ভাষা ব্যবহারে সতর্কতা ও পরিমিতি বোধ কাজী সুলতানা শিমি
অভিবাসী হয়ে প্রথম যখন অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে নামলাম তাদের অভিবাদন জানানোর ভাষা ও ভাষার শাব্দিক অলংকরণ শুনে অভিভূত হয়ে পরেছিলাম। ‘ইয়েস-প্লীজ’, ‘নো-থ্যাংকস’ বা ‘টেক-কেয়ার’ শব্দগুলো যে পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতায় বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। পরে দেখি সাধারণ কথাতেও শব্দের সুন্দর বিন্যাস ও পরিমিতি বোধ থাকে যা চর্চা ছাড়াও তাদের কৃষ্টিরই অংশ। প্রসঙ্গটা এ কারণে যে, বাংলা ভাষা ও ভাষার ব্যাবহারে অসংলগ্নতা খুব নজরে পড়ছে ইদানীং। বাংলা ভাষায় যথেষ্ট পরিমাণ নম্র ও বিনয়ী শব্দের বিপুলতা থাকা স্বত্বেও কেন জানি সাধারণ কথনে বা দৈনন্দিন বাক্যালাপে তার যথাযথ ব্যবহার করা হয়না। সোজা ভাবে বলা যায় ভাষা ব্যাবহারে আমরা সতর্কতা বা পরিমিতি বোধ চর্চা করিনা। ভাষার যথার্থ অনুশীলন ভাষার মাধুর্যতা বাড়ায়। বর্তমানে বাংলা শব্দের অপরিমিত ব্যবহার একটু বেশীই যেন চোখে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে যদি ইংরেজি ভাষার ব্যবহার তুলনা করি তাহলে বুঝা সহজ হবে। যেমন ইংরেজি ভাষায় ‘ইয়েস- প্লীজ’, ‘নো-থ্যাংকস’ বা ‘টেক-কেয়ার’ জাতীয় শব্দগুলো অনেকটা একক শব্দ হিসেবেই গতানুগতিক কথোপকথনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আলাদা করে উপলব্ধি করতে হয়না যে এটা সৌজন্যতা-বোধের অংশ। ইংরেজি ভাষার গঠনশৈলীতে এ ধরণের শব্দের ব্যবহার নৈমিত্তিক কথার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত। বাংলা ভাষায় এ জাতীয় সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার থাকার পরও আমরা যেকোন কারণেই হোক তা ব্যবহার করতে চাইনা বা করিনা।
আরো লক্ষণীয় একটা ব্যাপার হচ্ছে, কথোপকথন এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও ভাষা ব্যাবহারে অনেকক্ষেত্রেই সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছেনা। এবং পরিশুদ্ধ বা চলতি ভাষার চেয়ে অপভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশী জন্মাচ্ছে। কারণ হিসেবে সম্ভবত আমরা মনে করি যে, পরিশুদ্ধ ভাষা বুঝি কেবল সাহিত্য, উপস্থাপনা, বা ফর্মাল আলোচনার জন্য। এজন্য গল্প, আড্ডা, সমাজ মাধ্যম অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ব্যাপারে বেশ অসংলগ্নতা লক্ষণীয়। তার উপর স্মার্ট-ফোন ও ডিজিটাল গণতন্ত্রের কারণে বিষয়টা চর্চিত হচ্ছে আরো অবাধে।
ভাষা সামাজিক অস্তিত্বের অন্যতম বাহক। ভাষা বা শব্দের মাধ্যমে মানুষ মনের ভাব আদান প্রদান করে, অনুভূতি প্রকাশ করে। সেই ভাষার ব্যবহার ও অনুশীলন যদি পরিমার্জিত ও চিত্তাকর্ষক না হয় তাহলে এটি নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে ডিজিটাল গণতন্ত্র শুরু হবার পর থেকে বাক স্বাধীনতার নামে অপভাষার ব্যবহার শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে। কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে মানুষের অনুভূতি ও মনোভাব প্রকাশে যে সব শব্দ বা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি সহনীয়ও নয়। কিন্তু কোন সেন্সর কিংবা বাধা না থাকায় এসব সামাল দেয়া বা রোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। তার উপর মানুষের রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, বিশ্বাস প্রকাশের বিশ্বস্ত ও ভরসার জায়গা গুলো সীমিত হয়ে যাওয়ার কারণে অনুভূতির উদগীরণ হয় ভাষার ভয়ঙ্কর অপপ্রয়োগে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো আর বিশ্বস্ত বন্ধু, স্বজন, কিংবা শুভার্থীর সাথে মনপ্রাণ খুলে কথা বলা এক নয়। তাই এই অভব্যতা অবলীলায় বিস্তৃত হচ্ছে। কেননা কাউকে পাওয়া না গেলে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ উদগীরণ সবচে সহজ পথ এখন। অপভাষা ব্যাবহারের এই আগ্রহ ও বিপুলতা আসলে কৃষ্ট-গত দৈন্যতারই নিদর্শন। তাছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ভাবে এই অপভাষা ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রে মূল ভাষার মর্যাদা হানি করে। আলাপচারিতায় অপভাষা ব্যাবহারের যে প্রচলন শুরু হয়েছে এটা রোধ করার পদক্ষেপ জরুরী। কেননা অহরহ অপভাষা ব্যাবহারের কারণে অনেকক্ষেত্রে সে শব্দ বা ভাষা বিনোদন-মূল্য অর্জন করে ফেলে। আর মানুষ যেখানে বিনোদন বা আনন্দ পাবে সেটার চর্চাই বেশী করবে। আরো একটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকার যে কটাক্ষ করতে হলেও ভাষার অপব্যবহার করা ঠিক নয়। কেননা বিদ্রুপাত্মক বা ব্যাঙ্গাত্মক শব্দে কারো ভুল শোধরানো যায়না। অনেকক্ষেত্রেই কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার কৌশল হিসেবে এ জাতীয় শব্দ ও ভাষার প্রয়োগ করা হয়। এটা খুবই অপেশাদার ও অগ্রহণীয় পথ। কুবাক্য ও কুকথা কখনোই কাউকে শোধরাতে পারেনা। অন্ধকার যেমন অন্ধকার দুর করতে পারেনা, ঘৃণা দিয়ে যেমন ঘৃণা দুর করা যায়না ঠিক সেরকম ভাবেই বিদ্রূপ বা তাচ্ছিল্যর ভাষা মানুষকে ভালোবাসতে শেখায় না।
সেজন্য ডিজিটাল গণতন্ত্রের নামে আমরা যেনো অশিষ্টতার অনর্গল প্রয়োগে অভস্থ্য না হই। কালের প্রবাহে মানুষ এখন বহুজাতিক মিশ্র কালচারে অভ্যস্ত। তবুও নিজ সংস্কৃতি ও কৃষ্টির প্রতি মানুষের একটা দায়বদ্ধতা থেকেই যায়। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই দৈনন্দিন কথনে ভাষার পরিশুদ্ধ ব্যবহার বাড়ানো দরকার। ব্যাবহারের এই গতিশীলতা ও উপর্যুপরি অনুশীলন মুলতঃ ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। আর সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয় ভাষার পরিমার্জিত অনুশীলনে। নইলে ধীরে ধীরে মূল ভাষার ভিত্তি নড়বড়ে হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। তাই কথোপকথন ও সাধারণ চর্চায় ভাষার সতর্ক ও পরিমিত ব্যাবহারে ভাষাকে করতে হবে আরো মাধুর্যময়। পরিশুদ্ধ ভাষা চর্চা অর্থাৎ ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার আচরণেও আনতে পারে সতর্কতা বোধ। আর এটি যে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক তা বুঝতে দূরদর্শী চিন্তার প্রয়োজন পড়েনা।
 কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|