সুমিত দত্ত রায় এর দু'টি কবিতা
তিনতলার এসি রুমরে ইতিহাসের শেষ।
এখনো মনে পড়ে এমন এক ফাগুন দিনের পড়ন্ত বেলায়ই এই ইতিহাসের শুরু হয়েছিলো। তারপর একদিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবন খাতার পাতায় পাতায় তার অধ্যায় রচিত হতে লাগলো। কিভাবে যে কি হয়ে গেলো ভাবতে অবাকই লাগে আমি কি নিজেই কোনদিন ভেবেছিলাম যে এত বড় একজন ঐতিহাসিক হয়ে যাবো আমি যাই হোক অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা যুদ্ধ-বিদ্রোহ, হাসি-কান্নার পরে এই ইতিহাস এসে তার ইতি টানলো গুলশানের নিকেতনে তিন তলার এসি রুমরে ভিতর, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পালা হলো শেষ। আমার অনিদ্রার সমস্যা ছিলো কিছুতেই ঘুম আসতোনা চোখে, কিন্তু সেই দিন গুলিতে- আমার খুব ঘুম হতো, আমরাতো জানি প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে খুব উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে। তার পর নিভে যায়। আর তাই হয়তো পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি এসে সেদিন আমাকে ঘিরে ধরে ছিলো, সব ঊত্তেজনার ঘটেছিলো প্রশমন। শ্বেত শুভ্র বিছানা, শ্বেত শুভ্র বালিশ, শ্বেত শুভ্র জানালার পর্দা, শান্ত উদাস মনে বাইরের আকাশ দেখা, সন্ধ্যার আগে আগে ফাগুন বাতাসে ঢেউ ওঠা হাতির ঝিলের পাশে ঘুরে বেরানো, কিংবা সবুজ ঘাসের ওপর বসে থাকা, এমনি কত সব ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাতায়। দুটি জীবন আজ দুটি ভিন্ন পথ ধরে এগিয়ে যাবে আকাশের মেঘ যেমন চাঁদকে ফেলে রেখে একা দূর দিগন্তে গিয়ে একে দেয় বেদনার রেখা, চাঁদ তবু নিশ্চল, নিশ্চুপ, শান্ত অচঞ্চল মেঘের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় রাতের পর রাত জেগে থাকে আকাশের গায় আর এভাবেই একদিন অপেক্ষার পালা হয় শেষ, যে মেঘ একবার চলে যায় তা আর কোন দিন ফিরে আসেনা। শেষ হয় রাত জাগার ইতিহাসের, নতুন একটি সকাল নিয়ে ভোর হয়, রোদ্র ওঠে, দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, বাতাস বয়, সে বাতাসে দুলে ওঠে নদী- সমুদ্রে জল, চাঁদ ডুবে থাকে জলের নীচে। না চাঁদ কাঁদছেনা এ চাঁদের চোখের জল নয় সোনালি জোছনা ছড়িয়ে দিয়ে চাঁদ বলছে কলঙ্কিত ইতিহাসের আজ শেষ হয়েছে, ভালই হয়েছে মেঘের ঠিকানা হয়েছে আজ অন্য কোন আকাশে যেখানে আর সব থাকলেও আমার মতো একটি চাঁদ নেই
একটি আদর্শ বর্গক্ষেত্র
গণিতে যে আমি খারাপ সে কথা সবাই জানে। কিন্তু কতটুকু খারাপ সবচেয়ে ভালো জানি আমি। আর আজ সেই আমাকে কবিতা লিখতে হচ্ছে কিনা বৃত্ত আর বর্গক্ষেত্র নিয়ে। ভাবতে একটু অবাক ই লাগছে। যাইহোক বহুকাল আগে শুনেছিলাম বৃত্তের কথা। কিন্তু বৃত্ত কোথায়? এতো একটি আদর্শ বর্গক্ষেত্র মাত্র। আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। আর অগোছালো কিছু গুল্মের আড়ালে বৃক্ষ । খুবই পরিচিত একটি দৃশ্য। রিকশায় চড়ে যেতে যেতে দেখেছি কোথাও কোন বৃত্ত চোখে পড়লনা। বৃত্ত যদি কিছু থেকেই থাকে, তবে তা আমাদের মনের চারপাশে। সবার পক্ষে সম্ভব হয়না সে বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার। যাইহোক সারি সারি গুল্মের আড়ালে কেবল বৃক্ষ । আর আছে ফসলের খেত, আঁকাবাঁকা মেঠো পথ। হয়তো ভাবছো - কি সব আবোল তাবোল কথা, কিসের বৃত্ত? কিসের বর্গক্ষেত্র? কিসের গুল্মের আড়ালে বৃক্ষ? আবোল তাবোল নয়, যা দেখেছি, তাই বলছি। চাইলে গিয়ে দেখে আসতে পারো। আজিমপুর থেকে রমনা যাবার পথে, শরতের এক পড়ন্ত বিকেল বেলায় স্বামীর সাথে রিক্সায় যেতে যেতে শহীদ জননী জাহানারা ঈমাম বলেছিলেন স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে, তবে তা নাকি এখানেই। ওনার মতো কারো পক্ষে এমন কথা বলাটাই হয়ত স্বাভাবিক ছিলো। তখন শুনেছি পলাশীর পাশে, বুয়েটের সামনে দিয়ে সলিমুল্লাহ হল হয়ে যে রাস্তাটা রমনার দিকে চলে গেছে তার দুপাশে ছিল অনেক গাছ, একটা পুকুর ও নাকি ছিলো সেখানে। অথচ বীরাঙ্গনা নারীর সেই সাজানো ফুলের বাগানও তো একাত্তরে এসে ধ্বংস হয়ে গেলো। ঠিক একই ভাবে যে পথ, পথের পাশের গাছপালা, আর বাড়িঘরগুলোকে আমি আমার স্বর্গ বলে ভাবতাম, মনে হয় আজ তারা এক আহত হৃদয়ের করুণ ধ্বংসস্তুপ। বৃত্তের বাইরে আমি বরাবরই ছিলাম। এবারও দেখলাম, বৃত্তের বদলে এক বর্গক্ষেত্র। দেখা শেষ করে যখন ফিরছি, দুর্দান্ত মেঘেরা এনে দিল এক প্রলম্বিত বর্ষণ। মনে হলো প্রকৃতি কাঁদছে, আমি দেখতে পারছি। অনুভব করতে পারছি। কিন্তু আমি ও যে ভেতরে ভেতরে হুহু করে কাঁদছিলাম এই প্রকৃতি তা কোনদিনই বুঝতে চেষ্টা করেনি। যদি করতো তবে হয়ত আজ আমাকে এমন করে কাঁদতে হতো না। বৃষ্টি হয়ে ঝরতো না আমার বেদনার নীল বর্গক্ষেত্র কেউ বৃত্ত বলে ভুল করতো না, আর আমাকে এসে দেখতে হতোনা, বৃত্তের বদলে একটি আদর্শ বর্গক্ষেত্র ।
|