বেদনার বালুচরে সুতপা বড়ুয়া
বাহারা বানো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। একটু আগে কম্পিউটার স্ক্রিনে দেখা দৃশ্যটা তার মগজ যেন এখনো মেনে নিতে পারেনি। এতদিনের সমস্ত প্রস্তুতি, একদিকে বাবাকে কিছুদিনের জন্য হলেও এই বৈরী পরিবেশে ফেলে যাওয়ার জন্য বিবেকের দংশন, অন্যদিকে দানিশ এর হাত ধরে নতুন দিগন্তে উড়াল দেওয়ার স্বপ্ন; অনিশ্চয়তার এই ভয়ঙ্কর বেড়াজাল চিরদিনের মতো ছিঁড়ে ফেলে মুক্ত হয়ে বাঁচতে পাড়ার আশ্বাস, সব কিছু ওই প্রচণ্ড বিধ্বংসী বিস্ফোরণে চুর চুর হয়ে ধুলোয় মিশে গেলো।
বাহারার আজো স্পষ্ট মনে আছে বছর কুড়ি আগের এক নিকষ কালো দিনের কথা, যেদিন মা নিলোফার বানোর সঙ্গে ছোট্ট বাহারাকেও বাবার বুক থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো কিছু হিংস্ৰ অমানুষ। এর পরের ইতিহাস বড়ই লজ্জার, বড়ই অন্ধকার। একমাত্র ভাই আদেলকে তার কিছুদিন আগেই রাস্তায় নৃশংস ভাবে গুলি করে মেরেছে কিছু রাইফেলধারী আজরাইলের দোসর। মৃত সন্তানকে দাফন কাফন করে এসে তার আব্বুজী আর আম্মা তখনো নিস্তব্ধ। একমাত্র সঙ্গী, খেলার সাথী ছোট ভাইকে হারিয়ে বাহারাও বিবশ, বেসাহারা। চেনা পৃথিবীটাকে প্রতিদিন বদলে যেতে দেখে তারা সবাই যেন বোবা হয়ে গেছিলো।
মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের সঙ্গে কিভাবে এরকম ব্যবহার করা যায়, জানেনা বাহারা। পরমুহূর্তেই নিজের ভাবনাকে শুধরে নেয় সে। যারা তাদেরকে নৃশংস অত্যাচার করত, না তারা নিজেরা 'মানুষ', না তাদের মতো হতভাগীদের তারা মানুষ মনে করত। বাহারা, নীলোফারের মতো আরো কয়েকজন ছিল শুধুই সেই জঙ্গি প্রভুদের যৌনদাসী। ছোট বলে তাকে কোন রেয়াত করেনি কেউ। চোখের সামনে মা কে মারা যেতে দেখেছে। হয়ত সেই মৃত্যুপুরীতে আরো অনেকের মতোই তারও মৃত্যুই হত, যদি মিত্রবাহিনীর আক্রমণে তাদেরকে ফেলেই পিঠটান না দিত সেই অমানুষগুলো।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। জীবনের নিয়মেই ক্ষতের দাগ শুকিয়েছে শরীরের এবং মনেরও। প্রিয় দেশটা আগে কেমন ছিল, মাঝখানে কেন তারা কয়েকশ বছর পিছিয়ে গিয়েছিলো, এসবই আব্বুজীর মুখে শুনে শুনে বড় হয়েছে বাহারা। নিজের কাছে ওয়াদা করেছে সে লেখাপড়া শিখে একদিন তার আব্বুজীকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। নিজের নিকষ অতীত ঝেড়ে ফেলে পড়াশোনায় মন দেয় বাহারা, আর পড়তে পড়তেই পরিচয় দানিশের সঙ্গে। দানিশ চৌকস ছেলে, লেখাপড়ার পাশাপাশি মিত্রবাহিনীর দোভাষীর কাজ করে সে অবসর সময়ে। কত কথা হয় দুজনের। সেভাবেই জানতে পারে দানিশের মা বোনকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল কসাইগুলো। ওদের আর পাওয়া যায়নি। বাহারা আর তার মায়ের কষ্টগুলো তাই তারও বুকে বাজে। এভাবেই একে অন্যের কাছাকাছি আসা আর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বেশ কিছুদিন ধরেই দানিশের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখছে সে। তার মুখে টুকটাক শুনেই বুঝতে পারে তাদের প্রিয় শহর এবং দেশ আবারো সেই পাষণ্ডদের কুক্ষিগত হতে চলেছে। বাহারা কিছুতেই ভাবতে চায় না তেমনটা হলে তাদের জীবনে কি ভয়ঙ্কর সময় ফিরে আসতে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি বয়ে যায়, হাত পাগুলো ঠাণ্ডা হয়ে আসে, আর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সে দানিশের দিকে। তার অবস্থা দেখে অনেক মমতায় জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করে তাকে দানিশ। বলে, “তুমি কোনো চিন্তা করোনা বাহার, আমি এতদিন ধরে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর জন্য দোভাষীর কাজ করছি, ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। যদি দেশ ছেড়ে যেতেই হয়, ওরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে কথা দিয়েছে, আর তুমি যেহেতু আমার বৌ, তাই তোমাকেও আমার সঙ্গে নিতে পারবো। একটাই শুধু সমস্যা, আমার তো কোনো পিছুটান নেই কিন্তু তোমার আব্বুজীর জন্য এখনই কিছু করতে পারব না। অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে আমাদের নিজেদের নাগরিকত্ব পেলে তবেই ওনাকে নিয়ে যেতে পারবো।”
দানিশ আরো বলে, ক্যাপ্টেন বার্কার তাকে আজ কালের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানাতে বলে দিয়েছেন। এসবই দানিশ ক্যাপ্টেন বার্কার এর বাঙ্কার থেকেই ভিডিও কল এ জানায় বাহারাকে। আব্বুকে নিতে পারবে না শুনেই বাহারার দু চোখ বেয়ে কান্না নামে। নিজের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে একটু আগে যতটা খুশি হয়েছিল সে, এখন ততটাই খারাপ লাগছে জেনে যে এতো বছর তাকে আগলে রাখা পিতা আর দানিশের সঙ্গে নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের মধ্যে যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হবে তাকে। এদেশে থেকে গেলে কি হতে পারে তার সঙ্গে, তা বুঝতে বাকি নেই বাহারার, কিন্তু আব্বুজীকেই বা কিভাবে ফেলে যাবে সে? আর তার আব্বুকে ফেলে যেতে পারবে না বলে দানিশকেই বা কিভাবে আটকাবে সে। অনেক ভেবেও কোনো কুল করতে না পেরে শেষমেশ বলে, “তুমি আমাদের জন্য চিন্তা কোরো না দানিশ। আমরা বাপ বেটিতে জান থাকতে কোনোদিন পাষণ্ডগুলোর হাতে ধরা দেব না। লুকিয়ে থাকবো, ভিক্ষা করে খাব, তবু আব্বুকে ফেলে যেতে পারবো না। তুমি যে সুযোগ পেয়েছো, তা হাতছাড়া কোর না। অস্ট্রেলিয়া গিয়ে যেদিন আমাদের দুজনকে তোমার কাছে নিয়ে যেতে পারবে, সেদিন আসবো তোমার কাছে প্রিয়। ততদিনের জন্য খুদা হাফিজ।”
বাহারার মুখে এমন কথা শুনে থমকে যায় দানিশ। কিছুক্ষণের জন্য যেন ভাষা হারিয়ে ফেলে সে, আর ঠিক তখনই মাথায় একটা কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে ওঠে বাহারা। পিছনে না ফিরেও সে বুঝতে পারে তার আব্বুজী দানিশ আর তার সব কথাই শুনে ফেলেছেন। বৃদ্ধ হাকিম আলী দৃঢ় কণ্ঠে দানিশকে বলেন বাহারাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে। চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে তিনি বলেন, “বাবা দানিশ, এই বুড়োটার জন্য তোমাদের নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ কিছুতেই নষ্ট কোর না। তোমাদের দুজনকে আমার কসম লাগে।” মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোর মা আর তোকে যেদিন ধরে নিয়ে গেলো, সেদিন বোধয় আজরাইলেরও অরুচি হয়েছিল আমার ওপর, নয়তো ছেলেকে কবরে শুইয়ে, মেয়ে আর বৌকে নিয়ে যেতে দেখেও আমার বুকের ধুকপুকানিটা বন্ধ হলো না কেন বলতো মা! এই দুনিয়ায় আমার কিছু কাজ আজও বাকি আছে রে মা। ভাবিস নারে বেটি। আমাকে আর কিইবা করতে পারে ওরা? বড়োজোর জানে মেরে ফেলতে পারে। তবে এবার ওদের অন্তত একটাকে না মেরে মরবোনা রে বেটি। আর যদি বেঁচে থাকি, তোর নতুন দেশে গিয়ে তোর কোলে মাথা রেখেই মরবো।”
তারপরও আব্বুজী আর দানিশের অনেক সময় লাগে বাহারাকে রাজি করাতে। প্রায় রোজই বাঙ্কার থেকে ভিডিও কল করে তাকে আশ্বস্ত করা আর কিভাবে কখন কোথায় যেতে হবে এসব বোঝাতে থাকে দানিশ। হঠাৎই একদিন কল দিয়ে হুড়মুড় করে কথা বলতে শুরু করে দানিশ। অনেক কষ্টে বাহারা বুঝতে পারে ওরা বড্ড কাছে এসে পড়েছে, একেবারে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তারা, তাই অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সেনাবাহিনী এবং তাদের সাহায্যকারীদের আজ কালের মধ্যেই প্লেন এ করে কাবুল ছাড়তে হবে। এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন বার্কারকেও দেখা যায় স্ক্রিনে। বাহারাকে হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানাতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে মুহূর্তে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দৃশ্যপট। প্রচণ্ড আওয়াজ আর ধুলোবালির জন্য কিছুই দেখা যায়না এক মুহূর্ত, আর তার পর পরই হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় সবকিছু।
নিজের চোখে কি দেখলো আর কি শুনলো আর তার তাৎপর্যই বা কি, তা যেন বুঝতে চায় না বাহারার মস্তিষ্কের কোষগুলো। এর পর আর দানিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না বাহারা, যা বোঝার বুঝে নেয় সে। টিভির পর্দায় দেখতে পায় শয়ে শয়ে লোক মিত্রবাহিনীর প্লেন এ ওঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, এমনকি ভিতরে ঢুকতে না পেরে প্লেন এর পাখায় করে যেতে গিয়ে আকাশ থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে শিউরে ওঠে বাহারা। যেন তারই স্বপ্ন ভঙ্গের প্রতীক হয়ে ধরা দেয় সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
সিডনী /১৭/০৮/২১
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|