো নয়”, “No one is better than the other” এবং এটি ডেনিশ সংস্কৃতি এবং মানসিকতায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যেখানে প্রত্যেকে গ্রহণযোগ্য এবং সমান।
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|