ভালোবাসা দিবসের কথা কাজী সুলতানা শিমি
ভ্যালেন্টাইন’ডে বা ভালোবাসা দিবস’ - ভালোবাসার জন্য নিবেদিত একটি দিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় দিনটি শুধু প্রেমিক প্রেমিকারাই পালন করে থাকে। কিন্তু বিষয়টি শুধু যুগলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সার্বজনীন ভালোবাসার জন্য উন্মুক্ত করা হলে মনে হয় দিনটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। শুধু প্রেমিক প্রেমিকা একে অপরকে প্রেম নিবেদন করার মাঝেই নয় বরং একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসা প্রকাশের মাঝেই এর সার্থকতা। ফুল, পাখি, লতাপাতা ও প্রানিকুলের মতো মানব-মানবী ও প্রকৃতির অংশ। কোনো সুন্দর জিনিসকে ভালোলাগার মতো মানব-মানবীরও একে অপরকে ভালোলাগাতে পারে কোন পার্থিব আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই। পারিবারিক বন্ধন ছাড়াও বন্ধুত্ব বা মানবিক সম্পর্ক থেকেও ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। চিন্তা, কল্পনা, ধারণা ও অনুভূতিকে ঘিরে সে ভালোলাগার জন্ম। ভালোবাসা দিবসে হোক সেই উচ্চ মানসিক ভালোলাগা ও ভালোবাসার সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করার আয়োজন।
দৈনন্দিন দায়িত্ব, কর্তব্যর আর সামাজিকতার চাপে আমরা অনেকেই একসময় দূরে সরে যাই স্নিগ্ধ ভালোবাসা থেকে। মন, চিন্তা বা কল্পনার জগত বলে যেহেতু একটা জগতের অস্তিত্ব আছে ভালোবাসা হলো সেই মন, চিন্তা ও মানসিক জগতের অংশ। চিন্তা ও মন থেকে মানুষ পরস্পর পরস্পরকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করতে পারে, একান্ত ভাবে অনুভব করতে পারে এবং সেখানে পার্থিব চাওয়া হয়ে যায় গৌণ। ভালোবাসা পরস্পরের প্রতি কখনোই অধিকার আরোপ করেনা, প্রতিদান আশা করেনা। বিশুদ্ধ ভালোবাসা দেহ কে অতিক্রম করে, হয়ে ওঠে অনির্বচনীয় প্রশান্তির উৎস। একটি উচ্চতর মানসিক প্রাপ্তি।
ভালোবাসা দিবস নিয়ে বিভিন্ন প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে যে গল্পটা সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটা হল- রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস সেনাবাহিনীতে লোকবল বাড়ানোর জন্য যুবকদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তার মতে, বিয়ের কারণে তরুণরা যুদ্ধে যেতে চায় না। সম্রাটের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন ভ্যালেন্টাইন নামে এক খ্রিষ্টান ধর্ম-যাজক। তিনি গোপনে যুবক-যুবতীদের বিয়ের আয়োজন করতে থাকেন। একসময় ধরা পড়ে গেলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে তার সাথে এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ের দেখা হয়। চিকিৎসার মাধ্যমে ভ্যালেন্টাইন তাকে সারিয়ে তোলেন। মেয়েটির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। সম্রাটের আদেশ অমান্য করার জন্য ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং তা কার্যকর করা হয়েছিল ২৭০ সালের এই ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে। মৃত্যুর আগে ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে একটি চিঠি লেখেন, সেখানে তিনি চিঠির সমাপ্তি টানেন ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’ বলে। পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইনকে সেইন্ট হুড প্রদান করেন এবং ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবে ঘোষণা করেন।
এ দিবসটি নিয়ে একটি কাল্পনিক গল্প ও বেশ প্রচলিত। কোন এক গ্রীক নগরীতে এক সাধারণ যুবক সে সময়ের এক রাজকুমারীকে ভীষণ ভালোবাসতো। রাজকুমারী শর্ত দিলো তাকে পেতে হলে ভালোবাসার পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। পরীক্ষাটি হলো তাকে একটি লাল গোলাপ এনে দিতে হবে। তখন ছিল শীত কাল। সারা রাজ্য জুড়ে কোথাও গোলাপ ফোটেনি। অনেক খোজা খুঁজির পর যাও একটি গোলাপ পাওয়া গেলো সেটি ছিল সাদা। লাল গোলাপ না পেয়ে যুবকটি সেই সাদা গোলাপের পাশে বসে বসে কাঁদতে লাগলো। তার দুঃখ ভারাক্রান্ত অসহায় অবস্থা দেখে একটি নাইটেঙ্গেল পাখির ভীষণ মায়া হল। সে কাছে এসে তার কান্নার কারণ জানতে চাইলো। যুবকটি কারণ বলার পর নাইটেঙ্গেল পাখিটি বলল সে তার বুকের রক্ত দিয়ে সাদা গোলাপটি লাল বানিয়ে দেবে। যুবকটি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। দেখল সত্যি সত্যি নাইটেঙ্গেল পাখিটি গোলাপের কাঁটায় তার বুক চিড়ে রক্ত ঝড়তে দিলো সাদা গোলাপের ওপর। এভাবে সারারাত পাখিটি তার বুকের রক্ত দিয়ে সাদা গোলাপটি লাল বানিয়ে দিয়ে নিজে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। এই লাল গোলাপের বিনিময়ে যুবক তার ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেয়সীকে জয় করলো। এই ভালোবাসার পিছনে ছিল নাইটেঙ্গেল পাখিটির আত্মত্যাগ। সেদিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি তাই সেদিন থেকে পালিত হয়ে আসছে ভালোবাসা দিবস।
ভালবাসা একটা অনুভূতি, আমরা যখন কোন ভালো শিল্পকর্ম, ছবি বা গান শুনি আমাদের মনে গভীর অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এই অনুভূতি অদ্ভুত ও রহস্যময়। সেখানে কোনও লোভ বা আকাঙ্ক্ষার ছোঁয়া থাকেনা। সে অনুভূতি অন্তর্গত, অপ্রকাশ্য, অপার্থিব। কোন মানুষকে ভালোলাগার পেছনেও এমন অনুভূতি কাজ করে। আর সেক্ষেত্রে শারীরিক সৌন্দর্য, বয়স কিংবা জেন্ডার কোন বাধা নয়। দুজন মানুষ পরস্পর পরস্পরের সান্নিধ্য, চিন্তা-চেতনা ও মানসিক ঐক্যর ভিত্তিতেও একে অপরের একান্ত আপন হয়ে উঠতে পারে। তৈরি হয় ভালোবাসা ও অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। ভালোবাসা দিবস হোক সেই পবিত্র অনুভুতিময় সার্বজনীন বন্ধুত্বের দিন।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|