আমার রবি ঠাকুর সুতপা বড়ুয়া
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা করতাম না যদি না কবিগুরু আমায় সে সাহস নিজেই যোগাতেন। তাঁর চিন্তায়, যেখানে যা কিছু ভালো, তাই যদি আমরা নিজের বলে গ্রহণ করে নিই, তাতেই নিখাদ আনন্দ, তাই আমার জ্ঞানের ছোট পরিধিতে দেখা সবচে বড় মাপের মানুষটিকে আমার নিজের মত করে যেমন ভেবেছি, পড়েছি, জেনেছি, তাই লেখার চেষ্টা করলাম। সাহিত্যের ছাত্রী হলেও বাংলা আমার বিষয় ছিল না, তবু, রবীন্দ্রনাথ সব বাঙালিরই আত্মার আত্মীয় আর দূর সম্পর্কে হলেও আমার সঙ্গে একটা ক্ষীণ পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্র ও রয়েছে তাঁর, কাজেই তিনি আমার আপনজন তো বটেই, অতএব ভুল ভ্রান্তির জন্য অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিয়ে 'করিলাম শুরু'।
আমার রবি ঠাকুর কে? তিনি কি শুধুই Nobel বিজয়ী বিশ্ব কবি? সবাই জানেন, ওটুকুই শুধু তাঁর পরিচয় নয়, তিনি একজন পরিশীলিত মানুষ, একজন সাবলীল প্রাবন্ধিক; ঋদ্ধ একজন ছোটগল্পকার। আর কিছু না লিখে শুধু গল্পগুচ্ছ লিখলেই যিনি হয়ত আমাদের মনে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিতেন। একজন জ্ঞানতাপস, যিনি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে শুরু করেছিলেন অভূতপূর্ব একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন, যা দিনে দিনে বেড়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতী তে। বাংলায় সেসময় যে তথাকথিত 'সন্ত্রাসবাদ' চলছিল, এবং তার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ব্রিটিশ তন্ত্র যে স্বৈরাচার করছিল, তিনি ছিলেন দুটোরই তীব্র সমালোচক। ধর্মীয় বিভাজন এর মাঝখানে তিনি ছিলেন প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা একজন ecologist, একজন মানবতাবাদী স্বপ্নদ্রষ্টা, যার স্বপ্ন ছিল দেশের কৃষি কে আধুনিক করার।
তাঁর জাতীয়তাবাদ নিয়ে নানা কথা শোনা গেলেও আমার মনে তাঁর জাতীয়তাবাদ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যেটাতে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল, তা হলো জাতীয়তা নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের দেখানেপনা। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের বিরোধী হলেও ঢালাও ভাবে কখনোই ব্রিটিশদের বা তাদের সংস্কৃতির নিন্দা করেন নি। তাঁর চোখে যেটা দুঃখজনক তা হলো ব্রিটিশ সংস্কৃতির যা সবচেয়ে ভালো দিক, মানব সম্পর্কের মর্যাদাকে তুলে ধরা, সেটা তাদের এই উপমহাদেশের প্রশাসনে কোনো স্থানই পায়নি। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জাতীয়তাবাদ, তাঁর পরিবারের সাথে ব্রিটিশ রাজ এর ব্যবসায়িক যোগসূত্র এবং তাঁর নোবেল পুরস্কার এ পুরস্কৃত হওয়া নিয়ে অনেক জলই ঘোলা হয়েছে, কিন্তু এরই মধ্যে বাংলাদেশ এর একজন প্রাবন্ধিক এর মতামত তুলে না দিয়ে পারলাম না, তার মতে, "Had there been no Khudiram Bose, or terrorist movement of Bengal, there would have been no Nobel Prize for Rabindranath Tagore." এই মত পোষণ করার পিছনে তারই ভাষায় তার বিশ্লেষণ: "The British rulers were much disturbed by the widespread activities of the volunteers of Terrorist Movement. They needed to pacify the Bengalees. Nobel Prize for Rabindranath Thakur was an attempt in that direction." কি বলি? To each his own.
এর জবাবে আমার তরফ থেকে, কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড'র প্রতিবাদে Viceroy Lord Chelmsford কে লেখা তাঁর চিঠিটা তুলে দিচ্ছি : "The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I for my part, wish to stand shorn, of all special distinctions, by the side of those of my countrymen who, for their so called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings." এ লেখা কি কোনো সুবিধাবাদী চাটুকার এর বলে মনে হয়? আমার তো হয় না।
আমার রবি চির-প্রেমিক এক মানবতাবাদী। তার অনেক লেখাতেই উঠে এসেছে নারী এবং অসহায় অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি তার গভীর মমতা। নিজে জমিদার-পুত্র হলেও বলশালীর হাতে অসহায় এর শোষণ তাকে সবসময়ই কাঁদিয়েছে। রবি ঠাকুর এর কাজের যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে পছন্দ, তা হলো তার লেখনীতে তখনকার পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর যে রূপটা তিনি তুলে ধরেছেন। নারী মননের বিভিন্ন স্তর, তাদের মনোজগতের দোলাচল যেভাবে তার লেখাতে উঠে এসেছে, তাতে অবাকই হতে হয়। এ ব্যাপারেও তিনি তখনকার বিচারে আরও অন্য অনেকের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে।
আমার রবি ঠাকুর আমার একান্ত আপনজন। মনের যেকোনো অবস্থায়, হোক তা রাগে, অনুরাগে, বিস্ময়ে, বিষাদে, আনন্দে, বেদনায়, প্রেমে, ভৎসনায়, আমি তাঁর কাছে যেতে পারি। আমার মনের কথা বলার ভাষাটা তাঁর সাহিত্যের বিশাল ভান্ডারের কোথাও না কোথাও আমি ঠিকই পেয়ে যাই। তবে একটাই ব্যাপারে আমার একটু খটকা লাগে, সেটা হলো, তিনি নিজে যদিও বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন, মৃনালিনী দেবীকে বিয়ে করেন যখন তার বয়স কেবলি দশ বছর। এতে তাঁর সরাসরি হাত না থাকলেও তিনি তাঁর নিজের দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তের এবং সাড়ে দশ বছর বয়সে! অবশ্য অন্য দিকে বিধবা বিবাহ কে সমর্থন জানাতে নিজের এক ছেলেকে তিনি অল্প বয়সী এক বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
সুতপা বড়ুয়া, সিডনি
|