আমরা কি একবার দেশপ্রেমী হতে পারি! শুধু একবার... কাজী সুলতানা শিমি
রাত প্রায় সোয়া বারোটা। বাসায় ফিরছি একা একা। ভিক্টোরিয়া রোড পার হয়ে জেমস রুজ ড্রাইভ দিয়ে আসতেই ওয়েস্টার্ন সিডনী ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাস। আলো-আধারিতে চমৎকার লাগছে। আধারের ও এতো সুন্দর রূপ আছে জানিনি আগে। একই জিনিস অথচ দিন আর রাতের সৌন্দর্যের মাঝে কী অদ্ভুত পার্থক্য। মোহনীয় পরিবেশ। মন ভরে উপভোগ করছি। একা এতো রাতে ড্রাইভ করে নিরাপদে বাসায় ফিরছি। অথচ এই সময়ে নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা রাস্তায়। যেখানে আরও সব শ্লোগানের সাথে প্ল্যাকার্ডে লেখা- লাশ নিবেন লাশ, ছাত্র ছাত্রীর লাশ- এক পিস ২০ লাখ”। বুকটা হু হু করে উঠে। আমিও রাস্তায়। ফিরতে দেরি হবে জানাতেই অপেক্ষা না করে বাসায় শুয়ে পড়েছে সবাই। রাত কিংবা রাস্তা কোন চিন্তার বিষয় নয় এখানে। নিশুতি রাত। সুনশান নীরবতা, কিন্তু নিশ্চিন্ত। ইদানীং মাঝেমাঝেই আমার কাজ ও পড়াশোনার কারণে বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যায়।
অপরূপ নীরবতা। তবুও আছে এক শান্তি ও স্বস্তি। একটুও ভীত বা বিচলিত লাগছেনা। বিচলিত লাগছে দেশের জন্য। রাস্তায় জড়ো হওয়া ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য। প্রায় বিশ বছর হয়ে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে চলে এসেছি তবু কেন জানি দেশের জন্য মনের কোনে সারাক্ষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় এক সাপ্তাহ ধরে দেশে ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় নেমেছে। দাবীটা যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয়। সবচে বড়ো কথা বাঁচা-মরার প্রশ্ন যেখানে মূখ্য সেখানে তো আর কোন দ্বীমতের সুযোগ নেই। কিন্তু কি করে যেন এই আন্দোলনটা অন্যসব আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক দিকে চলে গেলো। আর তখনি শুরু হলো সেই পুরানো কাঁদা ছোড়াছুড়ি। ভরে গেল, দল, লীগ আর শিবির-রাজাকারের কেচ্ছা কাহিনীতে। আচ্ছা- একটা সুন্দর, যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় দাবীতেও কি আমরা একবারের জন্য হলেও দেশপ্রেমী হতে পারিনা! দেশপ্রেমী বা শুধুই বাংলাদেশী হতে হলেও কি কোন না কোন দলের উপাধি লাগবে?
সবার জন্যই প্রয়োজনীয় এমন একটা অধিকারের প্রশ্নেও শুরু হয়ে গেলো বিতর্ক। সবচে বড়ো কথা আন্দোলনকারীরা কিশোর-কিশোরী। একেবারেই কুঁড়ি ফোঁটা শিক্ষার্থী। যাদের ওপর নির্ভর করছে গোটা দেশের ভবিষ্যৎ। প্রশাসন ইচ্ছে করলেই তিনদিনের মাঝেই একটা সর্বজন সম্মত সড়ক নীতির আশ্বাস ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে পারতো। এতো ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের শান্ত করা এমন কোন বিষয়ই ছিলোনা প্রশাসনের কাছে। ছেলে-মেয়ে গুলোর কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ছিলোনা। কিন্তু এমন ন্যায়সঙ্গত একটা অধিকারের প্রশ্নেও শুরু হল ভাগাভাগি আর দলাদলি। আন্দোলন আর আন্দোলন রইলোনা। ছেলে-মেয়েদের নিরাপত্তা এখন উদ্বগের বিষয়। আমরা এ কেমন জাতি! কুঁড়ি ফোঁটা বাচ্চাদের প্রশ্নেও একবারের জন্য ও দেশপ্রেমী হতে পারছিনা। যার যার দল নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ছি। সোশাল মিডিয়ায় নানা ছবি আর তথ্য উপাত্তে সয়লাব। চারপাশে কেবল কাঁদা ছোড়াছোড়ি আর পারস্পরিক সমালোচনা। নিরাপদ সড়কের প্রশ্নে আমরা কি একবারের জন্য হলেও এই প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে পারিনা?
পশ্চিমাদেশের রীতিতে কেউ গ্রেফতার কিংবা কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়লে মিডিয়ায়তে তাদের মুখ ঢেকে রাখা হয়। যাতে করে ভবিষ্যতে কোন রকম বিব্রতকর পরিস্থিতি বা প্রশ্নের মুখমুখি হতে না হয়। এতে লজ্জা ও অপমানে তাদের মানসিক বৈকল্য কিংবা সামাজিক অপরাধে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে বলে এই ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হয়। অপরিণত বয়সী হলে তো আরও বেশী সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। খুনের দায়ে কিংবা বড়ো কোন অপরাধে অপরাধী হলেও কোর্টে হাজিরা দেয়ার সময় তাকে কোট-টাই কিংবা মার্জিত পোশাক পরিহিত অবস্থায় অত্যন্ত পরিশীলিত রূপে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে যতো বরেণ্য ব্যক্তি কিংবা সুশীলই হোকনা কেন অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই পুলিশ প্রহরায় তাকে যে অবস্থায় দেখা যায় তাতে যে কোন মানুষেরই বুক কেঁপে উঠবে। এই যে আমাদের আচরণ ও মনোভাব সেটা কতোটা সভ্যতা সমর্থিত! আমরা নিজেদের দেশপ্রেমী প্রমাণ করতে গিয়ে অপরের দোষারোপ করতে মরিয়া হয়ে উঠছি। অথচ এসময় আমাদের দরকার আত্নশুদ্ধি ও পারস্পারিক সহযোগিতা।
ফিরে আসি প্রসঙ্গে। এদেশে রাত করে বাড়ি ফিরতে দুশ্চিন্তা কম। দুর্ঘটনার হার কম। ট্রাফিক-নিয়ম মেনে চলার রীতিতে সবাই অভ্যস্ত। গভীর রাতে কোন পুলিশ প্রহরা নেই, চারপাশে কেউ নেই তবুও কেউ নিয়ম ভাংছেনা। রেডলাইট অমান্য করে চলে যাচ্ছেনা। পথচারী থাকুক বা না থাকুক সময় মতো গাড়ীর গতি কমিয়ে আনছে। লাইসেন্স ছাড়া পথে নামছেনা। লাইসেন্স সবসময়ই সাথে রাখছে। আমাদের দেশে এই নিয়মগুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্যই ছেলেমেয়েরা আজ পথে নেমেছে। এটা কি খুব বেশি চাওয়া? এই সুন্দর চাওয়াগুলোর জন্যই সাতচল্লিশ বছর পর তাদের পথে নামতে হলো। আমরা সাধারণ মানুষেরা কি তাদের এই চাওয়াগুলোকে মুল্য দিতে পারিনা? কোন দলের রং না মেখে কেবলই দেশপ্রেমী হয়ে একবার তাদের পাশে দাঁড়ানো কি আমাদের জন্য এতটাই কঠিন? আসুন না দলের উর্ধে থেকে একবার আমরা দেশপ্রেমী হতে চেষ্টা করি! শুধুই দেশপ্রেমী অন্যকিছু নয়, শুধু একবার...
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|